বাংলায় আমরা যাকে বলি, ‘বড়দিন’, ইংরেজিতে তার ই নাম ‘Christmas’। বড়দিন মূলত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। ২৫ শে ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতি বছর সাড়ম্বরে এই উৎসব পালিত হয়। যদি ও এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা প্রমাণসাপেক্ষ তবে আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অবলম্বনে , ২৫ শে ডিসেম্বর এর ঠিক নয় মাস আগে মেরির গর্ভে যিশু প্রবেশ করেছিলেন বলে জানা যায় এবং তার পরবর্তী সময় থেকেই এই হিসাব অনুসরণ করেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ হিসেবে ধার্য করা হয়ে থাকে।
তবে ভিন্নমতে এই দিনটি একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব হিসেবেও পালন করা হয়ে থাকে। উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবস অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মজয়ন্তী হিসেবে পালন করার সূত্রপাত ঘটে । ‘বড়দিন,’ ছুটির দিন হিসেবেই বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ দেশে স্বীকৃতএবং খ্রিষ্টধর্ম অনুসারে বড়দিন থেকে শুরু করে বারো দিনব্যাপী ‘খ্রিষ্টমাসটাইড ,অনুষ্ঠানের সূচনাদিবস হিসেবে ধার্য করা হয়ে থাকে।
বুৎপত্তি
প্রধানত গ্রীক আর লাতিন শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই ‘খ্রিসমাস’ শব্দটি। Cristes শব্দটি গ্রীক Christos থেকে এবং লাতিন missa শব্দটি থেকে আগত হয়েছে বলে জানা যায়। তাছাড়া প্রাচীন গ্রীক শব্দ, Christos বানানের আদ্য অক্ষরটি লাতিন অক্ষর X এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সেই কারণে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এক্স অক্ষরটি খ্রিস্টের নামের শব্দ সংক্ষেপ হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে।তাই অনেকে এই দিনটিকে ‘এক্স -মাস’ বলেও চিহ্নিত করে। ২৩শে ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড়ো এবং রাত ছোটো হওয়ার ভৌগোলিক কারণটি কে মাথায় রেখে আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান অনুসরণ করে যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসবের উৎসবটিকে বাংলায় ‘বড়দিন’ আখ্যা দিয়েছে।
যিশুর জন্মবৃত্তান্ত
নিউ টেস্টামেন্টে অনুযায়ী এক দৈববাণী অনুসারে যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল জেরুজালেমের বেথলেহেম শহরে ।মেরি এবং জোসেফ বেথলেহেমে এলে শহরের কোনো সরাইখানা সেই সময় খালি না থাকার কারণে শহরের একটি আস্তাবলে (ভিন্নমতে গোশালায় ) যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন একই হুদি ধর্মপ্রচারক যাঁকে খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়।তাঁকে নাসরতের যিশু নামেও অভিহিতকরা করা হয়ে থাকে।। যিশুকে প্রদত্ত উপাধি ‘খ্রিস্ট’ থেকেই খ্রিস্টধর্মের নামকরণ করা হয়েছে বলে মানা হয়।
বাইবেলে যিশুর জন্মতারিখের নির্দিষ্টভাবে কোনও উল্লেখ না থাকলেও, প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর দিনটি কে যিশুর জন্মদিন হিসেবেই পালন করা হয়ে থাকে। ইতিহাসে উল্লিখিত আছে যে ২৪ ডিসেম্বর রাতে বেথেলহেমের এক গোশালায় কুমারী মা মেরীর কোলে জন্ম নেয় ছোট্ট যিশু এবং প্রচারিত যে পৃথিবী থেকে হিংসা -ভেদাভেদ মুছে ফেলার মহান কর্মের উদ্দেশ্যেই জন্ম হয়েছিল তাঁর। অনেকে আবার যিশুকে সূর্যের সন্তান বলেও মনে করেন। তবে সর্বপ্রথম ‘বড়দিন’ উদযাপনের সঠিক দিনটি নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিমত আছে ।
তবে অনুমান করে এই সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বড়দিন পালিত হয়ে থাকে, ক্যাথলিক রাজা কনস্ট্যানটাইনের আমলে এবং এর কিছুকাল পর পোপ জুলিয়াস এর ঘোষণা অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর উদযাপন করা হয় ‘বড়দিন’। ‘বড়দিন’ ঘিরে দ্বিমত বর্তমান জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিতেও। অনেক অর্থোডক্স ও ক্যাথলিক চার্চ এখনো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে জুলিয়ান দিনপঞ্জি কেই অনুসরণ করে ৭ জানুয়ারি তারিখটি তে ‘বড়দিন’ পালন করে থাকে।
আবার অনেকে মনে করেন প্রকৃতির পূজারি প্রাচীন রোমান প্যারাগনরা যাতে উৎসবে মেতে উঠতে পারেন সেই অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর পালন করা হয় বড়দিন। কিন্তু এই তথ্যকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয় না কারণ ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া গেছে যে খ্রিস্টানরা প্যাগন ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি।
তবে খ্রিস্টানরা এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন যে যিশু ,ইশ্বরের পুত্র এবং বাইবেলের পুরাতন নিয়মানুসারে পূর্বব্যক্ত ‘মসিহ’ যার আগমনের ফলে নতুন নিয়মে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে।আদি বাইবেলের মতে ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয় এবং তাঁর পরবর্তী সময় থেকেই এই বিশেষ দিন টি যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসাবে উদযাপন করা হয়। তবে প্রাচীন ইউরোপ মহাদেশের নানা বইতে এর ভিন্নমত পোষণ করা আছে। ‘যিশু’-ছিলেন এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যাঁকে প্রায়শই ‘রাব্বি’ সম্বোধন করা হয়ে এসেছে।
তিনি মৌখিকভাবে তাঁর আদর্শ সময় বাণী প্রচার করে এসেছেন। । আধুনিক যুগে অনুমান করা হয়ে থাকে যে, যিশু ছিলেন একজন রহস্যোদ্ঘাটনবাদী ধর্মপ্রচারক যিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যেই একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তবে এই তথ্যেরও দ্বিমত আছে। কথিত আছে যে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি নিয়ে তিনি ইহুদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন , ঐশ্বরিক যোগবলে রোগীদের রোগমুক্ত করতেনও নীতিকাহিনির মাধ্যমে শীর্ষ সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দিতেন। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে এবং কয়েকটি ইস্টার্ন চার্চের মত অনুযায়ী জানুয়ারির বিভিন্ন তারিখে যিশুর জন্মদিন পালিত হয় যা বড়দিন বা ক্রিসমাস নামে পরিচিত।
যিশুর জন্মের স্বতন্ত্র গুরুত্ব:
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বে যিশুর আবির্ভাবের একটি ‘স্বতন্ত্র গুরুত্ব’ রয়েছে। খ্রিস্টীয় মতবাদ প্রসূত বিশ্বাসগুলির মধ্যে রয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে যিশুর গর্ভে প্রবেশ এবং ‘মেরি’ নামক এক কুমারীর গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যিশুর বিভিন্ন অলৌকিক কার্য সম্পাদন করা থেকে শুরু করে, চার্চ প্রতিষ্ঠা, প্রতিকারের বিধান করার জন্য আত্মত্যাগ স্বরূপ ক্রুশারোহণে মৃত্যু বরণ এবং মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জীবন লাভ করে সশরীরে স্বর্গ-আরোহণ, এবং পরবর্তী ভবিষ্যতে তাঁর পুনরাগমনে বিশ্বাসে বিশ্বাস রাখেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষেরা।
তাঁরা এও বিশ্বাস করেন যে, যিশু ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের পুনর্মিলন ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন।নাইসিন ধর্মমত ব্যক্ত করে থাকে যে যিশু মৃতদের বিচার করবেন এবং সেই বিচারকার্য সম্পাদন করা হবে তাদের শারীরিক পুনর্জীবন লাভের আগে অথবা পরে। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন যে, ত্রাণকর্তা রূপে যিশুর ভূমিকা শুধুই জীবনবাদমূলক বা সমাজমূলক। তবে খ্রিস্টান সমাজে অধিকাংশই যিশুকে ত্রয়ীর তিন জন ব্যক্তির দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরপুত্রের অবতার হিসেবে পূজিত করে থাকেন।
যিশুর প্রচারিত মানবতাবাদ
খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক মহাপ্রাণ যিশু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখেছিলেন নীতিও ধর্মহীন জীবনাচরণ; দেখেছিলেন পরস্পরের সঙ্গে হিংসা ও ক্রোধের সম্পর্ক। তিনি সব মানুষকে একই ভালোবাসার বৃত্তে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। মানুষকে শুনিয়েছিলেন মানবতার বাণী, উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার মন্ত্রে। মূর্তি পূজারিদের বিচারবুদ্ধিহীন ধর্মাচরণ কে তিনি পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন যার জন্য তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল দুঃসহ নির্যাতন।ক্রুশবিদ্ধ হয়ে তাঁকে শহীদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। ঈশ্বরপুত্র যিশুর সেই মহান আত্মত্যাগ আজও খ্রিষ্টানদের মহৎ প্রেরণা। তাই যিশুর জন্মদিনে মুক্তিকামী মানুষ পাপ পরিত্রাতা যিশু খ্রিস্টকে স্মরণ করে, যুগ যুগান্তর ধরে যেন এক মহা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে।
উৎসব উদযাপন | ক্রিসমাস ডে | Christmas Day Details in Bangla
‘ক্রিসমাস’ বা ‘বড়দিন’ একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তেও মহাসমারোহে এই উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে উৎসবের আয়োজনে প্রাক-খ্রিষ্টীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভাবনার সমাবেশ ও সমারোহে হয়ে থাকে । উপহার আদান-প্রদান, সংগীত, একে অপরকে বড়দিনের কার্ড বিনিময়, বিভিন্ন গির্জাগুলিতে ধর্মোপাসনা এবং বিশেষ প্রার্থনা সভা , আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি ও আনন্দ -ভোজ এবং ‘Christmas Tree’ বা বড়দিনের বৃক্ষ এবং বর্ণময় আলোকসজ্জা প্রভৃতি আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
পবিত্র এ দিনটিতে গির্জায় ঘন্টাধ্বনির সাথে সাথে জাহাজে জাহাজে সাইরেনও বাজে। খ্রিষ্টানরা রাস্তায় রাস্তায় যিশুর জন্ম সম্বন্ধীয় গান গেয়ে নগর পরিক্রমা করে।ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয় ,মানুষ একে অপরকে আলিঙ্গন করে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানায় ।ঘরে ঘরে কেক খাওয়ার ধুম পড়ে যায় । কিছু দেশ বিশেষে ফাদার খ্রিষ্টমাসের (উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে সান্টাক্লজ) ছোটোদের জন্য বড়দিনে উপহার প্রদান করার উপকথাটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।এই উৎসব কে উপলক্ষে করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনা কাটার একটি বিশেষ মরসুম ও চলে।
ক্রিসমাস ট্রি
বড়দিনের উৎসব উদযাপনের সাথে সাথে ক্রিসমাস ট্রির গুরুত্ব টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গাছটি আসলে মানুষের বৃক্ষ বন্দনার প্রতীক। এই গাছের মধ্যে দিয়ে সবুজ তারুণ্যে ভরা জীবনের সঙ্গীত গাওয়া হয়। ‘ক্রিসমাস ট্রি’ কে আলো দিয়ে সাজিয়ে শীতার্ত রাত্রিকে উষ্ণতায় পর্যবসিত করা হয়।
উপসংহার
বাঙালির ,’দুর্গাপুজো’ যেমন ধর্মসম্প্রদায়- নিরপেক্ষ এক সর্বজনীনতা লাভ করেছে তেমনি খ্রিষ্টানদের বড়দিনের উৎসব ও পৃথিবীব্যাপী এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত পাশ্চাত্য দেশগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হওয়াতে মিডিয়ার মাধ্যমে ‘বড়দিন’ আজ আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই বিশেষ দিনটি আমাদের কাছে নিয়ে আসে বিশ্ব প্রীতির বাণীকে। তাই আনন্দের সঙ্গে এই দিনে আমাদের মনেও ঘটে এক বিশেষ আত্মোপলব্ধি। মহামানব যিশুর জন্মদিনে আমরা উপলব্ধি করি বিশ্বপ্রেমের শাশ্বত বাণী যা সব রকমের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্রতাকে দূরে রেখে মুক্তির আস্বাদ দেয়।
FAQ (সম্ভাব্য প্রশ্নাবলি)
'ক্রিসমাস' বা 'বড়দিন' কবে উদযাপন করা হয়?
প্রত্যেক বছর পঁচিশে ডিসেম্বর।
যিশু খ্রিষ্ট কার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?
মাতা মেরির গর্ভে।
যিশু খ্রিষ্ট কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
জেরুজালেমের, বেথলেহেম শহরে।
বড়দিনে ছোটদের কে উপহার প্রদান করে থাকে?
ফাদার ক্রিসমাস বা স্যান্ড্রা ক্লস ।
যিশু খ্রিস্টের একটি বাণী উল্লেখ করো।
যিশুখ্রিষ্ট প্রচার করেছিলেন ,”পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়” ।