বাংলা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য। তার কলমের ছোঁয়ায় সাহিত্য ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকে যেমন কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, প্রভৃতিকে এক উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উপন্যাসে ও তার লেখনীর জাদু বিরাজমান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বমোট ১৩ টি উপন্যাস লিখেছেন। যার মধ্যে ১২ টি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। তাঁর উপন্যাস গুলি হল –
- ‘করুণা’(১৮৭৭) (গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি)
- ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ (১৮৮৩)
- ‘রাজর্ষি’(১৮৮৭)
- ‘চোখের বালি’ (১৯০৩)
- ‘নৌকাডুবি'(১৯০৬)
- ‘যোগাযোগ'(১৯২৩)
- ‘গোরা'(১৯১০)
- ‘ঘরে বাইরে'(১৯১৬)
- ‘চার অধ্যায়'(১৯৩৪)
- ‘চতুরঙ্গ'(১৯১৬)
- ‘শেষের কবিতা'(১৯২৯)
- ‘দুই বোন’ (১৯৩৩)
- ‘মালঞ্চ'(১৯৩৪)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাসগুলি
করুণা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৭ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। এই উপন্যাসটি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। অল্প বয়সে লেখা হলেও ‘করুণা’ থেকেই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। তার লেখায় কখনো হূবহূ বঙ্কিমী চেতনার অনুসরণ দেখা যায়নি।
বৌ ঠাকুরানীর হাট
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকায়। ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ ঐতিহাসিক উপন্যাস, রাজা প্রতাপাদিত্যর জীবনী অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসে ঐতিহাসিক কাহিনীর পাশাপাশি প্রাধান্য লাভ করেছে অনৈতিহাসিক কাহিনী অংশ। প্রতাপের কন্যা বিভা পুত্র উদয়াদিত্য এবং পিতৃব্য বসন্ত রায়ের কাহিনী অংশও প্রধান হয়ে উঠেছে যা অনৈতিহাসিক কাহিনী। সমকালীন চিন্তাধারা থেকে এগিয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাভাবনা, তার প্রমাণ মেলে প্রতাপাদিত্য চরিত্র চিত্রণে। প্রতাপাদিত্যের আদর্শ নয় বরং চরিত্রের ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি সৌদামিনী দেবী কে উৎসর্গ করা এই উপন্যাসের গল্পাংশ নিয়ে পরবর্তীকালে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকটি লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রাজর্ষি
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব এবং শেষে মানবতার জয় দেখানো হয়েছে। এই উপন্যাসের পটভূমি ত্রিপুরা, রাজা ইন্দ্রনারায়ন এবং পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে বলিদান বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে, হাসির মৃত্যুতে ইন্দ্রনারায়ন বলিদান প্রথা বন্ধ করলেও রাজার বড়ভাই নক্ষত্র রায় পুরোহিত রঘুপতির পক্ষে যোগদান করে, এবং নতুন রাজা হয়। কিন্তু রঘুপতির পালিতপুত্র জয়সিংহের আত্মদানে রঘুপতি নিজের ভুল বুঝতে পারে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিসর্জন’ নাটকটি লেখেন।
চোখের বালি
বাংলা উপন্যাস কে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘চোখের বালি’ উপন্যাস। মহেন্দ্র বিনোদিনীর আকর্ষণ বিকর্ষণ, বিনোদিনীর ব্যক্তিত্ব, বিনোদিনীর বিহারীর প্রতি ভালোবাসা, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসের শুরু থেকে শেষে বিনোদিনী চরিত্রের এক রূপান্তর দেখা গেছে, একদিকে তার প্রলোভন অপরদিকে আত্মনিবেদন দুই দেখা যাচ্ছে এই উপন্যাসে। বিনোদিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং শেষে বিহারীর প্রতি তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, নিষ্ঠা প্রকাশিত হয় যা সেইসময় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে।
রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটির ভূমিকায় বলেছেন – “ সাহিত্যের সাহিত্যের নবপর্যায় পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরা বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস গুলির মধ্যে একটি ‘চোখের বালি’।
নৌকাডুবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। এটি একটি সামাজিক উপন্যাস ১৩১০-১১ বঙ্গাব্দে এই উপন্যাসটি লেখা হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়।
নৌকাডুবির ফলে রমেশ হেমনলিনী ও কমলার জীবনের জটিল অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়।
গোরা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ চেতনার প্রকাশ দেখা যায় ‘গোরা’ উপন্যাসটিতে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের পটভূমি শহর কলকাতা। উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সবচেয়ে দীর্ঘ এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলা যেতে পারে। উপন্যাসের নায়ক গোরা হিন্দু মতাদর্শে আবদ্ধ থাকলেও নিজের আসল পরিচয় অর্থাৎ সে আইরিশ একথা জানার পর তার মানসিকতার রূপান্তর ঘটে এবং তার চিন্তা চেতনা উপলব্ধিতে, দেশপ্রেমে মানবিকতার প্রকাশ ঘটে।
নেপাল মজুমদার ‘ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সংস্কারবাদী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরিত্র যেন রবীন্দ্রনাথের নিজেরই আত্মকাহিনী। গোরার শুরু ধর্মে ও সাম্প্রদায়িকতায়, সমাপ্তি ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষতায়,গোরার শুরু হিন্দু জাতীয়তাবাদে, সমাপ্তি বিশ্বমানবিকতায়।”
যোগাযোগ
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। প্রথমে উপন্যাসটি ‘তিন পুরুষ’ নামে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এই উপন্যাসের নায়িকা কুমুদিনী অভিজাত পরিবারের মেয়ে তার দাদা বিপ্রদাসের শিক্ষায় বড় হয়ে ওঠা কুমুর বিবাহ হয় বিত্তবান মধুসূদন এর সঙ্গে। কিন্তু একসময় সে তার স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় কিন্তু সেই সময় কুমুদিনী জানতে পারে সে সন্তানসম্ভবা। কুমুদিনীর মনো বিশ্লেষণ অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক।
ঘরে বাইরে
চলিত ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। বিমলা,নিখিলেশ, সন্দীপ এই তিনটি চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব -সংঘাত- ক্ষমা- মতাদর্শগত পার্থক্য দেখা গেছে এই উপন্যাসে। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হবার পূর্বে সবুজ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
উপন্যাসের নায়িকা বিমালা তার স্বামীকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করলেও তাকে ভালবাসতে পারেনি বরং আকৃষ্ট হয় রাজনৈতিক নেতা সন্দ্বীপের মোথে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার মোহ মুক্তি ঘটে এবং সে অনুতপ্ত হয়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সংকীর্ণ স্বাদেশিকতা, রাজনীতি, মতাদর্শ প্রভৃতি এই তিনটি চরিত্রের ঘরে এবং বাইরে কিভাবে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে তাই উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
চার অধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে কবিতার অংশই বেশি দেখা যায়, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অতীন এলা। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ কথাসাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন – “বাংলার সন্ত্রাসবাদের রক্তবর্ণ পটভূমিকায় দুটি তরুন-তরুনীর প্রেমের উন্মীলন ও আত্মঘাতী পরিণতি এই হল ‘চার অধ্যায়ের’ বিষয়বস্তু। উপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে জানিয়েছেন চার অধ্যায়ের কবিতার অংশ পাঠক কে ভোলায় এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে।
চতুরঙ্গ
সাধু ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। উপন্যাসটির নাম ‘চতুরঙ্গ’। জ্যাঠামশাই- শচীশ- দামিনী- শ্রীবিলাস এই চারটি চরিত্রের জীবনসত্য অন্বেষণের প্রচেষ্টা এই উপন্যাসের আঙ্গিককে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে। উপন্যাসের প্রকরণেও রয়েছে অভিনবত্ব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। এই উপন্যাসটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বললেও ভুল হবেনা। চতুরঙ্গ উপন্যাসে দামিনী শচীশকে ভালোবাসলেও বিবাহ করে শ্রীবিলাসকে।
শেষের কবিতা
‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস টি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক এবং রোমান্টিক উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশকাল ১৯২৯সাল। শেষের কবিতার নায়ক অমিত রোমান্টিক, সে ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। এই উপন্যাসে প্রেমের পরিণতি একেবারে আলাদা ,অমিত লাবণ্য কে ভালবাসলেও ফিরে যায় কেতকীর কাছে। আবার লাবণ্য অমিতকে ভালবাসলেও শোভনলাল এর সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম সম্পর্কিত চিন্তাধারার এক অভিনব প্রকাশ দেখা যায় উপন্যাসটিতে ,যেখানে অমিত উপলব্ধি করেছে “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধে ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্য সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইলো দীঘি, সে ঘরে আনবার নয় আমার মন তাতে সাতাঁর দেবে।”এই উপন্যাসের কাব্যময় ভাষা পাঠককে মুগ্ধ করে।
দুই বোন
‘দুই বোন’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। উপন্যাসটিতে শশাঙ্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত দুই বোন শর্মিলা এবং উর্মিমালার জীবন।
খাপছাড়া এই কাহিনীতে শশাঙ্কর সাথে তার শ্যালিকার প্রণয়ে তাদের বিবেকের পিছুটান নেই, অপরদিকে শশাঙ্কর স্ত্রী শর্মিলা আত্মদান চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
Buy Now ( English )
মালঞ্চ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসটি একটি বিয়োগান্তক উপন্যাস। শেষ জীবনের লেখা এই উপন্যাসটি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গল্পের নায়ক আদিত্য কে কেন্দ্র করে নীরজা ও সরলার প্রণয় দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে। নীরজার ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব, পরাজয় এবং ট্র্যাজিক দীর্ঘশ্বাস দেখা যায় এই উপন্যাসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কোন উপন্যাসটি আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে ? আমাদের ফেইসবুক পেজ এ মেসেজ করে জানান ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীসমগ্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত উক্তি কালেকশন