বাঙালির প্রাণের শারদীয়া উৎসবের ব্যাপারে জানা অজানা সব তথ্য নিয়ে এসেছি আমরা, পড়ুন এবং সকলের সাথে শেয়ার করুন। মা প্রায় এসেই গেছেন, দুর্গাপূজার আগাম শুভেচ্ছা রইলো সকলের জন্য।

বাঙালির প্রাণের উৎসব
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো হয় দুবার, আশ্বিন মাসে অর্থাৎ শরৎকালে একবার হয় যা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। আবার চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তকালেও এই পুজো হয় যা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। তবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজাই এগিয়ে থাকে।
দুর্গাপূজার ইতিহাস
দুর্গা পূজা প্রথম কবে শুরু হয়েছিল তা না জানা গেলেও দুর্গাপূজার ইতিহাস বহু পূর্বের। হিন্দু পুরাণে দুর্গাপূজার কেন্দ্রিক বিভিন্ন তথ্য আছে যার মধ্যে রাজা সুরথ হারানো রাজ্য ফিরে পেতে বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেন বলে জানা যায়।

আবার কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে ১০৮টি নীল পদ্ম সহযোগে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়াও দেবীভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রভৃতিতেও দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক নানা তথ্যের উল্লেখ আছে।
প্রকৃতি নিজরুপে সেজে ওঠে

দুর্গোৎসবের আগেই প্রকৃতি নিজরুপে সেজে ওঠে, আকাশের রোদের ঝলক, ভোরে শিশির ভেজা ঘাসে শিশিরবিন্দু, ঝড়ে যাওয়া শিউলি ফুল, সারি সারি সাদা কাশফুলে ভরে ওঠে বাংলার মাঠ।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে বাঙালি শারদ উৎসবে মেতে ওঠে। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী পর্যন্ত দেবীর আরাধনা চলে।পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে অমাবস্যায় মহালয়ার পুণ্য তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে।

দেবীপক্ষ
শারদীয়া দুর্গাপূজার পাঁচ দিন হল “ষষ্ঠী”, “মহাসপ্তমী”, “মহাষ্টমী”, “মহানবমী” ও “বিজয়াদশমী”। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। দেবীপক্ষের সূচনা হয় মহালয়ার দিন আর দেবীপক্ষের শেষ হয় দিনে হয় কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন অনেকে হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পুজো করেন।
বিশ্বে প্রতি প্রান্তেই
বিশ্বের প্রায় প্রতিটা প্রান্তেই বাঙ্গালিরা এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে। প্রবাসী বাঙ্গালিরাও দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরা বাংলাদেশেও দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে সরকারি ছুটি থাকে।
বনেদি বাড়ির পূজা – সর্বজনীন পূজা
কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারকেন্দ্রিক যে দুর্গাপূজা তা “বনেদি বাড়ির পূজা” নামে পরিচিত । এই পুজোয় মূলত শাস্ত্র আচারের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়।
আর কোনো একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা মিলে যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তাই হল বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা ।

কলকাতা শহরে সার্বজনীন দুর্গোৎসবের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়।
প্রথম বারোয়ারী দূর্গা পূজার আয়োজন করা হয়েছিল ভবানীপুরে একটি সনাতন গোষ্ঠীর উদ্যোগে।
বোধন
দেবীপক্ষের পুণ্য তিথিতে মহাষষ্ঠীর দিন দেবী দুর্গার বোধন হয়। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তে দেবী দুর্গার পুজো হয় সাড়ম্বরে।
নবপত্রিকা পুজো – নবপত্রিকা

দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার বিশেষ গুরুত্ব আছে। নবপত্রিকা অর্থে নটি গাছের পাতা বোঝালেও পুজোর ক্ষেত্রে নটি গাছের পাতা নয়, নটি উদ্ভিদ হল নবপত্রিকা ।এই নটি উদ্ভিদ হল –
- কদলী বা রম্ভা অর্থাৎ কলা
- অপরাজিতা,
- হরিদ্রা
- জয়ন্তী,
- বিল্ব অর্থাৎ বেল
- দাড়িম্ব,
- অশোক,
- মানকচু,
- ধান

কলাবউ
প্রচলিত ভাষায় কলাবউ নামেই অধিক সমাদৃত নবপত্রিকা।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একসাথে করে তাতে দুটি বেল সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকারে তৈরী করে সিঁদুর দিয়ে দাঁড় করানো হয় দেবীপ্রতিমার ডান দিকে।
নবপত্রিকায় নটি উদ্ভিদ হল দেবী দুর্গার নয়টি রূপের কল্পিত প্রতীক। যা হল রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।
মহাসপ্তমীর দিন সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করানোর পর নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয় কলাবউ।
কুমারী পূজা
সব নারীই যে মায়ের রুপ এই বিশ্বাসে অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা করা হয়।

তন্ত্রশাস্ত্রমতে ষোলো বছরের মধ্যে অরজঃস্বলা কুমারী মেযে়র পূজা হল কুমারী পূজা। দুর্গাপূজার প্রধান অঙ্গ গুলির মধ্যে অন্যতম এই পূজা।
দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজার প্রবর্তন করেন স্বামী বিবেকানন্দ, সালটা ছিল১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর।
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যা
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে পুজো করা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। যেমন এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুইবছরের কন্যা সরস্বতী,তিন বছরের কন্যা ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কন্যা কালিকা, পাঁচ বছরের কন্যা সুভগা, ছ’বছরের কন্যা উমা, সাত বছরের কন্যা মালিনী, আট বছরের কন্যা কুঞ্জিকা, ন’বছরের কন্যা কালসন্দর্ভা, দশ বছরের কন্যা অপরাজিতা, এগারো বছরের কন্যা রুদ্রাণী, বারো বছরের কন্যা ভৈরবী, তেরো বছরের কন্যা মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরের কন্যা পঠিনায়িকা, পনেরো বছরের কন্যা ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোলো বছরের কন্যা অম্বিকা নামে পুজো করা হয়।
সন্ধিপূজা
সন্ধিপূজার আরও একটি বিশেষ অংশ হল সন্ধিপূজা । দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে এই বিশেষ পূজা হয়। ৪৮ মিনিটের এই পুজোয় অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট অর্থাৎ ৪৮ মিনিটের মধ্যে এই পূজা হয়। অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে হওয়ায় এই পূজাকে বলা হয় সন্ধিপূজা, তান্ত্রিক মতে সম্পন্ন এই পুজোয় দেবী দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পুজোয় পশুবলি দেওয়ার চল আছে। বলি দেওয়া পশুর স্মাংস-রুধি এবং কারণ অর্থাৎ মাংস, রক্ত এবং মদ দেবীর উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়।
বিদায়
নবমীর রাত থেকে শুরু হয়ে যায় দেবী দুর্গার বিদায়ের প্রস্তুতি। সন্ধিপুজা হয় অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে।

বেশ কয়েকবছর ধরে থিম পুজো বেশ প্রচলিত হয়েছে। পুজো মন্ডপ থেকে মায়ের মূর্তিতে নতুনত্ব দেখা যায়।
এবছর ২০২০ তে মহালয়ার ৩৫ দিন পর মহাষষ্ঠী
প্রতিবছর মহালয়ার ছ’দিন পরই দেবীর বোধন হলেও এবছর ২০২০ তে মহালয়ার ৩৫ দিন পর মহাষষ্ঠী। পঞ্জিকা অনুযায়ী মহালয়ার এক মাস বাদে এবছর দুর্গাপুজো হওয়ার কারণ হল এবার একইমাসে দুটি অমাবস্যা। সেকারণেই আশ্বিনের জায়গায় কার্তিকে হবে পুজো।
মল মাস
শাস্ত্রঅনুযায়ী একই মাসে দু’টো অমাবস্যা হলে তাকে মল মাস বলে। এর আগে ১৯৮২ ও ২০০১ সালে একই কারণে মহালয়ার প্রায় এক মাস পর দুর্গাপুজো হয়েছিল। আবার ২০৩৯ সালে এরকম মলমাসের কারণে মহালয়ার একমাস পরে হবে দুর্গাপুজো।
