নাগরিক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল নগরের অধিবাসী, তবে এর প্রায়োগিক অর্থ কিন্তু এর থেকে কিছুটা ভিন্ন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় দেখতে গেলে নাগরিক তাদেরকেই বলা হয়, যারা রাষ্ট্রের বিবিধ ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করার অধিকারী হয়, অর্থাৎ যারা রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল অধিকারকে ভোগ করে থাকে এবং রাষ্ট্রের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে তারাই হল নাগরিক। এই নাগরিকদের মর্যাদাকে বলা হয় নাগরিকতা।
নাগরিকতার মর্যাদা, Status of Citizenship
নাগরিকদের উচিত নিজ দেশের স্বার্থে সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা, কারণ যদি তারা যথাযথভাবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তবে তাদের নাগরিকতার মর্যাদার বৃদ্ধি ঘটে। যেকোনো দেশের নাগরিক হিসেবে তাকেই ধরা হয় যে স্থায়ীভাবে নিজ রাষ্ট্রে বাস করে, সর্বদা নিজের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত সব অধিকারগুলো ভোগ করে থাকে তথা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি নিজের সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে; কারণ নাগরিক অধিকার হল একটি সভ্য দেশের মানুষের বাঞ্ছিত সম্পদ। এইসব অধিকার না থাকলে যেকোনো ব্যক্তির জীবন বিড়ম্বিত হয়।
কালবৈশাখী রচনা, The best essay on Northwester or Kalbaisakhi in Bengali
সুনাগরিক এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন, Building a good citizen and welfare state
একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সুনাগরিকের প্রয়োজন রয়েছে। একজন সুনাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে সক্ষম এবং তাকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তথা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিক থেকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয়। প্রতি নাগরিকের নিজের রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি, স্থায়িত্ব, স্থিতি, সৌভাগ্য এবং সুনাম; এক কথায় সমষ্টিগত স্বার্থের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত। এইসব কিছুর মাধ্যমে এক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য দেশপ্রেমের দিক থেকে অনুভূতিপরায়ণ, নৈতিক তথা দায়িত্ববান সুনাগরিকদের প্রয়োজন হয়।
একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব এবং কর্তব্যসমূহ, Responsibilities and Duties of a good citizen
নিজের অধিকার ভোগ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। মানুষ আগ্রহ সহকারে এবং নৈতিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের যে সকল দায়িত্ব পালন করে থাকে, যা নাগরিকের নৈতিক কর্তব্য হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে আইন দ্বারা আরোপিত বিধি নিষেধগুলো মেনে চলে যেসকল কাজ করা হয় তাকে আইনগত কর্তব্য বলা হয়।
কোনো নাগরিককে নিজের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে হলে এসকল কর্তব্য পালন করা উচিত। নাগরিকরা যদি রাষ্ট্রের প্রতি নিজের বিভিন্ন কর্তব্যগুলোকে যথাযথভাবে পালন না করে তখনই রাষ্ট্রে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলার, বিনষ্ট হবে শান্তি সম্প্রীতি এবং রাষ্ট্রের উন্নতিও ব্যাহত হতে পারে। তাই নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হবে। নিচে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—
দেশের প্রতি আনুগত্য, Loyalty to country
প্রতিটি দেশের নাগরিকদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য নিজের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য রাখা। আনুগত্য বলতে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা, যা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে এবং উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক বিষয়। তাই তাদের রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা উচিত। নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে প্রত্যেক নাগরিককে সজাগ থাকা উচিত, তথা সময় বিশেষে চরম ত্যাগের জন্যও নিজেকে প্রস্তুত রাখাতে হবে।
সততার সাথে ভোট দান করা, To Vote honestly
ভোটদান নাগরিকের একটি জরুরী কর্তব্য। ভোট দানের মাধ্যমে একজন যোগ্য নাগরিক রাষ্ট্রের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে। দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব হল এই শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা। সততার সঙ্গে এবং সুবিবেচনা করে ভোট প্রদান যেকোনো দেশের নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্গত। এভাবেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য তথা উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত হবে।
গ্রীষ্মের দুপুর সেরা রচনা, Best essay on summer afternoon in Bengali
দেশের আইন মেনে চলা, Abide by the laws of the land
প্রতি নাগরিককেই নানা ক্ষেত্রে হয়ে থাকা দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর তোলা উচিত। কোনো ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের, এমনকি রাষ্ট্রে সংগঠিত বেআইনী কোনও কাজের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো উচিত। এইসব হল নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে কোনো ভাবে আইনকে নিজ হস্তে তুলে নেওয়া যাবে না। তবেই সুশাসন তথা এক দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। দেশের নাগরিকদের জীবনযাপন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে রাষ্ট্র বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করে থাকে।
সেইসব আইন অমান্য না করে তা যথাযথভাবে মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। নিজ দেশের প্রচলিত সকল আইন এবং সংবিধানের বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব। যদি কেউ কোনো আইন অমান্য করে তবেই সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে শুরু করে। ব্যাঘাত ঘটে মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও। সেই সমস্যা থেকে দূরে থাকতে এবং সুষ্ঠু জীবনযাপন তথা শান্তি এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের আইন মেনে চলা জরুরী।
সঠিক সময়ে কর প্রদান, Paying taxes on time
দেশের উন্নতির স্বার্থে অর্থ সংগ্রহ করতেই রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর কর আরোপ করে। নাগরিকদের প্রদান করা কর এবং খাজনা হল রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস। দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলো সম্পাদন করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়। তাই সকল দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব অনুযায়ী যথা সময়ে কর প্রদান করা উচিত যাতে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা হয়।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, Religious tolerance
আমাদের দেশে ভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। নিজ ধর্ম পালন করার পাশাপাশি মনের মধ্যে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। দেশের ধর্মীয় বৈচিত্র্য সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভাবে বজায় রাখতে সকলকে মিলেমিশে থাকতে হবে।
কোনো দেশের নাগরিকদের মনে অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা থাকা উচিত, তবে এর পাশাপাশি তাদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে। নিজ দেশের সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অর্জন ও সফলতা নিয়ে গর্বিত বোধ এবং সর্বদা দেশের মঙ্গল কামনা করা নাগরিকদের কর্তব্য। নিজের দেশের জাতীয় সংগীত, জাতীয় ইতিহাস তথা জাতীয় বীর ও মনীষীদের সকল অবদানকে স্মরণে রাখতে হবে।
রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল দায়িত্ব পালন করা, To fulfill all duties given by the state
দেশের কল্যাণ করার জন্য নাগরিকদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয় থেকে। এইসব দায়িত্ব সততা এবং নিষ্ঠা সহকারে পালন করাই হল প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। রাষ্ট্র দ্বারা অর্পিত সকল দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করাই হল নাগরিকের প্রধান কর্তব্য। সরকার থেকে গৃহীত কোনো কর্ম মানেই জনগণের স্বার্থে কাজ করার সুযোগ লাভ করা। কোনো সরকারি কর্মকর্তা তদুপরি দেশের নাগরিকদের সততা এবং কাজের ক্ষেত্রে একাগ্রতা তথা নিষ্ঠার উপরই সরকারের সফলতা, উন্নতি এবং অগ্রগতি নির্ভর করে থাকে।
শরীরচর্চা সেরা রচনা, Best essay on physical exercise in Bengali
সন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান, Providing good education to children
বর্তমান শিশুই হল রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নাগরিক। পিতামাতা এই ভবিষ্যত নাগরিকের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই নিজের সন্তানদের জীবনরক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে টীকাদান করা, শিশুদের সুস্থ-সবল রাখা তথা নির্দিষ্ট সময় মেনে চলে তাদেরকে স্কুলে পাঠানো সকল পিতামাতার দায়িত্ব।
এভাবেই একটি সন্তান সুশিক্ষিত হয় এবং পরবর্তীতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে; আর একটি সুনাগরিকই নিজের পরিবার, সমাজ সেবা ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখে। নিজের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দানের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা দেশের প্রতিটি নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। এছাড়াও সুনাগরিক হিসেবে যেকোনো নাগরিকের মধ্যে তিনটি প্রধান গুণ থাকা উচিত। সেগুলি হল, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে বুদ্ধি, বিবেক এবং সংযম প্রদর্শন করা।
- বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার সমস্ত তথ্য, ইতিহাস ~ Essay on Saraswati Puja in Bengali ( PDF )
- একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]
- সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali
- ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
- বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
উপসংহার, Conclusion
সকল দেশের নাগরিকদের নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত এবং পালন করা উচিত। কোনো নাগরিককে নিজের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে হলে দেশের প্রতি তাদের কর্তব্যসমূহ পালনের দিকে লক্ষ্য রাখাও খুব জরুরী। তাছাড়া দেশের সকল নাগরিকের একে অপরের সাথে সদ্ভাব রাখতে হবে।
কারও প্রতি কোনো ভেদাভেদ রাখা ঠিক নয়। কোনো ব্যক্তির ভিন্ন মত থাকতে পারে এবং সেই মতকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়েই জাতীয় সংহতি অর্জন করা সম্ভব হয়। একটা বিষয় প্রত্যেকেরই বিশ্বাস রাখতে হবে যে বৈচিত্র্যের মধ্যেই জাতির সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে।