চুন এর গুণাবলী | স্বাস্থ্যকর চুনাপাথর | Health Benefits of Limestone in Bengali


চুনাপাথর হল এক প্রকার পাললিক শিলা যা প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দ্বারা গঠিত।  রাসায়নিক নাম ক্যালসিয়াম কার্বনেট , রাসায়নিক সূত্র  CACO3, চুনা বা চুনাপাথরের বেশিরভাগ সন্ধান পাওয়া যায় উপকূলীয় অঞ্চলে অথবা সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায়। বিল্ডিং নির্মাণকারী উপাদান হিসাবে চুনাপাথরের ব্যবহার সর্বাধিক হয়ে থাকে আর এটি চুন উৎপাদনের এর ক্ষেত্রে রাসায়নিক শিল্পে একটি জনপ্রিয় উপাদাান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বা জীবিত প্রাণীর সহায়তায় চুনাপাথর গঠিত হয়ে থাকে। ক্যালসাইট এবং আরগোনাইটের মতো খনিজ পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি  হয় এই ক্যালসিয়াম কার্বনেট যৌগ।

chun er gun

চুন এর উপাদান

 চুনাপাথরের প্রধান উপাদান হ’ল মলাস্কস, ফোরামস এবং প্রবালের মতো সামুদ্রিক জীব। এর মধ্যে  সাধারণত সিলিকা, ফেল্ডস্পার, কর্দম, পাইরাইট ও সিডারাইট উপস্থিত থাকে।  অধিকাংশ চুনাপাথরই উচ্চমাত্রায় জীবাশ্মসমৃদ্ধ (fossiliferous) যা  প্রাচীনকালের ঝিনুকরাজি অথবা প্রবাল বলয়ের একত্রীকরণকে  উপস্থাপিত করে থাকে। চুনাপাথরের বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারের কথা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও  উল্লেখ করা আছে। মহর্ষি ভাগবত তাঁর ধর্মগ্রন্থ ‘অষ্টাঙ্গ হৃদয়াম’ এ উল্লেখ করেছিলেন যে চুনাপাথর মানবদেহের  প্রায়  সত্তরটি রোগ নিরাময়ের জন্য  ব্যবহার করা যেতে পারে।  এতে উপস্থিত প্রচুর খনিজসম্পদ  বেশ কিছু চিকিৎসার এ ক্ষেত্রে  লাভজনক হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে  । ক্যালসিয়ামের একটি সর্বোত্তম   উৎস চুনাপাথরের স্বাস্থ্যোপ্রযোগিতা অঢেল।

চুনাপাথরের স্বাস্থ্য উপকারিতা

রাসায়নিক নাম ক্যালসিয়াম কার্বনেট চুনাপাথর   একটি প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পদার্থ  । এর মধ্যে উপস্থিত আরও অনেক খনিজ উপাদান যা প্রতিটি মানবদেহের ভালো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপযোগী । সুপারি পাতা (পান) দিয়ে চুনাপাথর খাওয়ার রীতি ভারতে প্রচলিত। চুনাপাথরের সাথে জড়িত প্রধান স্বাস্থ্য সুবিধাগুলি নীচে আলোচনা করা হয়েছে।

শক্তিশালী হাড়ের জন্য চুনাপাথর

বাড়ন্ত  বাচ্চাদের জন্য পর্যাপ্ত ডায়েটরি ক্যালসিয়াম প্রয়োজনীয় কারণ এটি ভবিষ্যতের হাড়ের কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে। ক্যালসিয়াম হাড় কে সুস্থ ও সুঠাম রাখার জন্য  সর্বাধিক প্রয়োজনীয় একটি খনিজ পদার্থ  । চুনাপাথরে ক্যালসিয়ামের আধিক্য থাকার কারণে  এটি বাচ্চাদের  জন্য আদর্শ বলে মনে করা হয়।

শক্তিশালী হাড়ের জন্য চুনাপাথর

গবেষণায় দেখা গেছে যে বাচ্চাদের খাদ্যতালিকায়   চুনাপাথরের অন্তর্ভুক্তি তাদের হাড়ের উপযুক্ত বিকাশে সহায়তা করতে সক্ষম হয়েছে। যথাযথ পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণের ফলে বাচ্চাদের   ক্যালসিয়াম স্তরগুলি সুদৃঢ় হয়েছে যার ফলে বয়সের সাথে  তারা সঠিক উচ্চতা অর্জন করতে সক্ষম হয়ে থাকে।চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী  চুনাপাথর মিশ্রিত জল, দই বা ডালের সাথে মিশ্রিত খাদ্য  ছোট বাচ্চাদের পক্ষে যথেষ্ট উপকারী বলে মনে করা হয়।

দাঁতগুলির সঠিক গঠনের জন্য

দাঁতের সঠিক গঠনের জন্য  ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। ক্যালসিয়ামের ঘাটতির ফলে  দাঁত এবং মাড়ির সমস্যার জন্ম দেয়। দাঁতকে মজবুতভাবে ধরে রাখার জন্য  শক্তিশালী হাড় সমৃদ্ধ  চোয়ালের  প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আর সুঠাম চোয়ালের জন্য  পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ প্রয়োজন। চুনাপাথর ,  ক্যালসিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস তাই আজকাল বেশিরভাগ টুথপেস্টগুলিতেই এই উপকারী দ্রব্যটি একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে সংযুক্ত করা হয়ে থাকে। এটি মুখের দুর্গন্ধ প্রতিরোধে  ও সহায়তা করে। তাছাড়া চিকিৎসকেরা  টুথপেস্টের সাথে এক চিমটি চুনাপাথর যুক্ত করে দাঁত মাজার পরামর্শ দিয়ে থাকেন স্বাস্থ্যকর দাঁত এবং মাড়ির জন্য।

গাঁটের ব্যাথা জয়েন্ট পেন প্রতিরোধে

আর্থ্রাইটিস এবং অস্টিওপোরোসিসের মতো রোগগুলির একটি প্রধান লক্ষণ হ’ল জয়েন্টগুলির প্রদাহ ও বেদনাদায়ক ফোলাভাব। এই রোগগুলি প্রায়শই শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি এর ঘাটতির কারণে ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্যালসিয়ামের সঠিক মাত্রায়  সরবরাহ ও প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়  চুনাপাথরের অন্তর্ভুক্তি এ জাতীয় রোগগুলি প্রতিরোধ করতে পারে। এটি রোগীদের হাড়ের ভর ঘনত্বে উন্নতি সাধন করে ও প্রদাহ হ্রাস করে। চুনাপাথরের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের উপস্থিতি  জয়েন্টগুলির প্রদাহ হ্রাস করতেও  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।সায়াটিকা বাতের  মতন প্রদাহজনিত রোগের ক্ষেত্রেও চুনাপাথরের উপযোগিতা উপস্থিত।

গর্ভাবস্থায়  চুনাপাথর

ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ চুনাপাথর গর্ভবতী মহিলাদের  ক্ষেত্রে খুব লাভজনক। চুনাপাথরের ক্যালসিয়াম সামগ্রী ভ্রূণের হাড়ের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং  ভ্রূণের  স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির সহায়তা করে থাকে । এছাড়াও, গবেষণায় জানা গেছে যে নিয়মিত খাদ্যে  চুনাপাথর গ্রহণে গর্ভবতী মহিলার প্রসব বেদনা  হ্রাস পেতে পারে এবং স্বাভাবিক প্রসবের পথটিকে সুনিশ্চিত হয়ে থাকে। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য  প্রতিদিন ডালিমের রস এর সাথে এক চিমটি চুনাপাথরের মিশ্রণটি পান করলে খুব উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

স্মৃতিশক্তির জন্য চুনাপাথর

হজমশক্তি বৃদ্ধিতে  চুনাপাথর

ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি মস্তিষ্কে স্নায়ু কোষের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  মানবদেহে  ক্যালসিয়ামের অসামঞ্জস্য মাত্রা   আলঝাইমার রোগের  ঝুঁকির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়ে থাকে যা ব্যক্তির স্মৃতি এবং মস্তিষ্কে কে প্রতিকূলভাবে  প্রভাবিত করে। চুনাপাথর, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় এ জাতীয় পরিস্থিতি রোধ করতে পারে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সক্ষম   হয়ে থাকে। বয়স্ক মানুষ চুনাপাথর গ্রহণ  করলে তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি বিশষ প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা ও পালন করে।

হজমশক্তি বৃদ্ধিতে  চুনাপাথর

ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ চুনাপাথর গ্রহণর পাচন রস উৎপাদনে  বৃদ্ধি ঘটে যা পরিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়ক এবং  হজমের  ক্ষেত্রে খুবই  উপকারী।  গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট হজমের ক্ষেত্রে অ্যাসিড এবং গ্যাস্ট্রিক জুসগুলির ক্ষরণ বাড়িয়ে তোলে।  প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়  চুনাপাথরের অন্তর্ভুক্তি তাই ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা পেটের সমস্যা  এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো পাচনজনিত ব্যাধিগুলি রোধ করতে পারে।

চুনাপাথর যকৃতের ক্রিয়াকলাপেও  উন্নতি সাধন করে  বলে মনে করা হয়। জন্ডিসের মতো লিভার ফাংশন ডিজঅর্ডার বা গুরুতর যকৃতের অসুখ   পরিচর্যার  জন্য  চুনাপাথরের সাথে আখের রসের মিশ্রণ টি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। 

ত্বকের জন্য চুনাপাথর

ত্বকের জন্য চুনাপাথর

তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে ব্রণর হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় । সেই ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে চুনাপাথরের পেস্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি তে উপস্থিত ক্যালসিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডাইজিং উপাদান  ব্রণর চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টগুলি টিস্যুর ক্ষতি রোধ করে এবং ত্বকের বার্ধক্য রোধেও  সহায়তা করে। মধু এবং চুনাপাথরের একটি মিশ্রণ ব্রণর চিকিৎসায় কার্যকরি বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ক্ষত নিরাময়ের জন্য চুনাপাথর

চুনাপাথরে উপস্থিত  অ্যান্টিঅক্সিডাইজিং উপাদানসমূহ ক্ষত নিরাময়ে সহায়ক। এটি একটি এন্টিসেপটিক হিসাবে ও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে  যা কাটা বা পোড়ার চিকিৎসার জন্য একটি দুর্দান্ত প্রতিকার হিসাবে কাজ করে থাকে। এটি ক্ষতগুলির দ্রুত  নিরাময় এবং শুকিয়ে যেতে সহায়তা করে।এই কারণে, ক্ষত নিরাময়ের বিভিন্ন মলমগুলিতে মূল উপাদান হিসাবে চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ;

চুনাপাথর এবং মধুর মিশ্রণ ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে  কার্যকরি নিরাময়ের জন্য ।

শুক্রাণু বৃদ্ধিতে

শুক্রাণুর গঠন কম হলে চুনাপাথরের কার্যকরিতা এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়।  এক গ্লাস আখের রসের সঙ্গে এক চিমটি পরিমাণ চুন মিশিয়ে যদি পান করা যায় তা শুক্রাণু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

পরিশেষে

 ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ চুনাপাথর চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট বা অ্যান্টাসিড হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা চিকিৎসাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । তবে চুনাপাথরের অত্যাধিক ব্যবহার বিপজ্জনক এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সৃষ্টি করে থাকে। অতএব ন্যূনতম নির্ধারিত পরিমাণে চুনাপাথর গ্রহণ মানবদেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে  এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।

FAQ (সম্ভাব্য প্রশ্নাবলি )

চুনাপাথরের রাসায়নিক নাম কী?

ক্যালসিয়াম কার্বনেট  

চুনাপাথরের রাসায়নিক সূত্রটি কী ?

CACO3

কোন খনিজ দ্রব্যটি চুনাপাথরের সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়?

ক্যালসিয়াম

চুনাপাথরের যেকোনো দুটি গুণাবলি উল্লেখ করো।

মজবুত এবং শক্ত হাড়ের জন্য এবং স্মৃতিশক্তির প্রখরতা র জন্য চুনাপাথর প্রভূত উপকারী  

চুনা পাথরের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?

পেটে গ্যাস ,শরীরে ফোলাভাব এবং কিডনির ক্ষতি হতে পারে ।

Recent Posts