কলকাতা ও ট্রাম: এক ঐতিহ্যের কাহিনী


কলকাতা মানেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল,  ময়দান, কফিহাউস,  ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা, রসগোল্লা , এবং ট্রাম। ঐতিহ্যবাহী শহর কলকাতার নাম মনে করলে যা কিছু মনে পড়ে তার মধ্যে অন্যতম ট্রাম। কলকাতা শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে ট্রাম। পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ  সদস্যের মতোই দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতার বুকে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে । 

সূচিপত্র

কলিকাতায় ট্রামের সূত্রপাত

ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয় ১৮৭৩ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি। স্বল্প ব্যয়ে যাতায়াতের জন্য মানুষের সুবিধার্থে লর্ড কার্জন ট্রাম চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

First Tram in Kolkata
পুরানো দিনের ট্রাম

1876 সালে প্রথম আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ২.৪ মাইল যাত্রাপথে ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়েছিল। যা সাত বছর পর ১৮৭০ সালে বন্ধ হয়ে যায় যাত্রী হীনতায়,বাণিজ্যিকভাবে লাভের মুখ না দেখার কারণে এবং সর্বোপরি পরিচালনার অভাবে। প্রথমদিকে অবশ্য ঘোড়ায় টানা ট্রাম এর ব্যবহার ছিল যা ১৯০২ সালে বৈদ্যুতিক করে দেওয়া হয়। 

আজকের দিনে ট্রাম

একবিংশ শতকের শহর কলকাতা যখন ছুটছে সেই সময় একটু একটু করে গন্তব্যে পৌঁছেছে ট্রাম। মেট্রোরেলের যুগে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় অনেকাংশে কমে গেছে ট্রামের যাত্রীসংখ্যা তবুও শহর কলকাতার বুকে ট্রামের ঢং ঢং আওয়াজ ভেসে না এলে শহরটাকে যেন কেমন বিষন্ন দেখাবে, তাই বহু ট্রাম রুট বন্ধ হয়ে গেলও পুরোপুরি ভাবে কলকাতায় বন্ধ হয়নি ট্রাম। শহর কলকাতার রাস্তায় আজও ট্রাম পরিষেবা স্বমহিমায় বিরাজমান।

আজকের এই ট্রামের সঙ্গে প্রথম দিককার ট্রামের বিস্তর ফারাক রয়েছে। স্বামীর বিবর্তন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একদম প্রথমে ব্যবহার হতো ঘোড়ায় টানা ট্রাম। সেই সময় ট্রাম কোম্পানির কাছে ছিল ১৭৭ টি ট্রাম এবং ১০০০ টি ঘোড়া। তারপর স্টিম ইঞ্জিনে চলতো ট্রাম। এরপর ১৯০২ সালে এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়।উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ট্রামের মানচিত্র প্রসারিত হতে থাকে, সেই সময় চেন্নাই, করাচি, দিল্লী, পাটনা, কানপুর প্রভৃতি শহরে ট্রাম চলাচল হলেও একে একে উঠে যায় সেই পরিষেবা। শুধুমাত্র কলকাতায় থেকে যায় ট্রামের ব্যবহার। 

কলকাতার ট্রামরুট গুলি হল – 

  • টালিগঞ্জ – খিদিরপুর
  • বেলগাছিয়া – এসপ্ল্যানেড
  • শ্যামবাজার – এসপ্ল্যানেড
  • শ্যামবাজার – বি.বা.দি.বাগ
  • বিধাননগর – বি.বা.দি. বাগ
  • বেলগাছিয়া – হাওড়া ব্রিজ
  • এসপ্ল্যানেড – গালিক স্ট্রিট
  • রাজাবাজার – বি.বা.দি.বাগ
  • রাজাবাজার – হাওড়া ব্রিজ
  • পার্কাসার্কাস – বিধান নগর
  • বিধান নগর – বি.বা.দি.বাগ
  • বিধান নগর – এসপ্ল্যানেড
  • বিধান নগর – হাওড়া ব্রিজ
  • পার্কসার্কাস – হাওড়া ব্রিজ
  • পার্ক সার্কাস – এসপ্ল্যানেড
  • বেলগাছিয়া – এসপ্ল্যানেড
  • বালিগঞ্জ – এসপ্ল্যানেড
  • টালিগঞ্জ – বালিগঞ্জ
  • গড়িয়াহাট – এসপ্ল্যানেড
  • গড়িয়াহাট – হাওড়া ব্রিজ
  • গড়িয়াহাট- বিধাননগর
  • টালিগঞ্জ – এসপ্ল্যানেড
  • খিদিরপুর – এসপ্ল্যানেড

বর্তমান কলকাতায় পূর্বের তুলনায় অনেক কম সংখ্যক ট্রাম ট্রিপ করে, এখন বর্তমানে প্রায় ৩০ টি ট্রাম ট্রিপ করে কলকাতার রাস্তায় যা আগে এর তুলনায় ছয়গুণ বেশি ছিল। এখন একাধিক ট্রাম লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশ ট্রাম সংস্থা যদিও ময়দান রুটের ট্রাম যা  ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত যায় সেটি একমাত্র লাভজনক ট্রাম রুট। 

ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় ট্রাম
ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় ট্রাম ( কার্টেসি: উইকিপিডিয়া )

ঐতিহাসিক ট্রাম দুর্ঘটনা

কলকাতায় ট্রামের সঙ্গে একটি দুর্ঘটনা কথা বারবার উঠে আসে, কলকাতার ইতিহাসের ট্রাম কেন্দ্রিক দুর্ঘটনার কথা মনে ভাবলেই কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কথা উঠে আসে । যদিও তার মৃত্যুর ঘটনাটি দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে আজও রহস্য বর্তমান।

কলকাতা ট্রাম মিউজিয়াম

২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একটি অভিনব উদ্যোগ নেয় সিটিসি, ওই দিন উদ্বোধন করা হয় স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়ামের। দেড়শ বছরের ট্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরে কলকাতায় কোম্পানি অভিনব মিউজিয়াম তুলেছে যা কলকাতার ঐতিহ্য কে তুলে ধরছে এই ট্রামের মধ্যে।

Horse driven tram in kolkata
ট্রাম মিউজিয়ামে ঘোড়ায় টানা ট্রাম

এটি দেশের একমাত্র ট্রাম মিউজিয়াম, ট্রাম সম্পর্কিত নানা ইতিহাস জানা যায় এখানে। ক্যাফেটেরিয়ার চা, কফির স্বাদ নিতে নিতে জানা যায় পুরনো কলকাতার ট্রামের বিবর্তন থেকে ট্রামটিকিটের বিবর্তনের ইতিহাস।এই ট্রাম মিউজিয়ামের দেওয়ালের শেষ প্রান্তে আছে বিশিষ্ট সাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের ছবি ও তাদের রচিত বিখ্যাত লাইন।

বাঙালির কাছে মায়াবী কলকাতার মাধুর্য উপভোগ করতে এই অপূর্ব ট্রাম মিউজিয়ামটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ কেও এক নিমিষে হারিয়ে দিতে পারে। দুটি কামরার এই মিউজিয়াম বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ১ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মিউজিয়ামের টিকিটের মূল্য মাত্র ১০ টাকা।

এসি ট্রাম এর কথা

kolkata ac trams now
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পুরনো ঐতিহ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম চালু হয়েছে ২০১৮ সালে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো থেকে। যা নোনাপুকুর থেকে ধর্মতলা, ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজারের পথে সারা দিনে ৬ বার চলে।

আগে যা হেরিটেজ ট্যুরের জন্যই সাধারণত ব্যবহার করা হত তা জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য করে দেওয়া হয়,এই ট্রমের গতি ঘন্টায় ৩৫ কিলোমিটার এবং উঠলেই কুড়ি টাকা ভাড়া দিতে হয় যাত্রীদের।

সবশেষে

মেট্রোরেল, ওলা, উবেরের যুগে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম পরিষেবার বিপক্ষে অনেকেই মত প্রকাশ করে থাকে । ধীরগতি ট্রামের বিরুদ্ধে, তাদের মত, যানজটের সৃষ্টি হয় ট্রামের কারণে যা বর্তমান যুগে অনুপযুক্ত এবং এর কোনো আবশ্যকতা নেই এমনটাও অনেকেরই মত।

যদিও একটি ট্রামে বহু মানুষ পরিবহনে সক্ষম, সর্বাধিক ৩০০ যাত্রীর গ্রহণযোগ্যতা থাকে একটি ট্রামে, ট্রামব্যবস্থা বিদ্যুৎ শক্তিতে চলার কারণে দূষণমুক্ত রাখে পরিবেশকে। ফলে এই হালকা যানটির সুবিধাও অনেক।

ঐতিহাসিক ট্রাম
ঐতিহাসিক ট্রাম ( ছবি: পিন্টারেস্ট )

দিনে দিনে কলকাতা যতই এগিয়ে যাক না কেন কলকাতার ঐতিহ্যের ধারক ট্রাম স্বমহিমায় বজায় ছিল, আছে এবং থাকবে। 

Recommended Read,
Modern Trams (Light Rail Transit) for Cities in India
West Bengal Transport Corporation Limited
Kolkata’s Heritage, Eco-Friendly Trams like You Have Never Seen Them
Trams in India – Facts and History

Recent Posts