বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না তিনি ছিলেন লেখক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ ও সৈনিক। তিনি ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র অর্থাৎ ইংরেজির ১৯৭৬ সালের ২৭-২৯ আগস্টে ঢাকা, পিজি হাসপাতালে ( বর্তমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে) মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী হল বাঙালি জাতির কাছে একটি শোকাবহ দিন কারণ এইদিনে আমরা আমাদের জাতীয় কবিকে হারিয়ে ফেলি। তিনি শুধু কবিতার ভাষায় নয়, সংগীত, প্রবন্ধ এবং বাণীতে জাগিয়ে তুলেছিলেন বাঙালির আত্মচেতনা।

শৈশবেই পিতৃহারা
পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সকল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ায় তাঁকে অনেক ছোটবড় কাজ করতে হয়েছিল। এমনকি তিনি লেটো দলে যোগ দিয়েও অভিনয়, গান ও লেখার প্রতিভা বিকাশ করেছিলেন।
অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা
এতো আর্থিক অনটনের পরও তিনি তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম শিক্ষা শুরু হয় মক্তবে যেখানে তাঁকে কোরআন শরীফ ও ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি চুরুলিয়া গ্রামের পাঠশালায় এবং পরবর্তীতে রাণীগঞ্জ স্কুলে তাঁর পরবর্তী পড়াশোনা করেন।

স্কুল ও পড়াশোনায় বাধা
এরপর নজরুল নদিয়া জেলার দারিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন কিন্তু যুদ্ধ ও আর্থিক অনটনের জন্য তিনি আর পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এগুলো বাধার সম্মুখীন হওয়ার পরও তিনি নিজের আত্মশক্তির মাধ্যমে সাহিত্য, সংগীত ও সাংবাদিকতায় অসাধারণ অবদান রেখে গিয়েছেন।
রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও কারাবরণ
কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর লেখায় বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার আহ্বান করেছিলেন যা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। ১৯২২ সালে তিনি “অগ্নিবীণা” কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এই কারণে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন তিনি লেখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি” ও “বিদ্রোহী” কবিতা। সেইসময় তাঁর ওপর কঠোর নির্যাতন চালানো হয় কিন্তু তিনি আপসহীন ছিলেন যা তাঁর সাহিত্য ও সংগ্রাম রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতীক হয়ে আছে।
কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীর শুভেচ্ছা বার্তা সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে।
অসুস্থতা ও বাকরুদ্ধ জীবন
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে এক রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ও এরফলে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি জীবনের প্রায় তিন দশক নির্বাক অবস্থায় কাটান। তাঁর এই নিস্তব্ধ জীবন ছিল খুবই বেদনাদায়ক।
পরিবারেও দুঃখ
নজরুলের জীবন ছিল সংগ্রামের, বিদ্রোহের এবং মানবতায় পরিপূর্ণ। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। নজরুলের মৃত্যু তাই শুধু একজন মানুষের নয়, যেন এক যুগের অবসান।মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন নজরুল নির্বাক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে কিছু করুণ অধ্যায় রয়েছে যেমন তিনি ছোটবেলায় পিতৃহারা গিয়েছিলেন যার জন্য তাঁকে অনেক অভাব অনটনের মধ্যে বড় হতে হয়েছিল। আজ আমরা কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে বাণী, উক্তি ও কবিতা পরিবেশন করবো।
কাজী নজরুল ইসলামের সেরা বাণী, Kazi Nazrul Islam best sayings



- আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।
- সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভন্ডামি দিয়া কখনো মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জ্বলিবে না।
- শোন মর্ত্যের জীব অন্যের যত করিবে পীড়ন নিজে হবে তত ক্লীব।
- ভালবাসার কোন অর্থ বা পরিমাণ নেই।
- প্রেম হল ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।
- তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন।
- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ? চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী বলে না তো কিছু চাঁদ। “
- ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা না পেলে তার জীবন দুঃখের ও জড়তার।
- ভালোবাসাকে যে জীবনে অপমান করে সে জীবনে আর ভালোবাসা পায় না।
- আমার যাবার সময় হল দাও বিদায় , মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়।
- কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে সম্পুর্ণ আলাদা। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।
- যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
- মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
- মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে বিরহের যন্ত্রণা যে কতো কঠিন, কতো ভয়ানক তা একমাত্র ভুক্তভোগীই অনুভব করতে পারে।
- বাহিরের স্বাধীনতা গিয়াছে বলিয়া অন্তরের স্বাধীনতাকেও আমরা যেন বিসর্জন না দিই।
- রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা।
- নুড়ি হাজার বছর ঝরণায় ডুবে থেকেও রস পায় না।

কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বাণী ও উক্তিসমূহ সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে।


কাজী নজরুল ইসলামের সেরা উক্তি, Kazi Nazrul Islam best quotes

- শাস্ত্র না ঘেটে ডুব দাও সখা সত্য সিন্ধু জলে।
- হেথা সবে সম পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!
- হয়তো তোমার পাব দেখা, যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।
- বল বীর-বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।
- কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
- ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান , আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
- আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন।
- আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
- আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি।
- নর-ভাবে আমি বড় নারী ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!
- আমার যাবার সময় হল দাও বিদায় মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়।
- খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।। - বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।
- ব্যর্থ না হওয়ার সব চাইতে নিশ্চিন্ত পথ হলো সাফল্য অর্জনে দৃঢ় সঙ্কল্প হওয়া।
- বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধকের কঙ্গাল মূর্তি।


কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, Kazi Nazrul Islam poems




- মহা – বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত। - বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। - আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায়ে মল,
মাথায় ঘোমটা, ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল!
যে-ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যতো আবরণ। - তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু …
মাতা তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী।
তোমার আঁচল পাতা নিখিল দুঃখী-নিপীড়িত তবে,
বিষ শুধু তোমা দহে যথা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে। - ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দুটি নারীর পানে?
জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে! - কান্না হাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা
কখন তুমি ডাক দেবে মা, কখন আমি ভাঙব খেলা ? - খেলে চঞ্চলা বরষা-বালিকা
মেঘের এলোকেশে ওড়ে পুবালি বায়
দোলে গলায় বলাকার মালিকা। - মৌ-লোভী যত মৌলবি আর মোল-লা’রা কন হাত নেড়ে
দেব-দেবী নাম মুখে আনে সবে দাও পাজিটার জাত মেরে
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও
যদিও শহীদ হইতে রাজি ও
আমপারা পড়া হামবড়া মোরা এখনও বেড়াই ভাত মেরে
হিন্দুরা ভাবে পার্শী শব্দে কবিতা লেখে ও পা’ত নেড়ে। - গাহি সাম্যের গান –
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই , নহে মহীয়ান। - দূর আজানের মধুর ধ্বনি, বাজে, বাজে মসজিদের-ই মিনারে।
মনেতে জাগে, হাজার বছর আগে, হজরত বেলালের অনুরাগে।
তার খাস এলাহান, মাতাইতো প্রাণ।
ভাঙ্গাইতো পাষান, জাগাইতো মহিমারে।
দূর আজানের মধুর ধ্বনি, বাজে, বাজে মসজিদের-ই মিনারে। - যেথা সবে-সম-পাপী
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি
জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও
টুপি পড়ে টিকি রেখে সদা বলো যেন তুমি পাপী নও
পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং ট্রেডমার্কার ধুম
পুলিশি পোশাক পরিয়া হয়েছ পাপের আসামী গুম। - মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।


- কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী, সংক্ষিপ্ত জীবনী, বাণী, কবিতা, Death anniversary of Kazi Nazrul Islam in Bangla
- বন্ধুকে নিয়ে স্ট্যাটাস ক্যাপশন, Friend status caption in Bengali
- শেষ বিকেলের সূর্য নিয়ে ক্যাপশন, Caption about the late afternoon sun in Bangla
- নারী নিয়ে ক্যাপশন, Captions about women in Bengali
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন, বাণী ও বার্তা, Bankim Chandra Chattopadhyay quotes in Bengali

উপসংহার
কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করা হয়। সরকারিভাবে ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তার কবিতা পাঠ, নজরুল সংগীত পরিবেশন, আলোচনা সভা ও স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
নজরুল ছিলেন মানবতার কবি। তিনি বলেন, “ধর্মের নাম দিয়ে হানাহানি নয়, মানবতার জয় হোক।” তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী কেবল শোকের নয়, বরং তার জীবন ও আদর্শকে স্মরণ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাহস, মুক্তি ও মানবতার বীজ বপনের দিন। নজরুলের অমর সৃষ্টি চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।আশা করছি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের পছন্দ হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই পোস্টটি আপনি আপনাদের বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও চেনা পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারেন।