বাংলা সাহিত্যে যাদের লেখনীর অবদান আজও স্মরণীয় সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন তেমনই একটি নাম। বাংলা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ তার কলমে স্পর্শেই হয়ে উঠেছে পাঠকদের সেরা গোয়েন্দা গল্পের অন্যতম।
- জন্ম
- শিক্ষাজীবন
- পারিবারিক জীবন
- কর্মজীবন
- সাহিত্যজীবন
- সৃষ্টিসমূহ
- শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা
- টেলিভিশন
- পুরষ্কার
- মৃত্যু
- প্রশ্নোত্তর
জন্ম
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ৩০ শে মার্চ ১৮৯৯ সালে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন আদি নিবাস উত্তর কলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চল।
শিক্ষাজীবন
১৯১৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন ।তার স্কুলজীবন কেটেছে মুঙ্গেরে ।খেলাধুলোর ভীষণ নেশা ছিল তার ,ফুটবল ,ক্রিকেট থেকে টেনিস ,হকি ,বাস্কেটবল সবেতেই পারদর্শী ছিলেন ।
তার বাবা সবসময় চাইতেন ছেলে আইনজীবী হোক । তবে তার মনে সবসময় দ্বন্দ্ব ছিল তিনি আইন পড়বেন নাকি সাহিত্য চর্চায় ব্রতী হবেন এই নিয়ে । ১৯১৫ সালে তিনি ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে ১৯১৯ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পাটনায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে যান।
১৯২৯ সালে ওকালতি থেকে পিছিয়ে গেলেন ,তার বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন ওকালতি থেকে ছেলের পথ আলাদা ,শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মনস্থির করে নিয়েছিলেন সাহিত্যেই নিজেকে নিয়োজিত করবেন।
পারিবারিক জীবন
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর পিতা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উকিল ছিলেন, তবে সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ ছিল আগাগোড়া। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতা বিজলীপ্রভাদেবীও ভালোবাসতেন সাহিত্যকে,তাই কিশোর শরদিন্দুকে পড়ে শোনাতেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।
১৯ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় মুঙ্গেরের উকিল জীবন কৃষ্ণ চক্রবর্তীর পৌত্রী পারুলদেবীর সঙ্গে।
কর্মজীবন
১৯২৬ সালে পাটনা থেকে আইন পাশ করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর ওকালতি শুরু করেন ,কিন্তু বেশিদিন নয় ১৯২৯ সালে ওকালতি ছেড়ে দেন । ১৯৩৮ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পাটনা ছেড়ে মুম্বাই যান, সেখানে বোম্বে টকিজ মুভিস জন্য স্ক্রিনপ্লে লিখতে শুরু করেন কিন্তু বেশিদিন নয় ১৯৫২ তে মুম্বাই ছেড়ে পুনে আসেন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
সাহিত্যজীবন
পড়াশোনার পাশাপাসা সাহিত্যচর্চাও করতেন তিনি ,২০ বছর বয়সে কলেজে পড়ার সময় প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় ,’যৌবন -স্মৃতি ‘ নামক কবিতার সংকলন ,যার মধ্যে ছিল বাইশটি কবিতা পাঠক হৃদয়ে চিরস্মরণীয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা কাহিনী যেমন জনপ্রিয় তেমনি জনপ্রিয় তার গল্প বর্ণনা রীতি, ভূতুড়ে কাহিনী হোক কিংবা ঐতিহাসিক রচনা তার কল্পনার বিস্তার ;গল্পের চমক পাঠকের মনে এক আনন্দের সঞ্চার করে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন কবিতাও। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য রচনার প্রেরণার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন – “ঐতিহাসিক গল্প লেখার প্রেরণা পাই বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকেই শিখেছি ভাষার মধ্যেই বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় – ঐতিহাসিক বাতাবরণ” (জীবন কথা)।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিখ্যাত সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পী প্রতিভা সম্পর্কে বলেছেন- “ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ উপন্যাস ও ছোটগল্প সংগ্রহ উভয়াবিধ রচনারই প্রচুর নিদর্শন দিয়েছেন। তাঁহার উপন্যাসগুলি সুলিখিত। উহাদের আখ্যানভাগ সুসংবদ্ধ ও চিত্তাকর্ষক এবং তাহার রচনারীতির সমিত বাক্য প্রয়োগ, ভাবগ্রন্থন ও মন্তব্য সংযোজনা প্রভৃতি গুনে সুখপাঠ্য ও পাঠকের রসবোধের তৃপ্তি বিধায়ক।
👉 👉 👉 পরে নিন বাংলা সাহিত্যের সেরা রহস্যের উপন্যাস ও গল্পগুলি
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টিসমূহ
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম। ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে তেত্রিশটি কাহিনী রচনা করেছেন তিনি।
তাঁর সৃস্ট গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৩২ সালে ,তারপর চার বছর ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে দশটি গল্প লেখার পর বহুবছর ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবেননি ,দীর্ঘ ১৫ বছর পর কলকাতায় পরিমল গোস্বামীর ছেলেমেয়েদের কাছে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে গল্প না লেখায় অভিযোগ শোনেন ,তারপর আবার ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয় দীর্ঘ বছর পর লেখেন ‘চিত্রচোর’।
ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজ
- সত্যান্বেষী (1931)
- পথের কাঁটা (1932)
- সীমান্ত হীরা (1932)
- মাকড়সার রস (1933)
- অর্থমনর্থম(1933)
- চোরাবালি (1933)
- অগ্নিবাণ (1935)
- উপসংহার (1935)
- রক্তমুখী নীলা (1936)
- ব্যোমকেশ ও বরোদা (1936)
- চিত্রচোর (1951)
- দুর্গ রহস্য (1952)
- চিড়িয়াখানা (1953)
- আদিম রিপু (1955)
- বহ্নি-পতঙ্গ (1956)
- রক্তের দাগ (1956)
- মনিমন্দন (1958)
- অমৃতের মৃত্যু (1959)
- সাইলো রহস্য (1959)
- অচিন পাখি (1960)
- কহেন কবি কালিদাস (1961)
- অদৃশ্য ত্রিকোন (1961)
- খুঁজি খুঁজি নারী (1961)
- অদ্বিতীয় (1961)
- মগ্নমৈনাক (1963)
- দুষ্টচক্র (1963)
- হেঁয়ালির ছন্দ (1964)
- রুম নম্বর দুই (1964)
- ছলনার ছন্দ (1965)
- শজারুর কাঁটা (1967)
- বেণীসংহার (1968)
- লোহার বিস্কুট (1969)
- বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত) (1970)
উপন্যাস
তাঁর ব্যোমকেশ বক্সী যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তেমনই তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলিও পাঠক মনে সাড়া ফেলেছিল , ঐতিহাসিক উপন্যাস সাহিত্যিক নিজেই
ঐতিহাসিক উপন্যাস সম্পর্কে সাহিত্যিক নিজেই বলেছিলেন – “ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি ।মনে কেমন একটা সেন্স অফ ফুলফিলমেন্ট হয় ।গৌড়মল্লার ও তুঙ্গভদ্রার তীরে লেখার পর খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম ।”
- বিষের ধোঁয়া (১৩৫১)
- ছায়া পথিক (১৩৫৬)
- তুমি সন্ধ্যার মেঘ(১৯৫৮)
- ঝিন্দের বন্দী(১৩৫১)
- গৌড়মল্লার (১৩৬১)
- তুঙ্গভদ্রার তীরে (১৩৭২)
- কালের মন্দিরা (১৩৫৮)
ছোটগল্প সংকলন
- জাতিস্মর (১৯৩৩)
- ডিটেকটিভ (১৯৩৭)
- চুয়াচন্দন(১৯৪২)
- কাঁচামিঠে(১৯৪২)
- কালকূট (১৯৪৫)
- গোপনকথা(১৩৫২)
- দন্তরুচি (১৩৫২)
- পঞ্চভূত (১৩৫২)
- ছায়াপথিক(১৩৫৬)
- মায়াকুরঙ্গী(১৩৫৬)
- কানু কহে রাই'(১৩৬১)
- কুমারসম্ভবের কবি'(১৩৭০)
চিত্রনাট্য
বম্বে টকিজে সাতটি হিন্দি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। এই সাতটি সিনেমা হল –
- ভাবী
- বচন
- দুর্গা
- কঙ্কন
- নবজীবন
- আজাদ
- পুনর্মিলন
শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা – Movies On the Creations by Sharadindu Bandyopadhyay
শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের একাধিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা।
- ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১)
- চিড়িয়াখানা (১৯৬৬)
- শজারুর কাঁটা (১৯৭৪)
- দাদার কীর্তি
- মেঘমুক্তি
- মগ্ন মৈনাক (২০০৯)
- ব্যোমকেশ বক্সী (২০১০)
- আবার ব্যোমকেশ (২০১২)
- যেখানে ভুতের ভয় (২০১২)
- সত্যান্বেষী (২০১৩),
- ব্যোমকেশ ফিরে এলো (২০১৪)
- সজারুর কাঁটা (২০১৫)
- ব্যোমকেশ বক্সী (২০১৫)
- বহ্নি পতঙ্গ (২০১৫)
- মনচোরা (২০১৫)
- ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা (২০১৬)
- ব্যোমকেশ পর্ব (২০১৬)
- বারোদা ও বহুরূপী (২০১৬)
- ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ (২০১৭)
- ব্যোমকেশ গোত্র (২০১৮)
- বিদায় ব্যোমকেশ (২০১৮)
টেলিভিশনে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট ব্যোমকেশ সিরিজ – Byomkesh Bakshi Television Series
টেলিভিশনে ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সালে দূরদর্শনে ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজ দেখানো হয় যার পরিচালক ছিলেন বাসু চক্রবর্তী। যেখানে অভিনেতা রাজিত কাপুর ব্যোমকেশের ভূমিকায় এবং অভিনেত্রী সুকন্যা কুলকার্নি সত্যবতীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
২০১৪-২০১৫ সালে কালার্স বাংলা টেলিভিশনের পর্দায় আবার ফিরে আসে ব্যোমকেশ বক্সী। সেই ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজে অভিনেতা গৌরব চক্রবর্তী ব্যোমকেশ বক্সী এবং অভিনেত্রী রিধিমা ঘোষ সত্যবতীর ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন ।
পুরষ্কার – Awards
সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অসামান্য লেখনীর জন্য বেশকিছু পুরস্কার পান। যার মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্র পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে ‘ তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটির জন্য তিনি ‘রবীন্দ্র পুরশষ্কার’ পান। এছাড়াও তিনি শরৎ স্মৃতি পুরস্কার ,মতিলাল পুরস্কার সহ একাধিক পুরষ্কার লাভ করেন।
মৃত্যু
১৯৭০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটলেও তার সৃষ্টির মাধ্যমে আজও তিনি পাঠক হৃদয়ে অমর।
প্রশ্নোত্তর
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কবে জন্মগ্রহণ করেন ?
৩০ শে মার্চ ১৮৯৯
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ?
উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর নামক শহরে
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদি নিবাস কোথায় ?
উত্তর কলকাতার বরানগর কুঠিঘাট
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতার নাম কি ?
তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতার নাম কি ?
বিজলীপ্রভাদেবীও
কত বছর বয়সে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে হয় ?
১৯
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর নাম কি ?
পারুলদেবী
ব্যোমকেশ বকশির প্রথম উপন্যাস কোনটি ?
সত্যান্বেষী
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিবস কোনটি ?
১৯৭০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় মারা যান ?
পুনে শহরে