হঠাৎ করেই বনের পাখিদের মধ্যে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেলো। একটি বাজপাখি এই গন্ডগোলের কারণ। এটি যেন পাখি নয়, যেন রাক্ষস! সারাদিন শুধু খাই খাই। হাঁস খাবে, মুরগি খাবে, চড়ুই খাবে, টিয়া খাবে- খেতে বাজ পাখিটির কোন ক্লান্তি নেই। কিছুতেই পেট ভরে না ওর।
বাজপাখিটির সকালের নাস্তায় ছোট-বড় মিলে দশ থেকে বারোটি পাখি লাগে। দুপুরের খাবারের জন্য পনের থেকে বিশটি, আর রাতে এর কম হলে চলে না। এ ছাড়াও সারাদিন সময়-সুযোগ পেলেই টিয়া, ময়না, চড়ুই, টুনটুনি আর বুলবুলি মিলে আট থেকে দশটি পাখি শিকার না করলে মনে হয় সারাদিন কিছুই খায়নি ও।
এভাবে প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশটি পাখি বাজপাখিটির পেটে যায়। এতে বন থেকে পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যেতে লাগলো। অনেক পাখি আবার ভয়ে অন্য বনে গিয়ে আশ্রয় নিলো। বনে অলস দুপুরে আগের মতো আর ঘুঘু ডাকে না, দোয়েল গান গায় না, কোকিল কুহু কুহু করে বসন্তের বার্তা শোনায় না। শ্যামা, ফিঙ্গেরা নাচ ভুলে গেছে। গোটা বন জুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
রাক্ষস বাজপাখিটির অত্যাচারে সবচেয়ে ছোট পাখিগুলোর বিপদ বেশি। ওরা সহজেই বাজপাখিটির শিকারে পরিণত হয়। এতে বড় পাখিদের সমস্যাও কম হয়নি। বিশেষ করে চিলের অবস্থা খুবই খারাপ। এতোদিন ওরা ছোট ছোট পাখি, ইঁদুর শিকার করে খেতো। এখন বাজপাখিটির অত্যাচারে ওদের ভাগ্যে আর শিকার মেলে না। না খেয়ে থাকতে হয় ওদের।
বাজপাখিটির অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে বনের পাখিরা একদিন মিটিং করার দিনক্ষণ ঠিক করলো। কথাটা বাজপাখির কানে গেলে রেগে গেলো বাজপাখি। সারা বন ঘুরে প্রচার করলো মিটিং করতে হলে ওর অনুমতি লাগবে। আর যদি অনুমতি ছাড়া মিটিং করা হয়, তাহলে যারা মিটিং যাবে, তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
বিষয়টি নিয়ে চিহ্নিত হয়ে পড়লো সব পাখি। ঘুঘু, টিয়া, ময়না, হলুদ পাখি, কাঠঠোকরা বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করার চিন্তা করলো। একদিন গোপনে ওরা আলোচনায় বসলো।
ঘুঘু বলল, ‘বিষয়টি নিয়ে পেঁচার সঙ্গে আলাপ করলে কেমন হয়?’
টিয়া বলল, ‘আর দূর পেঁচার আবার বুদ্ধি! ওকে দিয়ে কিছুই হবে না।’
হলুদ পাখি বলল, ‘তাহলে চিলের সঙ্গে বুদ্ধি করা যেতে পারে।’
টুনটুনি বলল, ‘চিল আমাদের চিরশত্রু। ওর কাছেও যাওয়া যাবে না। যাকেই পাবে, তাকেই গিলে খাবে।’
তাহলে কী করা যায়? এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো সবাই। একটি দাঁড়কাক দূরে দাঁড়িয়েছিল। আস্তে আস্তে কাকটি ওদের কাছে এগিয়ে আসলো। ওকে আসতে দেখে সবাই উড়ে চলে যেতে লাগলো। দাঁড়কাকটি বলল, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি। এ ব্যাপারে আমি একটি কথা বলতে চাই।’
দাঁড়কাকের কথা শুনে পাখিগুলো একটু থামলো। দূর থেকে ময়না বলল, ‘তুমি কাছে না এসে দূর থেকে বলো কী বলতে চাও।’
দাঁড়কাক দুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা আমাকে যদি ভয় পাও তো দূরেই থাকলাম। তবে আমার কথা মন দিয়ে শোন। কাজে লাগবে।’
টুনটুনি বলল, ‘কী বুদ্ধি দেবে তুমি! তুমিওতো সুযোগ পেলেই আমাদের মেরে খেয়ে ফেলো।’
হলুদ পাখি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আহ থামো তো! আগে শুনি না, কী বলতে চায় দাঁড়কাক।’
টুনটুনি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে দাঁড়কাক, তোমার কী বুদ্ধি বলো। আমরা কীভাবে রেহাই পেতে পারি পাজি বাজপাখিটার হাত থেকে?’
দাঁড়কাকটি বলল, ‘আমার কোন বুদ্ধি নেই। তবে পাতিকাক আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। ওকে নিয়ে একটা পরামর্শ করো তোমরা।’
দাঁড়কাকের কথা পছন্দ হলো সবার। কিন্তু সমস্যা হলো পাখিদের মিটিং করা নিয়ে। মিটিংয়ের কথা বাজপাখি যদি জানতে পারে তাহলে কেউ আর রেহাই পাবে না। এ ব্যাপারে পাতিকাকের সঙ্গে আলাপ করা হলো। পাতিকাক বলল, ‘আমি বুদ্ধি করে বাজপাখিটিকে কয়েক দিনের জন্য বনের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। তখন সবাই মিলে মিটিং করা যাবে।’
দোয়েল বলল, সত্যি পারবে বাজপাখিটাকে বনের বাইরে পাঠিয়ে দিতে?
ময়না বলল, পারবে তো?’
পাতিকাক একটু মুচকি হাসলো। তারপর ঠোঁট দিয়ে ডানা খুঁটে গা ঝারা দিয়ে পরিপাটি হয়ে বলল, ‘তোমরা আমাকে কী মনে করো অ্যাঁ! সবাই আমাকে বেশি বুদ্ধিমান বলে কি এমনি এমনি! মানুষ অবশ্য আমার সঙ্গে একটু রসিকতা করে। ওরা বলে, ‘কাকের বুদ্ধি বেশি খায়….’। থাক- থাক, ওটা আর নাই বললাম।
টুনটুনি কাকের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠলো। ওকে ধমকে দিলো বাবুই। টুনটুনি বাবুই পাখির ধমকে রেগে গেলো। ঝগড়াঝাটি শুরু করে দিলো দু’জনে।
শ্যামা এতোক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। পেয়ারা গাছটার উঁচু ডালটা থেকে নাচতে নাচতে একেবারে মাটিতে এসে পড়লো। বলল, ‘টুনটুনি, বাবুই তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া থামাও। নিজেরা যদি ঝগড়া করো তো বাজপাখিটাকে কিছুতেই শায়েস্তা করতে পারবে না।’
সবাই শ্যামার কথায় সম্মৃতি দিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছো শ্যামা। এখন আমাদেও ঝগড়াঝাটি করার সময় নয়।’
পাতিকাক বলল, ‘তাহলে আমি এখন বাজপাখির কাছে যাই। কী বলো?’
ধ্যানী পাখির মাছরাঙার ধ্যান যেন ভাঙলো এতোক্ষণে। বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ালো মাছরাঙ্গা পাখি। বলল, দেরি করছো কেন? কোন কাজই ফেলে রাখতে নেই। যা করার দ্রুত করা উচিত।
দেরী না করে পাতিকাক চলে গেলো বাজ পার্খির কাছে।
একটা কড়ই গাছের মগডালে বসে ঝিমুচ্ছিল বাজপাখিটি। পাতিকাক হঠাৎ গিয়ে ওর পাশে বসতেই বাজপাখিটি ক্ষেপে গেলো। বলল, ‘তুই আবার বিরক্ত করতে আসলি কেন? যা, যা, দূরে সরে বস।’
পাতিকাক বলল, ‘কেন দূরে বসবো কেন?’
বাজ পাখি মুখ বাঁকা করে বলল, ‘দূরে কেন বসবি তাও জানো না! তুই তো দুনিয়ার সব পচা খাবার খাস। তোর গা থেকে গন্ধ আসে। তোর গায়ের গন্ধ পেলে আমার বমি আসে। ওয়াক-ওয়াক।’
বাজপাখিটি সত্যিই বমি করে দিলো।
বাজপাখি বমি করা দেখে খুশি হলো পাতিকাক।
বাজপাখি বলল, ‘দিলি তো আবার আমার ক্ষুধা লাগিয়ে। এখন কি খাই? তোকেও তো খাওয়া যাবে না। ইস কি বিচ্ছিরি গন্ধ তোর গায়ে!’
পাতিকাক মুখ কালো করে বলল, ‘খাবারের কথা পরে চিন্তা করো বাজপাখি ভাই। তোমার জন্য একটা খারাপ খবর আছে।’
খারাপ খবরের কথা শুনে আঁৎকে উঠলো বাজপাখি। বল না কী এমন খারাপ খবর?’
পাতিকাক বলল, ‘তুমি তো বাড়ির সবাইকে অন্য বনে রেখে এই বনে এসেছো শিকারের জন্য। তুমি কি জানো তোমার বুড়ো মা না খেয়ে অসুখ বাধিয়ে বসেছেন। মনে হয় বাঁচবেই না!’
বাজপাখি বলল, ‘কী বলছিস তুই! সত্যিই মা খুব অসুস্থ? কার কাছে খবর পেলি?’
কাক বলল, ‘কার কাছে আবার? আমার মামা বাড়ি তো তোমাদের বনে। কালই তো আমি তোমাদের ওখান থেকে এসেছি। নিজের চোখে দেখে এসেছি, তোমার মা অসুস্থ।
বাজপাখি কান্না শুরু কওে দিলো। ‘হায় হায় কী বলছিস তুই! মা বাঁচবো তো!’
পাতিকাক বলর, ‘কি জানি। নাও বাঁচতে পারেন। বুড়ো মানুষ। বয়স হয়েছে তো!’
তাহলে এখনই যাই। কি বলো? কিন্তু কীভাবে এতোটা পথ যাবো। পেটে দারুণ ক্ষুধা। এখন যে শিকার ধরবো তারও উপায় নেই।’
কাক বলল, ‘আমাকেই না হয় খেয়ে নাও। আমি তো তোমার সামনেই আছি।’
বাজপাখি ধমক দিয়ে বলল, ‘থাম তো তুই! তোকে খাবো আমি? না খেয়ে মরে গেলেও না। তোর গায়ে যা গন্ধ। ওয়াক।’
পাতিকাক বলল।‘তাহলে কী আর করবা, না খেয়েই যাও। দেখো মাকে শেষ দেখা দেখতে পারো কিনা।’
বাজপাখি ধমক দিলো পাতিকাককে। বলল, ‘আমি এখুনি যাচ্ছি। চার-পাঁচদিন আসতে পারবো না। মায়ের কাছে থাকবো। তাহলে এখুনি যাই, কী বলো?’
‘যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।’ পাতিকাক বলল।
বাজপাখি উড়ে চলে গেলো ওর অসুস্থ মাকে দেখতো। পাতিকাক আর দেরি না করে সবাইকে বাজপাখির চলে যাওয়ার কথা জানালো। বিকেলে সব পাখিরা মিটিংয়ে বসলো। মিটিংয়ে পাখিরা মিলে স্লোগান দিলো, ‘বাজপাখি নিপাত যাক/ পাখিরা সব রক্ষা পাক’।
মিটিংয়ে অনেক পাখিই বক্তৃতা করলো। কিন্তু কীভাবে বাজপাখিকে শায়েস্তা করা যায় তা বলতে পারলো না কেউ। চিল অনেক দূর থেকে ওদের কথা শুনছিল। কিন্তু কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। দূর থেকে বলল, ‘আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে?’
সবাই ভয়ে পেয়ে গেলো। কাঠঠোকরা বলল ‘পালাও, পালাও, চিল এসেছে।’
পাতিকাক বলল, ‘কেউ পালাবে না। একা চিল আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমরা সবাই যদি একত্রে থাকি, কেউ আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখো তোমরা, একতাই বল।’
পাতিকাকের কথায় সবাই আশ্বস্ত হলো। এবার চিলকে পাতিকাক বলল, তুমি কাছে এসে তোমার কী বুদ্ধি আছে বলো। মনে রাখবা, চালাকি করার চেষ্টা করলে সবাই মিলে তোমাকে খতম করতে সময় লাগবে না।’
চিল বলল, ‘না ভাই, আমাকে তোমারা বিশ্বাস করতে পারো। তোমাদের বিপদ আর আমার বিপদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই দেখো না, কাল আমার দু’টি ছানা ওই বাজপাখি খেয়ে ফেলেছে। আমিও খুব ভয়ে ভয়ে আছি। কখন জানি আমাকেও খেয়ে ফেলে ওই বদমাশ পাখিটা।
মাছ রাঙা বলল, ‘ঠিক আছে, তোমাকে বিশ্বাস করলাম। এবার বল কি বলতে চাও?’
চিল বলর, ‘দেখো বাজপাখিটা খুব বড়। ওর গায়ে শক্তিও অনেক বেশি। ওর সঙ্গে শক্তিতে পারবো না আমরা। কিন্তু বুদ্ধিতে তো পারবো। একটা কথা তো আমরা সবাই জানি, গায়ের শক্তির চেয়ে বুদ্ধির শক্তি অনেক বেশি।’
সবাই চিলের কথায় সায় দিলো। কিন্তু বুদ্ধিটা কী? কীভাবে বাজপাখিটাকে খতম করা যায়? চিন্তা করতে লাগলো সবাই।
চিল বলল, ‘একটা জাল তৈরি করতে হবে। আর সে জালটা ওই কড়ই গাছটার ওপর পেতে রাখতে হবে। বাজপাখি ফিরে এসে যখনই ওই গাছে বসবে আমরা জালের রশি ছেড়ে দেবো। জালে জড়িয়ে গেলো ওকে সবাই মিলে একসঙ্গে আক্রমণ করে মেলে ফেলবো।’
সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। বাহবা দিলো চিলকে।
ময়না বলল, জাল তৈরি করবে কে?’
বাবুই বলল, ‘আরে দূর এটা একটা কাজ হলো! সুতা এনে দাও। একদিনের মধ্যে আমি জাল তৈরি করে দেবে।’
পাতিকাক বলল, ‘আজকের মধ্যেই তোমাকে সুতা এনে দিচ্ছি। কালকের মধ্যে তুমি জাল তৈরি করতে পারবো তো?’
বাবুই বলল, ‘পারবো। পারতেই হবে।’
আর দেরি নয়। সবাই কাজে লেগে গেলো। কাক তাঁতি বাড়ি থেকে সুতা নিয়ে এলো। অনেকগুলো বাবুই মিলে একদিনের মধ্যে বিরাট একটি জাল তৈরি করে ফেললো। তারপর হাজার হাজার পাখি সেই জালটাকে কড়ই গাছের মাথায় পেতে রাখলো।
জাল পাতা হলে সবই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে বাজপাখির ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকলো।
চারদিন পর ক্লান্ত বাজপাখি যেই কড়ই গাছের ডালে বসেছে অমনি সবাই জালের রশি ছেড়ে দিলো। জাল পড়লো বাজপাখির মাথায়। মুহূর্তে জালে জড়িয়ে গেলো বাজপাখিটা।
বাজপাখি অনেক আকুতি-মিনতি করলো। সারস বলল, ‘দুষ্টু পাখির মিষ্টি কথায় ভুলতে নেই। এসো সবাই মিলে একে খতম করে দেই।’
সারস পাখির কথা শেষ না হতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো বাজপাখিটার ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাজপাখিটি মারা গেলে সবই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বনে আবার শান্তি ফিরে এলো।