পণপ্রথা একটি জাতীয় সমস্যা, Best essay on the Dowry System in Bengali



ভূমিকা, Introduction 

যৌতুক কথাটির সাথে আমার সকলেই কমবেশি পরিচিত। জানা অজানা বহু পরিবারের ক্ষেত্রেই এই সম্পর্কে অনেক গল্প শোনা যায়। একথা অস্বীকার করার নয় যে যৌতুকের বিষফল আমদের সমাজকে করেছে যুগপৎ অনগ্রসর তথা পশ্চাৎমুখী। উনিশ-বিশ শতকের পরও প্রকৃত নারী স্বাধীনতা এখনও সম্পূর্ণরূপে আসেনি। আজও থেমে যায়নি যৌতুক-প্রথা। বর্তমান সময়ের প্রাচীন সমাজপতিদের মধ্যে এই জঘন্য প্রেতাত্মার ভর এখনও রয়েছে, যার ফলে আমাদের নারীরা হাত থেকে এখনও রেহাই পাচ্ছে না।

পণপ্রথা একটি জাতীয় সমস্যা

শ্রেণী ও ধর্মভেদে পণপ্রথার পার্থক্য, Differences in dowry system among various castes and religion

বহুদিন আগে থেকেই আমাদের দেশে পণপ্রথা প্রচলিত আছে। সমাজের বিভিন্ন অংশে শ্রেণী এবং ধর্মের মতপার্থক্য অনুসারে পণপ্রথা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এমনকি এখনও বেশ কিছু অঞ্চলে পণপ্রথা খুবই প্রকট। কিছু ক্ষেত্রে বরপণ মেটাতে গিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে সর্বস্বান্ত হতে হয়। অনেকক্ষেত্রে পণের অর্থ সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ হলে অধিকাংশ বর-কণের বয়সের তারতম্য বিসদৃশ হয়ে পড়ে। 

শ্রেণী ও ধর্মভেদে পণপ্রথার পার্থক্য

প্রাচীন ও মধ্যযুগে পণ প্রথার বিকাশ, Development of dowry in ancient and medieval times

আমাদের দেশের পুরুষ-শাসিত সমাজে পণপ্রথা ভিত্তিক নারী-নির্যাতন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা বহুকাল ধরেই পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন সময়ের ভারতবর্ষে নারীদের মর্যাদা সমভাবে সকলের ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় নি। সমাজে নারীদের প্রায় সময় উপেক্ষিত হতে হতো। সেকালের লোকজন নারী-নির্যাতনে ইন্ধন যুগিয়েছিল বহু-বিবাহ প্রথায় প্রশ্রয় দিয়ে। বস্তুত নারীদের এইরূপ মর্যাদাহানির মাধ্যমে পণ প্রথার উদ্ভব ঘটে। বিয়ের যৌতুক সময়ের সাথে পরিণত হয় প্রথাচারে। এর পর থেকেই শুরু হল পণপ্রথার ব্যভিচার। নারী হয়ে উঠলো বিকিকিনির পণ্যসামগ্রী। ক্রমে অন্ধকারে ছেয়ে গেল তাদের জীবন।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে পণ প্রথার বিকাশ

একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]  

সাম্প্রতিককালে পণপ্রথার প্রচলন, The practice of dowry system in recent times

সাম্প্রতিককালে লাগামহীনভাবে পণপ্রথার প্রচলন রয়েছে। ইতঃপূর্বে বর কনের পরিবারের মধ্যে পণের অর্থ হাতে হাতে আদায় করার মতো ব্যবস্থা ছিল। বিয়ের আসরে বসেই পাত্রপক্ষকে সব যৌতুকসামগ্রীগুলো বুঝিয়ে দিতে হতো এবং দেনা-পাওনা মিটে গেলে পরে বিয়ের আসরে আনা হতো পাত্রকে।

প্রাপ্য অর্থ সম্পর্কে বুঝে নেওয়ার সময়কালে পাত্রীপক্ষের দিক থেকে চুক্তির কোনরকম খেলাপ হলে তা গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হতো এবং এই অপরাধের উপর ভিত্তি করে মানুষ ভরা বিয়েবাড়ি থেকে বরকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। বর্তমানে এসব ব্যাপার তেমন বদলায় নি; এখন শুধু সবকিছুতে ভদ্রতার মুখোশ এঁটে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ব্যক্তি শালীনতার দোহাই দিয়ে কনে পক্ষ থেকে নগদ অর্থ চান না, বরং এর পরিবর্তে রঙীন টেলিভিশন, মোটর গাড়ি, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, মোটর সাইকেল, ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা জায়গা জমি ইত্যাদি প্রত্যাশা করেন।

সাম্প্রতিককালে পণপ্রথার প্রচলন

শিক্ষা- দীক্ষার দিক থেকে আমাদের সমাজ, সভ্যতার বিকাশের সাথে আজ অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে অদ্যাবধি সমাজের প্রাচীন মানসিকতার অনুবর্তন চলছে। দুই ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের শুভ পরিণয়ের মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার পূর্বেই শুরু হয়ে যায় দেনা পাওনার দর-কষাকষি।

অনেকে যৌতুকের টাকার ওপর ভিত্তি করে নববধূর নানা রকম গুনাগুণের মূল্যায়ন করেন। আজকের দিনের সমাজব্যবস্থায়ও ধনী- দরিদ্র, শিক্ষিত- অশিক্ষিত তথা শাসক-শোষক নির্বিশেষে সকলেই কম বেশি এই হীন কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন।

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

পণ দেওয়া নেওয়ার শাস্তি, Punishment ফর giving and receiving dowry

পণ দেওয়া নেওয়ার সাথে যুক্ত বর কনে উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই শাস্তির বিধান রয়েছে। এই কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা অথবা লেনদেনের কাজে সাহায্য‌ করার জন্য‌ কমপক্ষেও ৫ বছর জেল তথা জরিমানা সহ কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

কিন্তু কোনও রকম জবরদস্তি ছাড়া যদি বর/কনেকে উপহার দেওয়া হয় তবে তা হলে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটে না। তবে সব উপহারের লিখিত তালিকা অবশ্য‌ই রাখতে হবে। প্রচলিত রীতি বা আর্থিক সামর্থ্য‌ অনুযায়ী উপহার দিলে বা নিলে কোনও শাস্তির বিধান নেই।

পণ দেওয়া নেওয়ার শাস্তি

সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali

পণ দাবি করার শাস্তি, Penalty for demanding dowry

সোজাসুজি বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেউ যদি পণের দাবি করে তবে তাদের সাজা কমপক্ষে ৬ মাস থেকে দু’ বছরের জন্য জেল এবং সাথে ১০ হাজার টাকা অবধি জরিমানা হতে পারে। কোনো গণমাধ্য‌মের ব্যবহার করে যদি নিজের ছেলে অথবা মেয়ে বা অন্য‌ কোনো আত্মীয়ের বিবাহের জন্য‌ পণ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ছাপা হলে সেই ছাপাখানা, প্রচারক, প্রকাশকের সাজা হবে ৬ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জেল অথবা ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। তবে শাস্তির চেয়েও বেশি কার্যকর হল সচেতনতা বৃদ্ধির কথা। ইতিমধ্য‌েই বেশ কয়েকটি সামাজিক ও গোষ্ঠী সংগঠন পণপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

পণ দাবি করার শাস্তি

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

পণ প্রথা প্রতিকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের যা যা করণীয়, What Women Should Do in Dowry Remedies

পণ প্রথা প্রতিকারের জন্য বিবাহযোগ্য‌ মহিলাদের পণপ্রথা তথা বাল্য‌বিবাহের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। পণপ্রথা রোধ করার বিরুদ্ধে তাদের ব্য‌ক্তিগত ক্ষেত্রে পণ না দেওয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। প্রায়ই দেখা যায় যে বিভিন্ন প্রত্য‌ন্ত গ্রামঞ্চচলে, শহরে তথা বিভিন্ন সময় পণ প্রথা সম্পর্কে বহু সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

কিন্তু তাতে তেমন ফল হচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বিয়ের দিনেও বহু পাত্রী থেকে পাত্রপক্ষ পণ নিচ্ছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় যে পাত্রপক্ষ পণ নিচ্ছে তবে পাত্রী নিজে থেকে বিয়ে আটকে দিচ্ছে। এরূপ প্রতিবাদ করাটাই বড় পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

পণ প্রথা প্রতিকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের যা যা করণীয়

পণ লেন দেন জনিত কারণে মৃত্য‌ু, Death due to dowry

বিয়ের অল্প দিনের মধ্য‌েই বা ৭ বছরের মধ্য‌ে যদি কোনো বধূ আত্মহত্য‌া করে বা তার যদি অস্বাভাবিক মৃত্য‌ু হয়, এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয় যে মৃতার স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির অন্য‌ান্য‌ আত্মীয়-পরিজনদের দুর্ব্য‌বহার ছিল, বা বধূর উপর শারীরিক নির্যাতন হয়েছিল, ইত্য‌াদি কারণ সেই নববধূকে আত্মহত্য‌ার জন্য প্ররোচনা জুগিয়েছে বা শ্বশুর বাড়ির লোকজনই তাঁকে হত্য‌া করেছে, তখন এটা ধরে নেওয়া যায় যে হয়তো এর মূলে অভিসন্ধি রয়েছে পণ আদায়ের। এসব ক্ষেত্রে অপরাধ যেই এলাকাতেই হোক না কেনো সেখানকার থানায় অবশ্যই অভিযোগ দায়ের করতে হবে।

পণ লেন দেন জনিত কারণে মৃত্য‌ু

বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali

পণপ্রথার বিরুদ্ধে আইন এবং গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, Laws  and various steps taken against dowry

বর্তমানে আমাদের দেশে নারী নির্যাতন নিরসনকল্পে আইন রয়েছে, যে আইনে বলা হয়েছে যে, পণ প্ৰদান অথবা গ্রহণ বা পণ দাবি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এক্ষেত্রে শাস্তি কারাদণ্ড বা জরিমানা। কিন্তু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত যৌতুক দানের নাম করে আইনের চোখে ধূলি নিক্ষেপের যে আয়োজন হয়েছে, এর দৌলতে প্রায়শই, বিচারের বাণী কে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখা যায়।

আইনে সকল অপরাধীদের শাস্তির বিধান দেওয়া থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না, ফলে পণপ্রথা নিয়ে মনুষ্যত্বের যে নিদারুণ অবমাননা দীর্ঘদিন চলছিল, তা বর্তমানেও বলবৎ আছে। ১৯৬১ সালের ১ লা জুলাই প্রথম Dowry Prohibition Act চালু হয়। উক্ত এ্যক্ট এর IPC ( indian penal code) বিভিন্ন রকম ধারা রয়েছে-

পণপ্রথার বিরুদ্ধে আইন এবং গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ

●  IPC sec 498/A- অর্থাৎ ধারা ৪৯৮/ এ অনুযায়ী জোর পূর্বক পণ নেওয়ার যাবজীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হবে।

IPC sec 304 / B – অর্থাৎ ধারা ৩০৪/ বি – অনুযায়ী ও যাবৎকালের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

IPC – sec 406 – অর্থাৎ এই ধারা অনুযায়ী পণ নিলে তিন বছর জেল ও পর্যাপ্ত পরিমাণ জরিমানা নেওয়া হয়।

উপসংহার, Conclusion 

“পণ হটাও সমাজ বাঁচাও” অথবা, “পণ নেবো না, পণ দেবো না” এসব স্লোগান তো অনেক শোনা যায়, কিন্তু প্রতিফলিত হতে কমই দেখা যায়, কিন্তু আমাদের সকলকেই এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সমাজে যুগ যুগান্তর ধরে বিদ্যমান পণ প্রথাকে মুছতে হলে নারীশক্তিকে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে এবং সকল সমাজ প্রেমীদের অন্য বিষয়ের সাথে এই ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে।

Recent Posts