“আমি চঞ্চল, হে আমি সুদূরের পিয়াসী॥”
ভূমিকা , Introduction
সুদূরকে নিকট করা, অজানাকে জানার ইচ্ছে মানুষের স্বভাবজাত। অপরিচিত দেশ, গিরি, নদী, মানুষজন দেখবার জন্য তার অদম্য স্পৃহার অন্ত নেই। শৈশবে যেটা থাকে সেটা শুধুই কল্পনা। বড় হবার সাথে সাথে তাকে বাস্তব করে তুলতে চায় সে। আমাদের ভারতবর্ষে এমন কিছু স্থান আছে যা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব মানুষকে আরও বেশি করে আকৃষ্ট করে তোলে ভ্রমণের প্রকৃত আনন্দকে উপলব্ধি করতে। ইতিহাসের বইয়ের পাতায় যা পাঠ করে এসেছি তা স্বচক্ষে দর্শন করার স্পৃহা সত্যিই অদম্য। ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে আমি সপরিবারে গত বছর পুজোর ছুটিতে মহারাষ্ট্রের অজন্তা ও ইলোরা গুহা মন্দির পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম।

ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, Experience traveling to historical place
পরিবর্তনশীল সময়ের সাথে সাথে আশেপাশের পরিবেশ ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও ঐতিহাসিক প্রাচীন সভ্যতা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় না।তার অস্তিত্বের প্রমাণ সে কিছুটা রেখে যায় তাদের সৃষ্ট স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রের মধ্য দিয়ে। এমনই এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হল মহারাষ্ট্রের অজন্তা এবং ইলোরা গুহা মন্দির। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় অবস্থিত এই দুই গুহা মন্দির দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। ঔরঙ্গবাদের একটি হোটেলে এক রাত্রি কাটিয়ে পরের দিন ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম গুহা দর্শনের উদ্দেশ্যে। আজ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টোত্তর ৬৫০ অর্থাৎ ৮০০ বছর ধরে সহ্যাদ্রি পর্বতে গড়ে উঠেছে এই বিস্ময়কর বৌদ্ধ গুহা মন্দির।

অজন্তা গুহা ( Ajanta caves )
প্রাচীন ইতিহাস পড়ে ও শিক্ষক শিক্ষিকার থেকে জানতে পেরেছিলাম যে প্রচুর বৌদ্ধ ভিক্ষু শিল্পী, ভাস্কর ও শ্রমিকের শ্রমে গড়ে উঠেছে এই অর্ধচন্দ্রাকৃতি অশ্বখুরের মতন দেখতে অজন্তা গুহা মন্দির।মোট ঊনত্রিশ টি গুহা নিয়ে তৈরি অজন্তায় রয়েছে ‘মহাযান’ও ‘হীনযান’ এই দুই মতাবলম্বীদের সৃষ্ট শিল্পী।
অজন্তার প্রত্যেকটি গুহার দেয়ালে রয়েছে প্রচুর চিত্র। এখন অজন্তাতে মোট ছাব্বিশটা গুহা রয়েছে। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে এই অবিস্মরণীয় গুহাগুলি আর এর দেওয়ালগুলিতে খোদাই করে ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়েছে। গুহার দেওয়ালে রয়েছে প্রাকৃতিক রং দিয়ে করা পেন্টিং যার মাহাত্ম্য স্বচক্ষে না দেখলে অনুভব করা যায় না। বেশিরভাগই পেন্টিং এই রয়েছে জাতকের গল্পের অবতারণা।

অজন্তার দেয়ালের চিত্রগুলি বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কাহিনি বর্ণনা করছে। ফ্রেস্কো ধাঁচের এই দেয়ালচিত্রগুলি যেন জীবন্ত মনে হয় এবং তারই সাথে এগুলো তে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। কারুশিল্পের সূক্ষ্ম প্রয়োগ এগুলোকে ভারতের বৌদ্ধ চিত্রশিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শনে পরিণত করেছে।১৯৮৩ সাল থেকে এই স্থানটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
যদিও অজন্তার গুহা চিত্র এখন অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে তবে বোঝা ই যায় যে এই গুহাগুলি মূলত বৌদ্ধ মন্দির। বেশ কয়েকটি গুহায় রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় অবস্থিত ভগবান বুদ্ধের মূর্তি।
ইলোরা গুহা ( Ellora caves )
অজন্তার মতোই প্রায় একই ধরনের দেয়ালচিত্র ও ভাস্কর্যের অপূর্ব মিলন ঘটেছে ইলোরার গুলিতেও। ইলোরা ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি (১৮.৬ মাইল) দূরে অবস্থিত ; অজন্তা থেকে ইলোরার দূরত্ব একশো চার কিলোমিটার । রাষ্ট্রকুট রাজবংশ এই নিদর্শনের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করেছিল।এখানে মোট ৩৪টি গুহা রয়েছে যেগুলো চরনন্দ্রী পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে।৫ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে এই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো নির্মিত হয়েছিল।
এখানে বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি, হিন্দু ধর্মের ১৭টি এবং জৈন ধর্মের ৫টি মন্দির রয়েছে। সব ধর্মের উপাসনালয়ের এই সহাবস্থান সে যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন বহন করে। এক্ষানকার সবচেয়ে বিখ্যাত বৌদ্ধগুহা হল ১০ নং গুহা যা “কারপেন্টার’স কেভ” (‘Carpenter’s Cave’) নামে সর্বাধিক পরিচিত। এই গুহাটিতে গির্জার মত একটি বিশাল ‘হল’ বিদ্যমান যার নাম চৈত্য, যার ছাদ এমনভাবে খোদাইকৃত যে দেখতে অনেকটা কাঠের বিমের মত। এই গুহার ঠিক মধ্যখানে একটি ১৫ ফুট লম্বা আসনকৃত বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
অজন্তা এবং ইলোরার গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া জিনিস হল যে এসব সুখ কারুকার্য গুলি হাত দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, শুধুমাত্র একটি হাতুড়ি ও ছাঁচে। ভারতে নানা জায়গায় বিভিন্ন গুহা কমপ্লেক্স থাকলেও বলা হয়ে থাকে যে এই স্থানটিই সবচেয়ে দর্শনীয়।

ইলোরার গুহাগুলিতে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী ভাষ্কর্যের সমাহার। আমরা অজন্তা গুহায় দেখেছি ভারতের বেশিরভাগ আধুনিক প্রাচীন চিত্রকর্ম তবে ইলোরার গুহাগুলিতে অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে হয়েছে ছিলাম বিমুগ্ধ।
ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার পালা, It’s time to return home
আমাদের হাতে সময় ছিল না বলে বাকি গুহা গুলো অদেখাই রয়ে গিয়েছিল।
সব গুহা দেখা হলো না বলে একটু মনখারাপ নিয়েই পুণের পথে রওনা দিয়েছিলাম। পরের দিন পুণে থেকে কলকাতাগামী ফ্লাইট ধরলাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে ।

ভ্রমণের সুখময় স্মৃতি, Memories to cherish
ঐতিহাসিক এই সকল নিদর্শন দেখতে দেখতে আমি কখন যেন সে যুগে পৌঁছে গেছি তা নিজেও জানি না। বুদ্ধদেবের অতীত জীবনের ঘটনা তৎকালীন সমাজব্যবস্থা পদ্মপাণি, বজ্রপাণি, মায়াদেবী, কপিলাবস্তু শহর সবই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে আমায় সর্বাধিক আকৃষ্ট করেছিল পদ্মাসন ভঙ্গিমায় বসা বৌদ্ধ মূর্তিটি । ইতিহাসের পাতায় অতীত বলে চিহ্নিত এই সভ্যতা আমার মনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগিয়েছিল। মনে হচ্ছিল সময়ের স্রোত কোন সভ্যতাকে বিলুপ্ত করতে পারে না যেভাবে পারিনি ঐতিহ্যবাহী অজন্তা ইলোরা কেও লুপ্ত করতে

ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব, Significance and importance of visiting historical place
ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের ফলে মানুষ মুখোমুখি হয় অতীত ইতিহাসের ফেলে যাওয়া নিদর্শনগুলির সাথে যা ইতিহাসের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটানোর মাধ্যমে অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসুত্র স্থাপন করে দেয় ।
ঐতিহাসিক ভ্রমণ করার সুবাদে মানুষ যেন ইতিহাসকে হাতে ছুঁয়ে দেখতে পারে। অতীতের গৌরবগাথার কথা যেগুলি এতদিন তারা বই পড়ে জেনেছিল, ঐতিহাসিক ভ্রমণ করাকালীন সেইগুলি আসে হাতের নাগালে, চোখের সামনে আর এভাবেই অতীতের শিল্প সংস্কৃতি তথা চারুকলার সাথে পরিচিতি ঘটে বর্তমান যুগের মানুষের।
- প্ৰখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মান্না দে -র জীবনী, Best Biography of Manna Dey in Bengali
- কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, Best Biography of Bibhutibhushan Bandyopadhyay in Bengali
- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনী, Best Biography of Hemant Mukherjee in Bengali
- যীশু খ্রীষ্ট জীবনী, Best biography of Jesus Christ in Bengali
- এ আর রহমান এর জীবনী, Best detailed biography of A.R. Rahman in Bengali

উপসংহার, Conclusion

একথা অনস্বীকার্য যে রোজকার পরিচিত গণ্ডির বাইরে অতিক্রম করে কোন অপরিচিত পরিবেশ থেকে ভ্রমণ করে আসার অভিজ্ঞতা জীবনের সর্বোত্তম অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে অন্যতম। সেদিনের সেই দিনটির অভিজ্ঞতার কথা, অনুভূতির কথা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেদিন উপলব্ধি করেবচিলাম যে ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না; এর ব্যাপ্তি সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের এই মধুর স্মৃতি ও শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা আমার মনে তাই আজও সজীব ও সতেজ। তাই এক বছর পর এখন ও যখন সেই স্মৃতি রোমন্থন করি তখন মনে হয় যে এখনো যেন অজন্তা ইলোরার গুহায় সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
