বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা ১৮৭০ সালের ১৭ নভেম্বর মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার হোগলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ঠাকুরিদাস মাইতি,মাতার নাম ভগবতী দেবী৷ জাতীয় সংগ্রামে নিরলস পরিশ্রম ও ক্লান্তিহীন আত্মদানের জন্যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে আজও লেখা রয়েছে ও থাকবে.
প্রথম জীবন
মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহান এই নেত্রীর অবদান অনস্বীকার্য।অনেক অল্পবয়সে তার বিয়ে হয় ত্রিলোচন হাজরা নামক এক ব্যক্তির সাথে। কিন্তু মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি বিধবা হয়।তার কোনো সন্তান ছিল না।
তিনি সবসময় অপরকে সাহায্য করার সুযোগ পেলে এগিয়ে যেতেন, তাকে সকলে ডাকত ‘ গান্ধীবুড়ি’ বলে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ
১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি, ১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। একাধিক বার জেলে যেতে হয়েছে তাকে তবু তিনি হার মানেন নি।
১৯০৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাতঙ্গিনী হাজরা। মতাদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন গান্ধীবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ।
১৯৩০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে শুরু হয়েছিল লবণ সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলন। সে সময় দেশবাসীর পক্ষে সমুদ্র-জল থেকে লবণ সংগ্রহ করা ছিল বেআইনি, কিন্তু লবণ তৈরীর সুযোগ থাকা সমস্ত জায়গায় সত্যাগ্রহীরা লবণ তৈরি করে আইন-অমান্য করতে লাগলেন। প্রথম লবণ তৈরী শুরু হয়েছিল মেদিনীপুরের কাঁথিতে। খবর পেয়ে পুলিশ গ্রামে ঢুকে সমস্ত ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিল, শুরু হল পুলিশের অত্যাচার।
লবণ আইন অমান্য করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল মাতঙ্গিনী হাজরাকে। যদিও তার প্রতিবাদ দমন করতে পারেনি, তাই অল্প সময় পরেই মুক্তি পাওয়ার পরে কর মকুবের দাবিতে প্রতিবাদ চালিয়ে যান তিনি, যার ফলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
এই সময় তিনি বহরমপুরের কারাগারে ছয় মাস বন্দী ছিলেন, হিজলি বন্দি নিবাসেও বন্দি ছিলেন বেশ কিছুদিন। মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করেন এবং নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড় বানাতেও শুরু করেন।
১৯৩৩ সালে মাতঙ্গিনী হাজরা শ্রীরামপুরে মহকুমা কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের সময় আহত হন। এই বীর মহীয়সী নারী ডান্ডি মার্চ, অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অমর রয়ে গেছেন।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলাদা রূপ পেয়েছিল তখন মেদিনীপুর।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ
১৯৪২ এর ৯ ই আগস্ট অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি বিপুল ভোটাধিক্যে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাশ করে। সেই রাত্রেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়ে আগা খাঁ প্রাসাদ ও আহম্মদ নগর দুর্গে প্রেরিত হন। পরদিন থেকে শুরু হয় ভারতব্যাপী এক বিশাল আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন।
জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কংগ্রেস সদস্যেরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জেলার সকল থানা ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয় দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে ছয় হাজার সমর্থক ও মহিলা স্বেচ্ছাসেবক দের নিয়ে তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল বের করে।
শেষ আন্দোলন ও মৃত্যু
১৯৪২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর, আগস্ট বিপ্লবের জোয়ার তখন মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়েছে। দলবদ্ধ ভাবে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম থানা আক্রমণ করে দখল করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মাতঙ্গিনী স্বেচ্ছাসেবকদের বোঝালেন গাছ কেটে ফেলে, রাস্তা-ঘাট সব বন্ধ করে দিয়ে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বন্ধ করে দিতে হবে। পাঁচদিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে তমলুক থানা এবং একই সঙ্গে সমস্ত সরকারি অফিস দখল করে নিতে হবে।
সেই পূর্ব পরিকল্পনা মতোই ২৯ সেপ্টেম্বর পাঁচটি দিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল তমলুক অধিকার করতে। হাজার হাজার মেদিনীপুর বাসীর সমন্বয়ে জাতীয় পতাকা হাতে এবং ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো- করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে- বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে এগিয়ে চলল শোভাযাত্রা।
মিছিল শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে রাজপুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে এবং নির্দেশ দেয় সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার। সেই আদেশ অমান্য করেন মাতঙ্গিনী হাজরা,এগিয়ে চলেন লক্ষ্য, পুলিশ গুলি চালায় মাতঙ্গিনী হাজরাকে, তা সত্ত্বেও তিনি এগিয়ে চলেন এবং পুলিশের জনতার উপর গুলি না চালাতে নিষেধ করেন।প্রথম বুলেট পায়ে লাগতেই তাঁর হাতের শাঁখটি মাটিতে পড়ে গেল। এরপর দ্বিতীয় বুলেটের আঘাতে বাঁ-হাতটা নুয়ে পড়ল।
বুলেটে বিধ্বস্ত অবস্থাতেও তিনি বলে যান, ‘ব্রিটিশের গোলামি ছেড়ে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করো- তোমরা সব আমাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে হাত মেলাও।’ তার পরে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে তৃতীয় বুলেট। কপালবিদ্ধ সেই বুলেটের আঘাতে তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তবু তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, জাতীয় পতাকাটি তখনও তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা।
১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলতার সাথে নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার স্বদেশের জন্য মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাণদানের দৃষ্টান্তদানের মাধ্যমে মানুষকে বিপ্লবের রাস্তায় উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল,যদিও পরবর্তীকালে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ভেঙে দেওয়া হয় গান্ধীজির অনুরোধে।
উপসংহার
১৯৪৭ সালে ভারত যখন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর স্বাধীনতা অর্জন করল, সেই সময় অসংখ্য স্কুল, পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয়। মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি স্বাধীন ভারতে কলকাতা শহরে প্রথম স্থাপিত নারীমূর্তি। ১৯৭৭ সালে কলকাতার ময়দানে এই মূর্তিটি স্থাপিত হয়। তমলুকে তার মৃত্যুবরণের স্থানেও তার একটি মূর্তি আছে।
ভারতের ডাকবিভাগ মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া পাঁচ টাকার পোস্টাল স্ট্যাম্প চালু করা হয় ২০০২ সালে, ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।
১৮৭০ সালের ১৭ নভেম্বর
মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার হোগলা গ্রামে
ঠাকুরিদাস মাইতি
ভগবতী দেবী
ত্রিলোচন হাজরা
১৯৪২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর