‘মেলা’ কথাটির সাথে সকলেরই কম বেশি পরিচিতি রয়েছে। মেলা বলতে একটি বিশেষ উপলক্ষের উপর ভিত্তি করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই স্থানে বহু মানুষের সমাগমকে বোঝায়। সভ্যতার আদিকাল থেকেই মেলা চিরাচরিত সমাজ জীবনের বিশেষ অঙ্গ রূপে আয়োজিত হয়ে আসছে। সভ্যতার ঐতিহ্যকে বহু শতক ধরে বহন করে আসছে বিভিন্ন মেলা প্রাঙ্গণ।
আগেকার সময়ে গ্রামে গঞ্জে আয়োজিত হতো মেলা, তবে বর্তমান সময়ে মেলাগুলো শুধু গ্রামীণ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই, বরং শহরের বেশ কিছু অংশেও এখন বিশেষ উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এমনই একটি মেলা অনুষ্ঠিত হয় বই প্রেমিকদের জন্য। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তাদের কাছে এক বিশেষ উৎসব হল বইমেলা।
পাশাপাশি শিশু এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মনে বই এর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করার এক অন্যতম ক্ষেত্র হল বইমেলা, যেখানে নানা ধরনের বই ক্রেতাদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়, বিভিন্ন অঞ্চলের বহু বই এই মেলায় প্রকাশ করা হয়, যা পাঠকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
বইমেলার ঐতিহ্য, Traditions of book fairs
বর্তমান যুগে মেলার ব্যাপ্তি তার স্বাভাবিক তথা চিরাচরিত গন্ডি পেরিয়ে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে অভিজাত মাত্রা অর্জন করেছে, আর বইমেলা হল গ্রন্থ পিপাসু জনগণের কাছে সবচেয়ে পছন্দের একটি উৎসব। এক কথায় বইমেলা হল একটি স্বতন্ত্র প্রকৃতির মেলা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সারা বছরে একাধিকবার বই মেলা বা গ্রন্থ মেলা আয়োজিত হয়ে থাকে। বই ছাড়া জ্ঞান পিপাসু জনগণের জীবনকে একপ্রকার অচল বলা চলে। মানুষের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান হল বই বা গ্রন্থ সমূহ।
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali
বিশ্বের প্রথম বইমেলা, The world’s first book fair
বিশ্বের প্রথম বইমেলাটি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে পঞ্চদশ শতকে অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত মেঞ্জ শহরে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন । তাঁর আবিষ্কার করা ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে এসেছিল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ছাপাখানার যন্ত্রাংশকে এবং ছাপানো বইগুলো বিক্রি করার জন্য তিনি ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন।
গুটেনবার্গের মত ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় বই বিক্রেতারাও বই নিয়ে বেচতে বসে আর তা কিনতে বিভিন্ন জায়গার মানুষও আসতে শুরু করে। সেই থেকেই জমে ওঠে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা নিজের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পায় এবং ১৯৪৯ সালে উক্ত মেলাকে ‘জার্মান প্রকাশক সমিতি’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
পণপ্রথা একটি জাতীয় সমস্যা, Best essay on the Dowry System in Bengali
বই মেলার উপযোগিতা, Benefits of book fairs
বই সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন-
“আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্যে আমি বইয়ের কাছে ঋণী।”
একটি বই মেলা প্রযোজনার পেছনে প্রধানত তিন শ্রেণীর মানুষ থাকে, যারা সম্মিলিতভাবে মেলাটিকে আকর্ষণীয় এবং জ্ঞান সমৃদ্ধির যোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তোলেন।
● বইমেলার উদ্যোক্তা – মেলার পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অপরিহার্য।
● বইয়ের প্রকাশক সংস্থা – বিভিন্ন বইয়ের সম্ভার নিয়ে মেলায় হাজির হয়ে তারা সাজিয়ে তোলেন মেলাপ্রঙ্গণ।
● দর্শক – সময় বিশেষে বিভিন্ন বইয়ের ক্রেতাদের ভূমিকাও অস্বীকার করার মত নয়, কারণ তাদের মাধ্যমেই প্রকাশক সংস্থাগুলো স্বার্থকতা লাভ করে।
বইমেলার উদ্যোক্তাগণ, প্রকাশক সংস্থা এবং দর্শকদের সমন্বয়েই বই মেলা সার্থকতা পায়।
বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত, Best detailed information about Global Warming in Bengali
বইমেলার উদ্দেশ্য, Purpose of the book fair
বই পড়লে আমাদের মন ও জ্ঞানের আকাশের পরিধি আরও বড় হয়। এতে সমাজেরও মঙ্গল হয়, কারণ আমাদের সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষার মূল্যবোধ এবং মানুষের নৈতিকতার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, মানুষের মনের তুচ্ছতা ও সংকীর্ণতাকে সরিয়ে তাকে এক উন্নত এবং উচ্চতর ভাবলোকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা রয়েছে।
মানুষ আরো বেশি গ্রন্থ প্রেমিক হয়ে উঠলে, বইমেলায় গিয়ে নানা ধরনের বই দেখে, সেগুলো নাড়া চাড়া করলে জ্ঞানের প্রতি তাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে; আর এইভাবেই নানাবিধ বইয়ের সাথে গড়ে উঠবে তাদের সখ্যতা। এটাই হল বইমেলার মূল উদ্দেশ্য। সাধারণত কর্মমুখী মানুষজন বই কেনার সময় পান না, কিন্তু মেলার আকর্ষণে তারাও ছুটে আসেন নিজের পরিবার তথা ছেলে মেয়েদের নিয়ে।
ছেলে-মেয়েরাও মেলার আনন্দের ফাঁকে বেশ কিছু নতুন বই এর সঙ্গে পরিচিত হয়। এভাবেই মেলার আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
জাতীয় সংহতি, Best composition on National Integration in Bengali
সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় বইমেলার ভূমিকা, The role of book fairs in preserving cultural continuity
বইয়ের প্রাধান্য বর্ণনায় পারস্য কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন-
“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্তযৌবনা।”
পুরাতন সময়ের উপর যদি নতুন কালের অধিষ্ঠান না হয় তবেই সভ্যতার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হতে দেখা যায়, আর এই ধারাবাহিকতা বাধাপ্রাপ্ত হলে সমাজ তথা ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বই আমাদেরকে সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। পুরনো কালের চিরন্তন সত্যগুলোর সংরক্ষণ এবং অসত্যগুলো বর্জন করার মাধ্যমে বই–ই জীবনের সঠিক পথ নির্দেশ করে। আগেকার সময়ের বিভিন্ন প্রকার আচার-আচরণ ও সংস্কারগুলো বর্তমান যুগের সাথে সংগতিসূচক নয়, আর এসব কিছু সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।
বই পড়ার মাধ্যমে আমরা সেই সকল আচরণ এর স্বরূপ উদঘাটন করার পাশাপাশি সেগুলোকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার শিক্ষা পাই। যুগে যুগে পৃথিবীতে বিভিন্ন সভ্যতা যেভাবে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে, সেইসব সত্য বইয়ের পাতা থেকেই আমরা জানতে পারি। এজন্যই বলা হয় যে, বই আমাদেরকে নিজের মানবিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করার শিক্ষা দেয়।
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali
বইমেলায় পারস্পরিক ভাব বিনিময়, Exchange of ideas at the book fair
মেলা মানেই হল ভিন্ন মানুষের মিলনস্থল, প্রতিদিনের একঘেয়েমি ভরা ব্যস্ত জীবনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দূরে সরিয়ে দিয়ে মেলা মানুষের মনে আনন্দ ও প্রশান্তি এনে দেয়।
বইমেলা এমন এক উন্মুক্ত পরিবেশ যেখানে আসা মানুষজন একে অপরের সাথে আলাপ আলোচনা করে এক নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন। তাছাড়া কথোপকথনের মাধ্যমে প্রকাশকরাও ক্রেতার চাহিদা সহজে বুঝে নিতে পারেন।
দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মী সহ সর্বস্তরের মানুষজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। পাঠকরা অনেক সময় নিজের প্রিয় লেখকদের সাথে দেখা করার বা পরিচিত হওয়ার সুযোগও বইমেলায় পেয়ে থাকে। তাই পাঠকের সঙ্গে লেখকদের মিলন ঘটার একটি সহজ মাধ্যম হল বইমেলা।
জীবনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির মার্গদর্শক হিসেবে বইমেলা, Book fair as a guide to the right view of life
বই হল আমাদের পরম বন্ধু, কারণ আমাদের সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের মার্গে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শিক্ষা আমরা বই থেকেই পেয়ে থাকি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিজের পথ নির্দেশক হিসেবে পেয়েছিলেন বিভিন্ন বই এবং গ্রন্থকে। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকবি তথা কবিগুরু।
এই রকম আরো শত সহস্র উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে এটা প্রমাণিত হয় যে হিতৈষী ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আগ্রহ পেয়েছিলেন বই পড়ার মধ্য দিয়েই এবং বিভিন্ন বই পড়ার মাধ্যমেই তারা নিজে জীবনের প্রতি এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন। বইগুলো আমাদেরকে এক রহস্যময় পথের সংযোগস্থলে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, আর আমাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত প্রবণতা সেই সংযোগস্থলে এসেই সঠিক পথ খুঁজে পায়।
শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা, Know about Contribution of library in education in Bengali
বইমেলার মাধ্যমে গণচেতনা বিস্তার, Spreading public awareness through book fairs
টিভি, রেডিও, খবরের কাগজ প্রভৃতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের মত বইও গণচেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি সঠিক বই পাঠকের মনে বিপ্লব ঘটাতে পারে। বিভিন্ন বই পড়লে মানুষের মধ্যে সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধের উন্মেষ ঘটে, সামাজিক বোধ সৃষ্টি হয় এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনারও বিকাশ ঘটে থাকে।
জনসাধারণের মনের মধ্যে উক্ত গুণগুলোর বিকাশ ঘটলে অবশ্যই গণচেতনা বিস্তার লাভ করবে, আর এই ক্ষেত্রে বইমেলার ভূমিকা সম্পর্কে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ থাকেনা। তবে যেসব দেশে নিরক্ষর ব্যক্তিদের পরিমাণ বেশি হয় সেই দেশগুলোতে গণচেতনা সৃষ্টিতে বইমেলা কতখানি সফল হতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
- বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার সমস্ত তথ্য, ইতিহাস ~ Essay on Saraswati Puja in Bengali ( PDF )
- একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]
- সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali
- ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
- বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
উপসংহার, Conclusion
বিভিন্ন দেশে বইমেলার জনপ্রিয়তা রয়েছে। যদিও ডিজিটাল যুগে মানুষ ডিজিটাল বইগুলোই বেশি পড়ে থাকেন, তবে বইমেলাতেই উন্নত ও রুচিসম্পন্ন বই দেখতে পাওয়া যায়, তাই সেদিকেই অনেকের ঝোঁক থাকে। সম্প্রতি বেশ কিছু গ্রন্থাগার বইমেলা থেকে উন্নত রুচি ও ভালো মানের গ্রন্থ নির্বাচন করে কিনছে, এর ফলে গ্রন্থাগারগুলির ক্ষেত্রে যেমন ভালো হবে তেমনই প্রকাশনা সংস্থাগুলির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটার মধ্য দিয়েই বইমেলার সার্থকতা আসবে।