বাঙালির প্রাণের শারদীয়া উৎসবের ব্যাপারে জানা অজানা সব তথ্য নিয়ে এসেছি আমরা, পড়ুন এবং সকলের সাথে শেয়ার করুন। মা প্রায় এসেই গেছেন, দুর্গাপূজার আগাম শুভেচ্ছা রইলো সকলের জন্য।
বাঙালির প্রাণের উৎসব
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো হয় দুবার, আশ্বিন মাসে অর্থাৎ শরৎকালে একবার হয় যা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। আবার চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তকালেও এই পুজো হয় যা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। তবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজাই এগিয়ে থাকে।
দুর্গাপূজার ইতিহাস
দুর্গা পূজা প্রথম কবে শুরু হয়েছিল তা না জানা গেলেও দুর্গাপূজার ইতিহাস বহু পূর্বের। হিন্দু পুরাণে দুর্গাপূজার কেন্দ্রিক বিভিন্ন তথ্য আছে যার মধ্যে রাজা সুরথ হারানো রাজ্য ফিরে পেতে বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেন বলে জানা যায়।
আবার কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে ১০৮টি নীল পদ্ম সহযোগে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়াও দেবীভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রভৃতিতেও দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক নানা তথ্যের উল্লেখ আছে।
প্রকৃতি নিজরুপে সেজে ওঠে
দুর্গোৎসবের আগেই প্রকৃতি নিজরুপে সেজে ওঠে, আকাশের রোদের ঝলক, ভোরে শিশির ভেজা ঘাসে শিশিরবিন্দু, ঝড়ে যাওয়া শিউলি ফুল, সারি সারি সাদা কাশফুলে ভরে ওঠে বাংলার মাঠ।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে বাঙালি শারদ উৎসবে মেতে ওঠে। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী পর্যন্ত দেবীর আরাধনা চলে।পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে অমাবস্যায় মহালয়ার পুণ্য তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে।
দেবীপক্ষ
শারদীয়া দুর্গাপূজার পাঁচ দিন হল “ষষ্ঠী”, “মহাসপ্তমী”, “মহাষ্টমী”, “মহানবমী” ও “বিজয়াদশমী”। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। দেবীপক্ষের সূচনা হয় মহালয়ার দিন আর দেবীপক্ষের শেষ হয় দিনে হয় কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন অনেকে হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পুজো করেন।
বিশ্বে প্রতি প্রান্তেই
বিশ্বের প্রায় প্রতিটা প্রান্তেই বাঙ্গালিরা এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে। প্রবাসী বাঙ্গালিরাও দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরা বাংলাদেশেও দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে সরকারি ছুটি থাকে।
বনেদি বাড়ির পূজা – সর্বজনীন পূজা
কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারকেন্দ্রিক যে দুর্গাপূজা তা “বনেদি বাড়ির পূজা” নামে পরিচিত । এই পুজোয় মূলত শাস্ত্র আচারের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়।
আর কোনো একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা মিলে যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তাই হল বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা ।
কলকাতা শহরে সার্বজনীন দুর্গোৎসবের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়।
প্রথম বারোয়ারী দূর্গা পূজার আয়োজন করা হয়েছিল ভবানীপুরে একটি সনাতন গোষ্ঠীর উদ্যোগে।
বোধন
দেবীপক্ষের পুণ্য তিথিতে মহাষষ্ঠীর দিন দেবী দুর্গার বোধন হয়। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তে দেবী দুর্গার পুজো হয় সাড়ম্বরে।
নবপত্রিকা পুজো – নবপত্রিকা
দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার বিশেষ গুরুত্ব আছে। নবপত্রিকা অর্থে নটি গাছের পাতা বোঝালেও পুজোর ক্ষেত্রে নটি গাছের পাতা নয়, নটি উদ্ভিদ হল নবপত্রিকা ।এই নটি উদ্ভিদ হল –
- কদলী বা রম্ভা অর্থাৎ কলা
- অপরাজিতা,
- হরিদ্রা
- জয়ন্তী,
- বিল্ব অর্থাৎ বেল
- দাড়িম্ব,
- অশোক,
- মানকচু,
- ধান
কলাবউ
প্রচলিত ভাষায় কলাবউ নামেই অধিক সমাদৃত নবপত্রিকা।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একসাথে করে তাতে দুটি বেল সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকারে তৈরী করে সিঁদুর দিয়ে দাঁড় করানো হয় দেবীপ্রতিমার ডান দিকে।
নবপত্রিকায় নটি উদ্ভিদ হল দেবী দুর্গার নয়টি রূপের কল্পিত প্রতীক। যা হল রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।
মহাসপ্তমীর দিন সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করানোর পর নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয় কলাবউ।
কুমারী পূজা
সব নারীই যে মায়ের রুপ এই বিশ্বাসে অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা করা হয়।
তন্ত্রশাস্ত্রমতে ষোলো বছরের মধ্যে অরজঃস্বলা কুমারী মেযে়র পূজা হল কুমারী পূজা। দুর্গাপূজার প্রধান অঙ্গ গুলির মধ্যে অন্যতম এই পূজা।
দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজার প্রবর্তন করেন স্বামী বিবেকানন্দ, সালটা ছিল১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর।
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যা
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে পুজো করা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। যেমন এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুইবছরের কন্যা সরস্বতী,তিন বছরের কন্যা ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কন্যা কালিকা, পাঁচ বছরের কন্যা সুভগা, ছ’বছরের কন্যা উমা, সাত বছরের কন্যা মালিনী, আট বছরের কন্যা কুঞ্জিকা, ন’বছরের কন্যা কালসন্দর্ভা, দশ বছরের কন্যা অপরাজিতা, এগারো বছরের কন্যা রুদ্রাণী, বারো বছরের কন্যা ভৈরবী, তেরো বছরের কন্যা মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরের কন্যা পঠিনায়িকা, পনেরো বছরের কন্যা ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোলো বছরের কন্যা অম্বিকা নামে পুজো করা হয়।
সন্ধিপূজা
সন্ধিপূজার আরও একটি বিশেষ অংশ হল সন্ধিপূজা । দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে এই বিশেষ পূজা হয়। ৪৮ মিনিটের এই পুজোয় অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট অর্থাৎ ৪৮ মিনিটের মধ্যে এই পূজা হয়। অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে হওয়ায় এই পূজাকে বলা হয় সন্ধিপূজা, তান্ত্রিক মতে সম্পন্ন এই পুজোয় দেবী দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পুজোয় পশুবলি দেওয়ার চল আছে। বলি দেওয়া পশুর স্মাংস-রুধি এবং কারণ অর্থাৎ মাংস, রক্ত এবং মদ দেবীর উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়।
বিদায়
নবমীর রাত থেকে শুরু হয়ে যায় দেবী দুর্গার বিদায়ের প্রস্তুতি। সন্ধিপুজা হয় অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে।
বেশ কয়েকবছর ধরে থিম পুজো বেশ প্রচলিত হয়েছে। পুজো মন্ডপ থেকে মায়ের মূর্তিতে নতুনত্ব দেখা যায়।
দুর্গাপুজোর সম্পর্কিত আরো নতুন কিছু অজানা তথ্য: Some more unknown facts about Durga Puja
আদিতে দুর্গাপূজা বসন্তকালে হতো:
বর্তমান সময়ের শরৎকালীন দুর্গাপূজা মূলত রামচন্দ্রের সময় থেকেই প্রচলিত, যাকে “অকাল বোধন” বলা হয়। আসলে দুর্গাপূজা বসন্তকালে উদযাপন করা হতো, যা এখন বসন্তী পূজা নামে পরিচিত। রামচন্দ্র রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে দেবী দুর্গার আগমন কামনায় শরৎকালে পূজার আয়োজন করেন।
একাধিক মূর্তির প্রচলন:
আজকের সময়ের দুর্গাপূজায় যে একত্রে দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, এবং কার্তিকের পূজা করা হয়, সেটি পূর্বে এতটা প্রচলিত ছিল না। এককভাবে দুর্গা পূজার আয়োজন হতো। পরবর্তীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় সময়কালে এই পাঁচটি দেব-দেবীর একত্রে পূজার প্রচলন শুরু হয়।
দুর্গাপূজার প্রথম সামাজিক পূজা:
১৮ শতকের শেষের দিকে, কলকাতায় ইংরেজদের উপস্থিতির সময় বনেদি বাড়ির বাইরের প্রথম সামাজিক বা সার্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করেন ১৭৯০ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা নবকৃষ্ণ দেব। সেই থেকে গণ পূজার প্রচলন শুরু হয়, যা আজকের সময়ের বিশাল আকারের বারোয়ারি পূজায় রূপ নিয়েছে।
বিভিন্ন আঙ্গিকে দেবীর আরাধনা:
দুর্গা পূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চর্চা নয়, এটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসবও। পূজার দিনগুলিতে দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন রূপে পূজা করা হয় যেমন নবপত্রিকা, সিংহবাহিনী ইত্যাদি।
মহিষাসুরের নাম:
পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর শুধুমাত্র একটি মহিষ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী অসুর রাজা, যিনি বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারতেন, এবং মহিষের রূপটি তার একটি বিশেষ রূপ ছিল, যা তিনি দেবতাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করতেন।
পূজা শুরুর নির্দিষ্ট ক্ষণ:
দুর্গা পূজার শুরু হয় দেবীর বোধন বা অমাবস্যার পূজা দিয়ে। অমাবস্যার রাতে পবিত্র বিল্ববৃক্ষের নিচে দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তখন থেকে শুরু হয় পূজার মূল আচার-অনুষ্ঠান।
অন্য রাজ্যে পূজার সময়:
যদিও পশ্চিমবঙ্গের দুর্গা পূজা বিখ্যাত, তবে বিভিন্ন রাজ্যে এই পূজা ভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে দেবী সরস্বতীকে উৎসর্গ করে নবরাত্রি পালিত হয়, আর মহারাষ্ট্রে দেবীকে দুর্গা নয়, সরযূগ্মা হিসেবে পূজা করা হয়।
ধুনুচি নাচের ঐতিহ্য:
ধুনুচি নাচ দুর্গা পূজার অন্যতম জনপ্রিয় আচার। এটি মূলত একটি প্রথা যা দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়। ধুনুচিতে নারকেল ছোবড়া ও ধূপ জ্বালিয়ে হাত বা মুখে নিয়ে নাচ করা হয়। এই নাচ শুধুমাত্র আনন্দ নয়, শারীরিক দক্ষতারও একটি প্রতীক।
দেবী দুর্গার বাহন পরিবর্তন:
প্রতি বছর দুর্গা পূজায় দেবীর আগমন এবং বিদায়ের সময় বাহন পরিবর্তিত হয়। এটি বিভিন্ন বার্তাবাহী হিসেবে ধরা হয়। যেমন, যদি দেবী ঘোড়ায় আসেন, তা যুদ্ধের সংকেত, আর যদি পালকিতে আসেন, তা অনিশ্চিত কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
কৌশিকী দুর্গার পরিচয়:
একটি বিশেষ রূপের নাম কৌশিকী দুর্গা, যা মা দুর্গার একটি রূপ। তিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। দেবী এই রূপটি ধারণ করেছিলেন, যখন তিনি ব্রহ্মার তপস্যার পর একটি অসুরের মোকাবেলায় এসেছিলেন।
দেবী মূর্তির চোখ আঁকা:
দুর্গা প্রতিমার চোখ আঁকা হয় মহাষ্টমীর দিনে, যা ‘চক্ষুদান’ নামে পরিচিত। এটি প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠার একটি অংশ, এবং একে অত্যন্ত পবিত্র আচার হিসেবে ধরা হয়। পটুয়ারা (মূর্তি নির্মাতারা) রাত জেগে দেবীর চোখ আঁকেন এই বিশেষ দিনে।
কুমোরটুলি মূর্তি নির্মাণ:
কলকাতার বিখ্যাত কুমোরটুলি অঞ্চল মূলত মৃৎশিল্পীদের বাসস্থান, যেখানে দুর্গা প্রতিমার শিল্পকলা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। প্রতিমা তৈরির সময় প্রথমে গঙ্গার তীর থেকে মাটি সংগ্রহ করে মূর্তির প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করা হয়। এই মাটির বিশেষ পবিত্রতা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
দেবী দুর্গার মূল প্রতিমা নয় মাটির প্রতিমা:
প্রথমে মা দুর্গার পূজা হতো নিত্যপূজার মাধ্যমে একটি ধাতুর মূর্তি দিয়ে। বর্তমানের মতো মাটির প্রতিমার পূজা শুরু হয় ১৬১০ সালে, যখন রাজা কংসনারায়ণ প্রথমবার তাঁর জমিদার বাড়িতে মাটির দুর্গা মূর্তি তৈরি করেন।
কন্যার সম্মান হিসেবে কুমারী পূজা:
কুমারী পূজা বৈষ্ণবধর্মের একটি প্রচলিত রীতি, যা সাধারণত মহাষ্টমী বা নবমীর দিনে করা হয়। এতে ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী একটি মেয়েকে দেবী দুর্গার রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। এটি শক্তির প্রতীক হিসেবে নারীদের শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে করা হয়।
দেবী মূর্তি তৈরিতে নিষিদ্ধ স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ:
কুমোরটুলির প্রতিমা নির্মাতারা প্রতিমা তৈরির জন্য গঙ্গার পবিত্র মাটি ব্যবহার করেন। তবে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হল, প্রতিমার জন্য ‘পুণ্য মাটি’ আনতে হয় নিষিদ্ধ স্থানের (যেমন, পতিতালয়) সামনের মাটি থেকে। এটি সমাজের সব স্তরের প্রতিনিধিত্ব ও মঙ্গলের জন্য দেবীর পূজায় অন্তর্ভুক্তি হিসেবে দেখা হয়।
দশমীর সিঁদুর খেলা:
বিজয়া দশমীর দিন সিঁদুর খেলা খুবই জনপ্রিয় একটি রীতি। এই আচারটি শুধুমাত্র আনন্দ উদযাপন নয়, এটি নারীদের জন্য দীর্ঘায়ু, সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করাও প্রতিফলিত করে। সিঁদুর হল মঙ্গল এবং শুদ্ধতার প্রতীক।
শক্তি রূপে দেবীর দশ হাত:
দুর্গার দশ হাত তার অসীম ক্ষমতা এবং মহাশক্তির প্রতীক। প্রতিটি হাতে তিনি বিভিন্ন দেবতার প্রদত্ত অস্ত্র ধারণ করেন, যা শক্তি, জ্ঞান, এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গা পূজা:
দুর্গা পূজা শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে এটি বড় আকারে পালিত হয়, যেখানে চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও এলাকায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছিল।
অঞ্চলভেদে দেবীর বাহন ভিন্ন:
দুর্গা পূজায় দেবীর বাহন সাধারণত সিংহ হলেও, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে দেবীর বাহন ভিন্নভাবে চিত্রিত হয়। উত্তর ভারতে দেবীর বাহন কখনও কখনও ঘোড়া বা হাতি হিসেবেও দেখা যায়।
গঙ্গাজলের ব্যবহার:
প্রতিমা গড়ার সময় মাটি ও খড় ব্যবহার করা হয়, তবে প্রতিমা গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো গঙ্গাজল। প্রতিমার আধ্যাত্মিক শক্তি বজায় রাখতে গঙ্গাজল ব্যবহার করা হয়। এটি দেবীর মূর্তিতে পবিত্রতা ও শক্তি আনতে সাহায্য করে।
কুমোরটুলির শিল্পীদের পরিবারে দেবী প্রতিমার পূজা:
যারা মাটির প্রতিমা তৈরি করেন, তারা দুর্গা প্রতিমা তৈরি করার পর দেবীকে প্রথমে নিজেদের পরিবারের মধ্যে পূজা করেন। এটি তাদের পেশাগত সম্মান এবং দেবীর প্রতি তাদের আস্থার প্রতীক হিসেবে করা হয়।
আকাশে দেবীর আগমন ও বিদায়ের বার্তা:
প্রতি বছর দেবীর আগমন ও প্রস্থানের বাহন দেখে পূজার ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। যদি দেবী ঘোড়ায় আগমন করেন, তা দুর্ভিক্ষের সংকেত, হাতিতে আসলে তা বৃষ্টি ও সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
দশমীর সময় ‘দর্পণ বিসর্জন’:
বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আগে দেবীর প্রতিমাকে একটি আয়নায় দেখা হয়, যা ‘দর্পণ বিসর্জন’ নামে পরিচিত। এতে প্রতিমা দেখা হয় আর আয়নায় দেবীর প্রতিবিম্বের মাধ্যমে তাঁকে বিদায় জানানো হয়। এটি একটি আধ্যাত্মিক আচার, যা দেবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
দুর্গা পূজা ও ফসল কাটার সময়ের সম্পর্ক:
দুর্গা পূজার সঙ্গে ফসল কাটার ঋতুরও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীনকালে কৃষকদের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, কারণ এই সময় নতুন ফসল আসত, যা দেবী দুর্গার প্রতি উৎসর্গ করা হতো।
মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর যুদ্ধ:
দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের যুদ্ধ ৯ দিন ধরে চলেছিল বলে কাহিনিতে উল্লেখ আছে, আর সেই কারণেই এই ৯ দিনব্যাপী পূজা হয়। বিজয়া দশমীতে মহিষাসুরকে পরাজিত করে দেবী তার বিজয় নিশ্চিত করেন।
দুর্গা পূজা এবং বিশ্ব ঐতিহ্য:
ইউনেস্কো ২০২১ সালে কলকাতার দুর্গা পূজাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে।
হিন্দু মহাপুরাণের কাহিনী:
দুর্গা পূজার পেছনে মূল কাহিনী মহাভারত ও পুরাণে উল্লেখ আছে, যেখানে মা দুর্গাকে দেবতাদের শক্তির রূপে দেখা হয়। এটি কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক।
ভিনদেশের পূজা:
দুর্গা পূজা শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশ, নেপাল এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশে পালন করা হয়। নেপালে এটি “দুর্গোৎসব” নামে পরিচিত এবং সেখানে বিশেষভাবে ভক্তির সঙ্গে পালন করা হয়।
প্রতিমার রং:
কিছু অঞ্চলে দেবী দুর্গার প্রতিমাকে সাধারণত সাদা বা হালকা রঙে তৈরি করা হয়, যা শুদ্ধতা এবং পবিত্রতার প্রতীক। এই ধরণের প্রতিমা বিশেষ করে বিহারের কিছু এলাকায় দেখা যায়।
মল মাস
শাস্ত্রঅনুযায়ী একই মাসে দু’টো অমাবস্যা হলে তাকে মল মাস বলে। এর আগে ১৯৮২ ও ২০০১ সালে একই কারণে মহালয়ার প্রায় এক মাস পর দুর্গাপুজো হয়েছিল। আবার ২০৩৯ সালে এরকম মলমাসের কারণে মহালয়ার একমাস পরে হবে দুর্গাপুজো।
পরিশেষে :
দুর্গাপূজার অজানা তথ্য আমাদের বর্তমান প্রথাগুলোর সাথে অতীতের সংযোগ বুঝতে সাহায্য করে। এটি দেখায় কিভাবে উৎসবের আচার-অনুষ্ঠানগুলো কালের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন সমাজের প্রেক্ষাপটে কিভাবে এর সমন্বয় ঘটেছে।
এই তথ্যগুলি উৎসবের বহুমাত্রিক দিকগুলি তুলে ধরে। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি সামাজিক বন্ধন, সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন। দুর্গাপূজার অজানা তথ্য থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে এই উৎসবের প্রতিটি স্তরের গভীরে একটি দার্শনিক ও সামাজিক বার্তা লুকিয়ে আছে।
দুর্গাপূজো সম্পর্কিত নানান অজানা তথ্য সম্বলিত আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের মনোগ্রাহী হলে তা অবশ্যই শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না