দুর্গা পুজো বাংলার তথা বাঙালিদের প্রধান অনুষ্ঠান, যার অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে প্রতি ঘরের কচি-কাচা থেকে প্রবীণ দাদু-ঠাকুমারাও। জাতিধর্ম নির্বিশেষে এই বিশেষ উৎসব নিয়ে মেতে ওঠে সবাই। পৌরাণিক কিছু কাহিনী অনুসারে কথিত আছে যে বাংলায় বসন্ত কালে এই দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা সুরথ। মেধস মুনির নিকটে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি মেধস আশ্রমে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং সারা বাংলা সহ গোটা বিশ্বে বাসন্তী পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন।
বাসন্তী পূজার প্রচলন, Prevalence of Basanti Puja
একটি বছরে চারটি নবরাত্রি আসে, তার মধ্যে দুটি গুপ্ত নবরাত্রি, তবে শরত্ নবরাত্রি এবং বসন্ত নবরাত্রির উদযাপন প্রায় গোটা দেশজুড়েই হয়ে থাকে। সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্ট অবস্থান মেনে চলার মাধ্যমে নবরাত্রি পালিত হয়। বসন্ত নবরাত্রিটি পালিত হয় বাসন্তী পুজো হিসেবে। শারদীয় দুর্গাপূজার মত এই বাসন্তী পুজোও দেবী দুর্গারই আরাধনার জন্য করা হয়। আদি কালে দূর্গার আরাধনায় বাসন্তী পুজোই করা হত। তবে আজও বসন্ত নবরাত্রিতে নয় দিন ব্যাপী দেবী দুর্গার পুজো করা হয়। কিন্তু এই বাসন্তী পূজা এখন কিছু জমিদার বাড়ি তথা বনেদি বাড়িতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তবে এই পূজা নিয়ে পুরাণে একটা গল্প বর্ণনা করা আছে, যেখানে কিভাবে সুরথ রাজা দ্বারা এ পূজা শুরু হয় সে সম্পর্কেও বলা হয়েছে।
পুরাণ অনুসারে রাজা সুরথ দ্বারা প্রথম দুর্গা পুজো শুরু করার কাহিনী, According to the Puranas, the story of the first Durga Puja that was started by King Suratha
কথিত আছে যে চন্দ্র বংশীয় রাজা সুরথ বসন্ত কালে চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে প্রথমবার দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন, তখন বসন্ত কাল ছিল বলেই এই পূজা বাসন্তী পুজো নামে পরিচিতি লাভ করে। মহামায়া দেবী দুর্গার প্রথম পুজারী হিসাবে চন্ডীতে রাজা সুরথের কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে।
সুরথ রাজা ছিলেন হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের একজন সম্রাট। ক্ষত্রিয় বংশের এই রাজা সুরথ একজন সুশাসক এবং বিশিষ্ট যোদ্ধা হিসেবে বেশ সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। কখনো কোনও যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন নি। কিন্তু একসময় প্রতিবেশী রাজ্য যবন সুরথের রাজ্য আক্রমণ করে এবং সেই যুদ্ধে সুরথ রাজা পরাজিত হন, আর এই সুযোগ নিয়েই তাঁর অন্যান্য সভাসদরা তাঁর সকল ধনসম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়। নিজের কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া এরূপ প্রতারণামূলক আচরণে রাজা স্তম্ভিত হয়ে যান। এরপর তিনি সর্বহারা হয়ে বনে ঘুরতে ঘুরতে মেধস আশ্রমে চলে যান।
তখন তাঁর কাহিনী শুনে ঋষি মেধস তাঁকে সেখানেই থাকার অনুমতি দেন, কিন্তু সেখানে থেকেও রাজা প্রায় সবসময়ই খুব অস্বস্তি বোধ করতেন তথা বেশ অস্থির থাকতেন। সবসময়ই রাজ্য ও প্রজাদের নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তামগ্ন বোধ করতেন। এরকমই একটা দিনে তাঁর দেখা সমাধির সাথে হয়ে যায়। তারপর তিনি জানতে পারেন যে বৈশ্য সমাধিকেও সম্পত্তির দখল নিয়ে তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও তিনি এখনও সর্বদা নিজের বৌ-ছেলের ভালো মন্দ ভেবে চলেছেন।
সমাধি ছিলেন একজন বণিক এবং কাকতালীয় ভাবে তিনিও দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই তখন একটি বিষয় উপলব্ধি করলেন যে যারা তাদের সর্বহারা করে দিয়েছে আজও তাদের শুভচিন্তাই তাঁরা করে চলেছেন। দুজনে গিয়ে ঋষিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন ঋষি বললেন যে সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষির কাছে দুজন মিলে মহামায়ার কাহিনীর বর্ণনা শুনেন এবং ঋষির উপদেশেই রাজা মহামায়ার উদ্দেশ্যে কঠিন তপস্যা শুরু করেন। পরবর্তী কালে মহামায়ার আরাধনার উদ্দেশ্যেই বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে সুরথ রাজা মহাশক্তির পুজো শুরু করেন।
রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য পশ্চিমবঙ্গের গড় জঙ্গলে মাটি দিয়ে দেবী দূর্গার মূর্তি তৈরি করে পূজা করেছিলেন। এই পুজোর পর মহামায়ার বর পেয়ে সুরথ রাজা নিজের সমস্ত হারানো সম্পত্তি ফেরত পান এবং রাজ্যে ফিরে আসেন। এই বাসন্তী পুজো এখনও বেশ কয়েকটি বনেদি বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়।
অন্যদিকে কৃত্তিবাসীয় রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে যে শ্রী রামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার পর যখন সীতা হরণ হয়, তখন রাবণকে হারিয়ে সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য শরৎকালে মহামায়ার আরাধনা করেছিলেন। সেই সময় সূর্যের দক্ষিণায়ন চলে, তাই দেব-দেবীরা নিদ্রায় থাকেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই আশ্বিন মাসের পুজোই এখন গোটা বিশ্বে বাংলার প্রসিদ্ধ দুর্গা পুজো। এই পুজাটি অকালে করা হয়েছিল বলেই একে অকাল বোধন বলা হয়ে থাকে। তবে বাঙালিরা আদি দুর্গাপুজো অর্থাৎ বাসন্তী পূজাকে কোনও দিনই পুরোপুরিভাবে ভুলে যায়নি। তাই আজও বাংলার অনেক জায়গাতেই মহামায়ার পুজোর আদিরূপ বাসন্তী পুজোর আয়োজন বেশ আড়ম্বর করে করা হয়।
ঝাঁপ চড়ক এবং গাজন সম্পর্কে জানা অজানা কিছু কথা ~ Details about Jhaanp & Charak ( Bengali Festivals )
বাসন্তী পূজার তাৎপর্য, Significance of Basanti Puja
বসন্ত কালের দুর্গাপুজোই এক সময়ে বাঙালি সমাজের আসল দুর্গাপুজো বলে গণ্য করা হত। পুরাণের কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, আগেকার দিনে রাজারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে পরাজিত না হওয়ার জন্য এক মহাশক্তির উপাসনা করতেন। সেই অনুযায়ী বোঝা যায় যে মহামায়াকে অপার শক্তির সাথে তুলনা করা হত, আর রাজাদের বিশ্বাস ছিল যে মহাশক্তির আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলে তারা কোনো যুদ্ধ বা কোনো কাজেই পরাজিত হবেন না। তাই সমস্ত কাজে সফল ও জয়ী হওয়ার জন্য মহাশক্তির উপাসনা করার মাধ্যমেই তারা তাদের লক্ষ্য ভেদ করে নিতে পারতেন।
বংশপরম্পরায় এখনও অবধি সেই সমস্ত রাজাদের বংশধররা নিজেদের বাড়িতে পুজোর আচার অনুষ্ঠান অব্যাহত রেখেছেন, তাছাড়াও এমন অনেক বনেদি বাড়ীতে বর্তমানেও চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের তিথিতে বিশাল আড়ম্বরে বাসন্তী পুজো করা হয়, যা সেই বনেদি বাড়ির ঐতিহ্যের পাশাপাশি বাসন্তী পূজার ঐতিহ্যকেও ধরে রাখে, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই বিশেষ রীতি আজও মানুষকে অনেকখানি আকর্ষণ করে। বাঙালির এই উৎসব বর্তমান কালেও কিন্তু অনেক তাৎপর্য বহন করে রেখেছে, সেটা চৈত্র বাসন্তী পূজার নামেই হোক বা রামের অকাল বোধন হোক অথবা আশ্বিনের শারদীয়া দুর্গাপূজা। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এমন এক শক্তি বিরাজমান রয়েছে যার উপর নির্ভর করে বা বলতে গেলে যার উপর আস্থা রেখে আমরা যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারি।
- গুপ্তমুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি, Best details on Cryptocurrency in Bengali
- আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং, Best write-up on Outsourcing and freelancing in Bengali
- মোবাইল ব্যাংকিং, Know in detail about Mobile banking in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- ই-লার্নিং ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, Know what is e-learning in Bengali
উপসংহার, Conclusion
বিপদকালে সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে আদ্যাশক্তির আরাধনার প্রথা পুরাকাল থেকেই চলে এসেছে। মহাপুরুষেরা যুগ যুগ ধরে তাই করে এসেছেন। রামায়ণ অনুসারে, অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে মহামায়া দুর্গার আরাধনা করেন, যা অসময়ে হয়েছিল বলে অকাল বোধন হিসেবে খ্যাত। অন্যদিকে পুরাণ অনুযায়ী, মেধস মুনির দীক্ষিত চন্দ্র বংশীয় রাজা সুরথ বসন্ত কালে মহাশক্তি দুর্গার আরাধনা করেন এবং পূজার প্রচলন করেন। দেখতে গেলে এ শুধু কালের পার্থক্য, তবে আরাধনা কিন্তু দেবী দুর্গারই।