একুশ শতকে ডিজিটাল দুনিয়ায় ছোট থেকে বড় সকলেই ব্যস্ত নিজের জগতে। স্কুল, কলেজ, অফিস, সংসারের কাজ প্রভৃতি সামলে অনেকেই নিজের জন্য সময় বার করতে পারেন না, যার ফলে সব বয়সের মানুষের মধ্যেই দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ।
ফাস্টফুডের যুগে ওজন বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত আর তার জন্য শুরু হচ্ছে ডায়েট কিন্তু শুধুমাত্র ডায়েট করলেই,আর পুষ্টকর খাবার খেলেই সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, কারণ বর্তমানে ভেজালে ছেয়ে গেছে, তবে প্রতিদিন ব্যায়ামের মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব।
সবচেয়ে সহজ ব্যায়াম হলো হাঁটা, রোজ কিছু সময় বার করে যদি হাটা যায় তাহলে বিবিধ রোগের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়,শরীর সুস্থ রাখতে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই।যে কোনো বয়সের মানুষ সারাদিনে কিছু সময় হেঁটে অনায়াসেই নিজেকে সুস্থ রাখতে পারে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটলে ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, অবসাদ প্রভৃতি রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায় তেমনি ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় পাশাপাশি ঘুমও ভালো হয়।
হাঁটার উপকারিতা
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ- নিয়মিত হাঁটলে সহজেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, রক্তচাপ রোধে মোক্ষম ওষুধ হাঁটা। নিয়মিত হাঁটলে উচ্চরক্তচাপের সমস্যা খুব একটা দেখা যায়না এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা নিয়মিত হাঁটলে তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
- ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে – ডায়াবেটিস থাকলে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটা উচিত, সিঁড়ি হেঁটে ওঠানামা করা,গাড়ির ব্যবহার না করে নিয়মিত কাছাকাছি একটু হাঁটা প্রভৃতির মাধ্যমে রোজ অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস বজায় রাখলে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ডায়াবেটিস কারণ নিয়মিত হাঁটলে রক্তের সুগার কমে ফলে শরীরের পেশীতে বারে ইনসুলিনের কার্যকারিতা।
- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ শরীর – শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকলে অনায়াসেই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়ে যায়। সকালে দিনের আলোতে হাঁটার অভ্যাসের ফলে শরীর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ভিটামিন ডি তে। ভিটামিন ডি বিভিন্ন কোষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করায় ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে না অন্য কোষে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে – শুধুমাত্র ডায়েটিং এর দ্বারা ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়, অলস জীবনযাপন করলে কখনোই ওজন কমানো সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত হাঁটা চলার মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
- হাড়ের ক্ষয়রোগ জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি কমে- হাড়ের ক্ষয় রোগ বা অস্টিওপোরোসিস রোগে হাড় দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত হাঁটাচলা করলে হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা অনেক কমে যায়। মহিলাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় ও সংযোগস্থলের ব্যথা বেড়ে যায়, জয়েন্ট গুলোকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত হাঁটা জরুরী, রোজ হাঁটলে জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি কমে যায় অনেকটাই।
- হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে- নিয়মিত হাঁটলে বৃদ্ধি পায় শারীরিক সক্ষমতা, বৃদ্ধি পায় হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা, রক্তে মন্দ কোলেস্টেরল কমে যায়। মন্দ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায় কিন্তু নিয়মিত হাঁটলে হাই ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন বা ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায়। হাঁটার সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধির ফলে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বাড়ে।
- পায়ের শক্তি এবং পেশী শক্তি বৃদ্ধি – হাঁটার সময়ে পা চলার সাথে সাথে পায়ের আঙ্গুল, দু’হাত, কোমর এবং শরীর নড়াচড়া হয়, ঘাড় ও কাঁধের ব্যায়াম হয় যার ফলে পায়ের শক্তি বাড়ার সাথে সাথেই নিয়মিত হাঁটলে ব্যাকপেইনের সমস্যারও অনেকাংশেই সমাধান হয়।
- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায় – বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রায়শই দেখা যায় মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে, ৬০ এর পরে প্রবীণ মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্মৃতিভ্রম, স্মৃতি হারানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। নিয়মিত হাঁটাচলা করলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়ে যার ফলে বয়স্কদের মধ্যে ভুলে যাবার যে প্রবণতা থাকে তা অনেকাংশেই কমে যায়।
- স্ট্রোকের ঝুঁকি কমা – যুক্তরাজ্যের স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত হাঁটার কারণে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা কমে যাওয়ায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যায়। জীবন আলস্যে ভরে গেলে বা অতিরিক্ত স্থূলতার কারণে স্ট্রোকের যে রিস্ক থাকে তা হাঁটার কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণে আসায় শতকরা ৫০ ভাগ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
- ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস- ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্যান্সার স্টাডিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নিয়মিত হাঁটলে খাদ্যনালীর নিম্নাংশের ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের আশঙ্কা কমে যায় নিয়মিত হাঁটাচলায়।
- মন মেজাজ ভালো রাখতে সহায়ক মন-মন মেজাজ ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মিত হাঁটা, মানসিক চাপ কমাতে বিষন্নতার উপসর্গ হ্রাসে,বোধশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে নিয়মিত হাঁটাচলা। এনডফিন, ডোপামিন, সেরোটোনিন নিঃসরণ হয় যার ফলে ভালোলাগার অনুভূতি জাগ্রত হয়, বিষন্নতা কেটে গিয়ে মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে। সকালের মনোরম পরিবেশে হেঁটে দিনের শুরু করলে শরীরের সতেজতা বজায় থাকে, পাশাপাশি শরীরের মাংসপেশিগুলো অনেক বেশি রিলেক্সডও হয়। মানসিক চাপ ও টেনশনের প্রবনতা কমে।
হাঁটার নিয়মকানুন
এছাড়াও হাঁটার ব্যাপারে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। যেমন –
- দুপুরে রোদে কখনোই হাটা উচিত নয়।
- খাবার পরেই সঙ্গে সঙ্গে না হেঁটে কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৬০ মিনিট অপেক্ষা করে তারপর হাঁটতে হবে।
- হাঁটার আগে এবং পরে জল খেতে হবে।
- হাঁটার পর এক ঘণ্টার মধ্যেই কিছু খেয়ে নিতে হবে।
- হাঁটার সময় অবশ্যই ঢিলেঢালা পোশাক এবং উপযুক্ত জুতো পরে হাঁটা উচিত।
কখন হাঁটবেন
আমরা অনেকেই হাঁটার কথা ভাবলেও বুঝে উঠতে পারিনা হাঁটার জন্য কোন সময়টা সঠিক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো সময়ই হাঁটা যায় তবে বিশেষজ্ঞদের মতে হাঁটার জন্য সবচেয়ে ভালো সময় বিকেল।তবে কিছু কিছু সময় একেবারেই হাঁটতে যাওয়া ঠিক নয়।
যেমন সকালেও হাঁটা ভালো কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে যাওয়া সঠিক নয়, ঘুম থেকে ওঠার অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট পর হাঁটতে যাওয়া উচিত। আবার হেঁটে এসেই সাথে সাথে ঘুমোতে যাওয়া ঠিক নয়, হাঁটার কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘন্টা পরে ঘুমাতে যাওয়া উচিত। আবার ভরপেট খেয়ে উঠেও হাঁটতে নেই।
তবে সপ্তাহে একদিন বা দুদিন নয় কমপক্ষে পাঁচ দিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাটলে তবেই প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে। শুরুতে একটু অসুবিধা হলেও মানুষ যেহেতু অভ্যাসের দাস তাই ধৈর্য ধরে একবার শুরু করলে আস্তে আস্তে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস শুরু হয়ে যাবে।
অন্যান্য যে জিনিস গুলো মনে রাখতে হবে
হাঁটার ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমতল দূষণমুক্ত পরিবেশ বেছে নিতে হবে হাঁটার জন্য। যেমন বাড়ির বাগান, পার্, খোলা মাঠ, পরিষ্কার ফুটপাত প্রভৃতি স্থানে হাঁটা ভালো তবে রোদ, শব্দদূষণ, ধুলোবালি পূর্ণ জায়গা, আবর্জনার স্তুপ প্রভৃতি স্থানে হাঁটা এড়িয়ে চলতে হবে।
প্রতিদিন হাঁটার ফলে যেমন শরীর ও মন সুস্থ এবং প্রাণবন্ত থাকে তেমনি হাঁটার সময় গতির দিকটাও দেখা দরকার। প্রথমেই খুব স্পিডে হাঁটা ঠিক নয়, প্রথমে ওয়ার্ম আপ করে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করতে হবে এবং ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে স্পিড। হাঁটার মাঝে লম্বা ও গভীর দম নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে।
মাঝারি গতিতে হাঁটা ভালো, তা যেন খুব ধীর না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দেড়শ মিনিট হাঁটাহাঁটি ভীষন জরুরী। তবে শারীরিক অসুস্থতা থাকলে হাটার সময় এবং গতি ভিন্ন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাঁটতে হবে।
বিভিন্ন রোগ প্রতিহত করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখতে হাঁটা খুবই জরুরী, সপ্তাহে প্রতিদিন বা কমপক্ষে পাঁচ দিন ন্যূনতম ৩০ মিনিট হাটলে শরীর ও মন ভালো রাখা যায়। ব্যায়ামের ফলে সহজেই জীবন থেকে ওষুধের দাপট সরিয়ে ফেলা যায়। আর সবথেকে সহজ পদ্ধতির ব্যায়াম হলো হাঁটা, তাই সকলের উচিত প্রতিদিন ব্যস্ত জীবনের মধ্যে থেকেই একটু সময় বার করে হাঁটা।
Recommended Read,
Bengali Skin Care Guide | ত্বকের যত্ন নেওয়ার ঘরোয়া উপায়
Walking and cycling