জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবন কাহিনী – Story of Mahatma Gandhi’s Life in Bengali



পরাধীনতার নিরন্ধ্র অন্ধকারে অসহায় নিপীড়িত মানুষের দুঃসময়ে তিনি নিয়ে এলেন মুক্তির বার্তা । দিশেহারা পথভ্রান্ত মানুষকে দীক্ষিত করলেন নবজীবনের মহামন্ত্রে ,ভারতবর্ষের আপামর জনতাকে তিনি জাতীয়তাবাদের প্রবল উন্মাদনায় মাতিয়ে তুললেন ।

সেই নবজাগ্রত জাতির হাতে তিনিই তুলে দিলেন ‘অহিংসা’ নামক অমোঘ এক অস্ত্র ।তিনি আর কেউ নন, তিনি ভারতবাসীর সর্বজনপ্রিয় ,জাতির জনক এবং অন্যতম দেশনায়ক মহাত্মা গান্ধী । তিনি রক্তের বদলে রক্ত চাইলেন না ,আঘাতের প্রত্যুত্তরে প্রত্যাঘাতের কথা কখনো বলেননি ।তাঁর কণ্ঠে ভারতাত্মার শ্বাশ্বত সুরই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল । তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করতে, আত্মত্যাগের মহান ব্রতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে। তাঁর অহিংসা তাই দুর্বলের মুখোশ নয়; নয় ভীরুর হুঙ্কার ।

mahtma gandhiji story

মহাত্মা গান্ধীর জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয়

১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে ভূমিষ্ঠ হন ভবিষ্যৎ ভারতের স্বাধীনতার যজ্ঞের অন্যতম পুরোহিত মহাত্মা গান্ধী যার বাল্য নাম ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী । তার পিতার নাম করমচাঁদ উত্তমচাঁদ গান্ধী এবং মাতা পুতলি বাই । পারিবারিক আদর্শের বেদি মঞ্চেই তাঁর মহৎ জীবনের দীক্ষা। পিতার তেজস্বিতা, সত্যনিষ্ঠা ও বুদ্ধি এবং মাতার ধর্মপ্রাণতা ,ক্ষমা, করুণা সহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানবিক গুণ তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন ।

শিক্ষাজীবন

প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন গান্ধীজি । ব্যারিস্টারি পড়তে গেলেন বিলেতে কুড়ি বছরের নবীন সেই যুবক। আইনের পঠনপাঠনের অবসরে তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেন বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থাদি ।স্বদেশের মাটিতে পা রাখলেন ১৮৯১ সালে ব্যারিস্টারি পাস করে।বম্বে হাইকোর্টে যোগ দিলেন যেখানে ছিল তাঁর কর্মজীবনের প্রথম পদক্ষেপ ।

mahtama gandhi kahani

কর্মজীবনে কৃতিত্ব

বম্বে হাইকোর্টে ওকালতি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পসার জমাতে না পেরে একটি মোকদ্দমা উপলক্ষে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যান । সেসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় এশিয়াবাসী তথা কালো মানুষদের ওপর নানা অত্যাচার হতো।

সেখানে গান্ধীজি অহিংসভাবে শুরু করলেন ‘অহিংস সত্যাগ্রহ’ সংগ্রাম । নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন রুখে ,অনুভব করলেন সশস্ত্র ইংরেজ শক্তির মোকাবিলার জন্য সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা গড়ে তুললেন নাটাল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস । অত্যাচারিত ভারতীয়দের নেতৃত্ব দিলেন নিরস্ত্র গান্ধী ।তিনি প্রহৃত হলেন ,হলেন কারাবন্দি ।তার সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নাটাল সরকার শেষ পর্যন্ত ভারতীয়দের দাবি মেনে নিল। অহিংসার অস্ত্রপ্রয়োগে তিনি সফল হলেন ।

মহাত্মা গান্ধীর জীবনী

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও গান্ধীজি

১৯১৫ সালে বিজয়ীর সম্মান নিয়ে দেশে ফিরলেন গান্ধীজি। সবরমতী নদীর তীরে গড়ে তুললেন এক আদর্শ সেবাপ্রতিষ্ঠান । ১৮৮৫ সালেই ইতিমধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পত্তন হয়েছে। ভারতের নানা প্রান্তে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল।

কংগ্রেসের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়েছিল মুক্তিকামী মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণডংকা বাজতেই অসহায় ইংরেজ ভারতীয়দের সাহায্যপ্রার্থী হল; বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিল যুদ্ধান্তে ভারতীয়দের হাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্পণের কথা। কিন্তু যুদ্ধ শেষে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে ভারতবাসী পেল রাওলাট আইন। ভারতের নেত্রীবৃন্দ ক্ষুব্ধ হলেন । ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেস গান্ধীজির নেতৃত্বে শুরু করল অসহযোগ আন্দোলন ।

ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে গান্ধীজির সংগ্রাম

অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে দেশময় এল নবজাগরণের জোয়ার ।জনসমুদ্র উত্তাল হল। বিক্ষিপ্ত ইংরেজ বিদ্বেষ এবার গণ আন্দোলনের চেহারা নিল। গান্ধীজী এই নবজাগরণের প্রয়োজনীয়তাই গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।

mahatma gandhis struggle india in bengali

তিনি চেয়েছিলেন দেশবাসীকে স্বদেশি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে। গ্রামে গ্রামে মানুষকে সংঘবদ্ধ করার প্রয়োজনেই তিনি খাদি ও চরকা কেন্দ্র স্থাপন করেন । তিনি চেয়েছিলেন নিরস্ত্র উত্তাল জাগ্রত জনশক্তি দিয়ে দুর্ধর্ষ ইংরেজ শক্তিকে প্রচণ্ড আঘাত হানতে। শুরু হলো লবণ সত্যাগ্রহ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাসে যা ‘ডান্ডি অভিযান’ নামে স্মরণীয় হয়ে আছে ।

ভারতের জনমনে সৃষ্টি হলে উত্তাল তরঙ্গ। সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনী ভীত হলো এবং পদ ছেড়ে দিল নিরস্ত্র সংগ্রামের এই সেনা নায়ককে । কিছুদিন পর ইংল্যান্ডে একবার নয় তিন তিনবার বসল গোলটেবিল বৈঠক; উদ্দেশ্য ভারতকে স্বরাজ দেওয়ার সূত্র আবিষ্কার । প্রতিবারই সেখানে ডাক পড়ল গান্ধীজির । ইংরেজদের দুরভিসন্ধিতে প্রতিবারই হতাশ হলেন তিনি।

সভা ত্যাগ করলেন :এবার আরও বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি চলল। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠল । ১৯৪২ সালের ৯ই আগস্ট গান্ধীজি ভারত ছাড় আন্দোলনের ডাক দিলেন, আপামর ভারতবাসীর সামিল হল ।এই সংগ্রামে গান্ধীজি কারাবন্দী হলেন এবং উত্তাল জনতরঙ্গে কেঁপে উঠল ইংরেজ শাসনের ভিত ।

গাঁধীজির জীবনাবসান

১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলমান বিরোধ বাঁধলে গান্ধীজি আপ্রাণ চেষ্টা করলেও দেশত্যাগ ঠেকাতে পারলেন না । ইংরেজ অখন্ড ভারতের মাটিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষের যে বীজ বপন করেছিল কালে কালে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে পরিণত বৃক্ষ আত্মপ্রকাশ করেছিল ।

১৯৪৬ এর নৃশংস সাম্প্রদায়িকতা হল সেই বিষফল ।দেশ দ্বিখণ্ডিত হল ; জন্ম নিল দুই ভূখণ্ড ; ভারত ও পাকিস্তান । কিন্তু গান্ধীজি এই বিভেদ চাননি ;এ আঘাত তিনি সামলাতে পারলেন না । ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারি দিল্লির প্রার্থনা সভায় যাবার সময় নাথুরাম গডসে নামক এক ধর্মান্ধ যুবক গান্ধীজি কে গুলি করে হত্যা করে । আধুনিক ভারতেরই এক উজ্জ্বল তারকা এমনি করেই মানুষের ক্ষমাহীন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলেন ।

উপসংহার

গান্ধীজি ছিলেন সনাতন ভারত ঐতিহ্যের আধুনিক বিগ্রহ যার কাছে অস্পৃশ্যতা ছিল একপ্রকার পাপ । তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সত্য, প্রেম ও অহিংসা । লাঞ্ছিত মানবতার মুক্তিদূত ও স্পর্ধিত রাজশক্তির অনমনীয় প্রতিদ্বন্দ্বী গান্ধীজির ছিল এক বিস্ময়কর সাংগঠনিক প্রতিভা । নবজাগরণের অগ্রদূত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কথা তাই দেশবাসী আজ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ।

FAQ ( গান্ধীজি সম্পর্কিত প্রশ্নাবলি )

গান্ধীজি কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ?

১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে

গান্ধীজির পুরো বা আসল নাম কি ?

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী

গান্ধীজির পিতার নাম কি ?

করমচাঁদ উত্তমচাঁদ গান্ধী

গান্ধীজির মাতার নাম কি ?

পুতলি বাই

কোন পৌরাণিক চরিত্র জীবন চলার পথে গান্ধীজিকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করেছিল ?

হরিশচন্দ্র

কোন দুটি জিনিস গান্ধীজি নিজে তাঁর ফুসফুসের সাথে তুলনা করেছিলেন ?

অহিংসা ও সত্য

গান্ধীজী কার দ্বারা প্রভাবিত হন?

টলস্টয়, রাস্কিন, থোরো, মাৎসিনি, যীশুখ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ

গান্ধীজীর জন্মদিন ২ রা অক্টোবর কোন দিবস হিসাবে পালিত হয় ?

আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস

গান্ধীজীকে জাতির জনক বলে অভিহিত করেন কে ?

সুভাষচন্দ্র বসু

গান্ধীজী প্রথম কোথায় অহিংস আন্দোলন শুরু করেন ?

দক্ষিণ আফ্রিকায় (১৮৯৩)

Related