জামাই ষষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, Detailed information about Jamai Shasthi in Bengali


বাঙালির অন্যতম এক জনপ্রিয় পার্বণ হল জামাইষষ্ঠী। বাড়ির জামাইকে আদর-আপ্যায়ন করার মধ্যে দিয়ে বহু যুগ ধরে এই লোকায়ত প্রথা পালিত হয়ে আসছে। জামাই এবং মেয়ের সুখী দাম্পত্য জীবনের কামনায় তথা মেয়ে যেন সুখে শান্তিতে নিজের সংসারে বাস করতে পারে, সেজন্য এই বিশেষ ব্রত পালন করে থাকেন বাংলার শ্বাশুড়ি- মায়েরা। এই পার্বণে মেয়ের স্বামীর মঙ্গলের সাথে মেয়ের মঙ্গলও যুক্ত করে দেখা হয়। এই কারণেই শ্বাশুড়ি নিজের মেয়ের জামাইকে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন।

জামাই ষষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য

জামাই ষষ্ঠী কোন তিথিতে এবং কবে পালন করা হয়, On which date and when is Jamai Shashti observed?

আদিকাল থেকেই জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠী দেবীর পুজো করার নিয়ম প্রচলিত আছে। ষষ্ঠী দেবীকে সন্তানের দেবী বলে মনে করা হয়। লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মা ষষ্ঠী। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী তাঁর কৃপায় বন্ধ্যার কোলে সন্তান আসে। ঘর অথবা কোনো মন্দিরের বাইরে বট বা করমচার ডাল পুঁতে দিয়ে প্রতীকী অরণ্য রচনা করা হয় এবং সেখানেই এই পুজো করা হয়। তাই এই তিথিটিকে অনেকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলে থাকে। তাছাড়া এই মাসের শ্রেষ্ঠ ফল পাকা আম বলে এই ষষ্ঠী এক ষষ্ঠী নামেও পরিচিত।

জামাই ষষ্ঠী কোন তিথিতে এবং কবে পালন করা হয়

ব্যতিক্রমী বৃহন্নলা, ভারতের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ডাক্তার ~ ড: ভি.এস.প্রিয়া।India’s first transgender Dr Priya

জামাই ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়, Why is Jamai Sasthi observed?

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, প্রাচীন কালে মেয়ের বিবাহ হওয়ার পর তারা সহজে শ্বশুর বাড়ী থেকে নিজের বাপের বাড়িতে আসার অনুমতি পেতেন না। মেয়েকে না-দেখেই বহু বছর কাটিয়ে দিতেন মা-বাবা। তাই জামাই ষষ্ঠী পালন করার মধ্যে দিয়ে প্রতি বছরই মেয়েকে বাড়িতে আনার তথা কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা করেন মায়েরা। সেই উদ্দেশ্যে জামাই ষষ্ঠীর বিশেষ দিনে মেয়ে ও জামাইকে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়। মূলত জামাইয়ের মঙ্গল এবং মেয়ের সুখ কামনা করেই ষষ্ঠী পুজো করা হয়।

ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সামাজিক ব্যবস্থায় একসময় সংস্কার প্রচলিত ছিল যে কন্যা যতদিন পর্যন্ত পুত্রবতী না হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে যেতে পারবেন না ৷ আবার  এই সময় অনেক কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া হত, যার ফলে সন্তানধারণে সমস্যা বা শিশুমৃত্যুর হার বেশি ছিল, ফলে কন্যার পিতা মাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকতে হত কন্যার বাড়ি পদার্পণ করার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে নিজের বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটবে? তাই সমাজের বিধানদাতা বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিকে বেছে নিয়েছিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে৷

জামাই ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়

এই বিশেষ দিনে মেয়ে ও জামাতাকে নিমন্ত্রণ করে এনে সমাদর করা হয় এবং পাশাপাশি কন্যার মুখ দর্শনও করা যাবে৷ আর সেই সঙ্গেই ষষ্ঠী দেবীর পুজো করে তাঁকে তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন আচার বিধান পালন হত যাতে কন্যা শীঘ্রই সন্তানের মুখ দর্শন করতে পারে৷ বর্তমানে যদিও এই পুরনো সংস্কারগুলো পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে — এখন কন্যার পিতা মাতা অথবা যে ব্যক্তিই কন্যা সম্প্রদান করেছেন তিনি প্রথম এক বছর কন্যার বাড়ি যেতে পারবেন না বা যদি যান তাও কন্যার বাড়ির অন্ন গ্রহণ করবেন না। যদিও বর্তমানের আধুনিক শহুরে জীবন যাপনে এই সংস্কার তেমন বিশেষ কোনো গুরুত্ব পায় না৷ তবে সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে ও জামাইকে বাড়িতে ডেকে এনে সমাদর করা এবং সেই সঙ্গে কন্যা যেন সন্তানবতী হয় সেই উদ্দেশ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ পুজো দেওয়ার এই উৎসবের নামকরণ করা হয় ‘জামাইষষ্ঠী’৷

বিপিও বা বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং এর সম্পৰ্কে বিস্তারিত তথ্য, Detailed information on BPO or Business Process Outsourcing in Bengali

জামাই ষষ্ঠী পালন করতে যে যে আচার পালন করা হয় ? Rituals  that are performed to celebrate Jamai Shasthi

জামাই ষষ্ঠীতে জামাইয়ের মঙ্গলের জন্য  শুভ কামনা

আসলে জামাই ষষ্ঠী হচ্ছে একটি লোকায়ত ব্রত। শাশুড়ি মায়েরা ষষ্ঠী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য এই ব্রত পালন করে থাকেন। এই দিন শশুরবাড়িতে জামাইকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাকে আসনে বসিয়ে কপালে চন্দন ও দইয়ের ফোঁটা লাগানোর মাধ্যমে আশীর্বাদ করা হয়। তার পর জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে আবার তেল-হলুদের ফোঁটা লাগানো হয়। এই দিনে দূর্বা, ধান, বাঁশের করুল, করমচা, তালের পাখা, পান ও সুপুরি, সাথে মরশুমি ফল যেমন আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদির বিভিন্ন ব্যবহারের মাধ্যমে শাশুড়ি মায়েরা জামাইকে আশীর্বাদ করেন। ষষ্ঠী পুজো উপলক্ষ্যে জামাতাদের শ্বাশুড়িরা স্নান করে একটি ঘটে জল ভরে নেন এবং সেই ঘটের ওপর আম্রপল্লব স্থাপন করেন। সাথে রাখেন তালপাতার পাখা।

এরপর ১০৮টি দূর্বা আঁটি বেঁধে দিয়ে পূজোর উপকরণ সকল সাজানো হয়। করমচা ফল-সহ পাঁচ বা সাত বা নয় ধরনের ফল কেটে একটি কাঁঠাল পাতার ওপর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয়। তারপর একটি সুতো হলুদে রাঙিয়ে নিয়ে তাতে ফুল ও বেলপাতা দিয়ে গিট বেঁধে সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর দেবী ষষ্ঠীর পুজো করে ব্রতকথা পাঠের পর সবাইকে ঘটের জলের ছিটা ও তাল পাখার ‘বাতাস’ দিয়ে, হাতে ষষ্ঠীর সুতো বেঁধে দিয়ে তবেই উপবাস ভঙ্গ করতে হয় বাড়ির গৃহিণীকে। এইসব নিয়ম ছাড়াও থাকে রকমারি খাবার যা দিয়ে বাড়ির জামাইকে আপ্যায়ন করা হয়।

জামাই ষষ্ঠী পালন করতে যে যে আচার পালন করা হয়

পুজোর আচার অনুসারে ষষ্ঠীর দিনে বাড়িতে আমিষ ভক্ষণ করা নিষিদ্ধ। তবে জামাইষষ্ঠীর কথাই আলাদা। আধুনিক কালে যদিও এত নিয়ম কেউ মেনে চলে না, তবে আগেকার দিনে বাড়ির গৃহিণী যদি ষষ্ঠীব্রতধারিণী হন তবে তিনি ভুলেও আমিষ মুখে তুলতে পারবেন না। কিন্তু জামাতাকে খাতির করতে মাছ মাংস সহ পঞ্চব্যঞ্জনে থাল সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। জামাই- এরও সেক্ষেত্রে অনেক ভাব নিতে হয়। একদম সেজে গুজে আড়ম্বর করে দই মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে জামাতা শ্বশুড় বাড়িতে গিয়ে ওঠে।

জামাইষষ্ঠী

সিটি স্ক্যান ও এমআরআই সম্পর্কীয় যাবতীয় তথ্য, A Detailed information about CT scan and MRI in Bengali

ষষ্ঠী পুজোর ব্রত কাহিনি, The story of Shashti Puja’s vow

প্রচলিত কাহিনি অনুসারে সন্তান-সন্ততির দেবী ষষ্ঠীর বাহন হল বেড়াল। প্রাচীন কাল থেকেই ষষ্ঠী পুজোর ব্রত কাহিনি প্রতি প্রজন্মে সকলেই নিজের দিদা ঠাকুমার কাছে শুনে এসেছি। কাহিনি অনুযায়ী কথিত আছে যে, একটি পরিবারে দুজন বউ ছিলেন। দুই বউয়ের মাঝে ছোট বউটি ছিল খুব লোভী। যেদিন বাড়িতে মাছ বা ভালো কোনো খাবার রান্না করা হত, সে দিন ছোট বউ গিয়ে লুকিয়ে সেগুলো খেয়ে নিত এবং বাড়ির লোক অজান্তেই বেড়ালকে দোষ দিত।

নিজের বাহন বেড়ালের নামে এরূপ অভিযোগ শুনে ষষ্ঠী দেবী খুব ক্ষুব্ধ হন, ফলস্বরূপ সে বাড়ির ছোট বউয়ের সাত জন পুত্র এবং এক কন্যার প্রাণ দেবী কেড়ে নেন। সন্তান হারা হয়ে কষ্টে ভেঙে পড়েন সেই বাড়ির ছোট বউ। এরপরে দেবী ষষ্ঠী একজন বৃদ্ধার রূপ ধারণ করে তাঁর কাছে যান। ছোট বউকে নিজের আচরণের কথা মনে করিয়ে অনুশোচনা বোধ করান দেবী। এর পর নিজের ভুলের জন্য দেবীর কাছে ক্ষমা চাওয়ায় ছোট বউকে এক এক করে তাঁর সমস্ত সন্তানদের ফিরিয়ে দেন ষষ্ঠী। সেই থেকেই ঘরে ঘরে সন্তান-সন্ততির মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে ষষ্ঠী দেবীর পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। এটাই হল জামাইষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী বা আম ষষ্ঠীর ব্রতকথার মূল গল্প৷

ষষ্ঠী পুজোর ব্রত কাহিনি

উপসংহার,  Conclusion

জামাই ষষ্ঠীতে জামাইয়ের মঙ্গলের জন্য যেমন শুভ কামনা করা হয়, তেমনই মেয়ের নিজের সংসারে সুখে-শান্তিতে থাকার জন্য এবং সুস্থ জীবন যাপনের জন্য মা ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা করা হয়। জামাইষষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্যই হল মাতৃত্ব, সন্তান ধারণ, সন্তানের সুস্থতা এবং তাদের বংশবৃদ্ধি।

Recent Posts