সাহিত্য জগতের একটি অতি পরিচিত নাম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলেই তাঁর লেখা পড়েছেন এবং এই বিশিষ্ট সাহিত্যিকের লেখার ধরনকে উপভোগ করেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে রম্য রচনারকারী হিসেবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় বাঙালি লেখক। সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি বেশ কিছু উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসটির নাম হল “লোটাকম্বল” যা ধারাবাহিক ভাবে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
জন্ম এবং পরিবার পরিচয়, Birth and family identity
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালের ২৪ অক্টোবর, কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম তুলসী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বয়স যখন পাঁচ তখন তিনি মা কে হারান। মায়ের মৃত্যু হওয়ার কয়েক বছর পর পিতা সন্ন্যাস ব্রত অবলম্বন করেন। সঞ্জীবের বাল্যকাল কেটেছিল ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে।
একদিকে শাক্ত ঠাকুরদা এবং ঈশ্বরচিন্তার প্রভাবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই এক আধ্যাত্মিক মনন গড়ে উঠেছিল। তাঁর মামা খুব গুণী সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় নিজের পরিবারে ছোট বয়স থেকেই মা ও জ্যাঠাইমাকে স্বাধীনভাবে কাজ-কর্ম করতে দেখেছিলেন। অন্যদিকে তাঁর জ্যাঠাইমা খেলাধুলো, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে নিজের প্রসাধন সম্পর্কেও সঞ্জীবকে উৎসাহ এবং সচেতনতা জুগিয়েছিলেন।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “গাড়ি যেমন পেট্রোলে চলে, মানুষ তেমনি চলে আশীর্বাদে। পূর্বপুরুষরা আশীর্বাদ না করলে জীবনকে চালাতে হয় ঠেলে ঠেলে।” সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে, পরিবারের সকলের আশীর্বাদেই তিনি নিজের জীবনে কোনও বিরতি না টেনে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali
শিক্ষাজীবন, Educational life
১৯৪৭ সালে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বরানগরের কুঠিঘাট সংলগ্ন ভিক্টোরিয়া বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তখনকার সময়ে নিজ বাড়িতেই ছেলে- মেয়েদেরকে প্রাথমিক পড়াশোনা শিখিয়ে নিয়ে একটু বয়স হলেই তাদেরকে স্কুলে ভর্তি করানো হত।
উক্ত স্কুলে পাঠকালে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ফরিদপুরের দীনেশবাবুকে, যার শিক্ষণ-নৈপুণ্যে ইতিহাস বিষয়ের প্রতি খুব আগ্রহ পান তিনি। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে রসায়ন বিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়াশুনা করেন।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, Best biography of Manik Bandopadhyay in Bengali
কর্মজীবন, Career
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। এছাড়া সরকারি চাকরিও করেছিলেন বেশ কিছু দিন। রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার কাজ করতেন তিনি। পরবর্তীতে বিখ্যাত একটি রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানে এনালিস্টের চাকরিও করেছিলেন।
উক্ত স্থানে কর্মরত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রথমবার একটি রম্য রচনা লিখেছিলেন। এই লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিল একটি সিনেমা পত্রিকায়। সরকারি চাকরিতে কাজ করার সময় বেতার এবং দূরদর্শনের নানা শিল্পসংক্রান্ত লেখাও লিখতেন তিনি। রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সময়কালে তিনি সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য নিজের মনস্থির করে নেন। তবে শেষ অবধি এই পরিকল্পনা সফল হয়নি।
এরপর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ‘ক্যালকাটা কেমিক্যালস’ কোম্পানিতে একজন কেমিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে তিনি সেই সময়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নিকট সঙ্গীত শিখতে শুরু করেছিলেন। অতঃপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্তর্ভুক্ত “কটেজ অ্যান্ড স্মল স্কেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট” এর সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হন তিনি। উক্ত চাকরির সূত্র ধরেই পাবলিক রিলেশনশিপ ম্যানেজারের পদ অধিকার করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি, পাশাপাশি আরও বহু অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর।
পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা জীবনী, Best biography of Meghnad Saha in Bengali
সাহিত্যে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কারুকার্য, Literary achievement
শুধুমাত্র রঙ্গময় তথা ব্যঙ্গধর্মী লেখাই নয়, বরং নানা ধরনের লেখার দিক থেকে পারদর্শী ছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য রচনার টানে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার অন্তর্গত দেশপত্রিকায় যোগ দেন।
পরবর্তীতে তিনি সেই পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবেও কাজ করে ছিলেন। তাঁর প্রথম প্রকাশ করা লেখা ছিল একটি গল্প, যার নাম – ‘সারি সারি মুখ’। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক ভাবে প্রথম সুদীর্ঘ লেখা প্রকাশ পায় ‘দেশ’ পত্রিকায়, সেক্ষেত্রে তিনি সঞ্জয় ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। উক্ত লেখার শীর্ষক ছিল ‘জীবিকার সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ’।
এছাড়াও তিনি বেশ কিছু উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল ‘পায়রা,’ যা শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচনার হাস্যরসের সাথে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ মেশানো থাকে। ছোটদের জন্য তার লেখাগুলিও খুবই জনপ্রিয়। তার সৃষ্ট ছোটদের চরিত্রের মধ্যে বড়মামা সিরিজ কাহিনি অন্যতম।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ, Notable works of Sanjib Chattopadhyay
সাহিত্যিক তথা রম্য রচনার সেরা লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বহু প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, আধ্যাত্মিক রচনা, রম্য রচনা ইত্যাদি লিখেছিলেন। তাঁর রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম কিছু লেখা হল:
● আহাম্মক,
● দীনজনে,
● একা, বাড়িবদল,
● দ্বিধা,চিড়িয়াখানা,
● মিলেনিয়াম,
● দ্বিতীয় পক্ষ,
● আড়ং ধোলাই,
● যদি হই মুখ্যমন্ত্রী,
● শাখা প্রশাখা
● শ্বেতপাথরের টেবিল
● জুতো চোর হইতে সাবধান,
● বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুল,
● গুপ্তধনের সন্ধানে ইত্যাদি৷
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের রচিত অন্যান্য কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা হল :
● ‘ক্যানসার’,
● ‘দুটি চেয়ার,
● ‘রশে বশে,
● ‘তুমি আর আমি,
● ’একা একা’,
● ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই,
● ‘শিউলি,
● ‘মাপা হাসি চাপা কান্না,
● ‘উজান বেয়ে যাই,
● ‘হালকা হাসির চোখের জল’ ইত্যাদি।
তাছাড়াও মেজমামা এবং বড়মামা নামক দুইটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত তাঁর সকল গল্পগুলি একই গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে, এবং গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মামা সমগ্র’। এছাড়াও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বহু পত্র-পত্রিকায় রামকৃষ্ণদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের জীবন অবলম্বনে বহু লেখা নিয়মিত লিখে গেছেন। উক্ত লেখাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘পরমপদকমলে’ নামক রচনা, যা পরবর্তী সময়ে গ্রন্থ আকারেও প্রকাশ করা হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, Best Biography of Tarashankar Bandyopadhyay in Bengali
লেখকের পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা, Interesting real life experience of the author
কথায় আছে মানুষের বয়স যত বাড়ে, তার সাথে অভিজ্ঞতাও তত বাড়তে থাকে। এই সাহিত্যিক নিজের জীবনের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ শাসনকাল দেখেছিলেন। দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও। আশেপাশে ভীষণ রকম দুর্ভিক্ষ পরিদর্শন করেছিলেন তিনি। এমনকি ১৯৪২-সালের বিরাট ঝড় তথা জনগণের আন্দোলন দেখেছিলেন তিনি।
তিনি সাক্ষী ছিলেন দেশ বিভাগ কালীন সময়েরও। পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভের আনন্দও উপভোগ করেছিলেন। তিনি নিজের এক রচনায় উল্লেখ করেছিলেন যে, “বছরে বছরে গাছের পাতা ঝরে আবার নবীন পাতার দল হেসে ওঠে; কিন্তু জীবন থেকে সময়ের পাতা শুধু ঝরতেই থাকে, পায়ের তলায় জমে ওঠে অভিজ্ঞতার স্তূপ।” এত শত অভিজ্ঞতার বোঝা সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বহন করে আসছেন বহু বছর ধরে।
ভিক্টোরিয়াতে পাঠরত থাকাকালীন ‘দেওয়াল’ নামক এক পত্রিকায় ‘ভবিষ্যতে আমরা’-বিষয়ের জন্য জাতির জনক গান্ধীজির জীবনী লেখার ভার বালক সঞ্জীবের উপর পড়েছিল। এই লেখার জন্য গান্ধীজির আত্মজীবনী এবং জীবনী ইত্যাদি নিয়ে পড়াশুনা করার পাশাপাশি সাধু-সন্তদের জীবনের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ জন্মায়। এর প্রভাবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মনে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করার ইচ্ছা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনী, Best Biography of Hemant Mukherjee in Bengali
সাহিত্যিকের প্রাপ্ত পুরস্কারের তালিকা, Awards and recognition
সাহিত্য জগতে অশেষ অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
● ১৯৮১ সালে প্রাপ্ত আনন্দ পুরস্কার।
● ২০১৮ সালে ৮২ বছর বয়সী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় “শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন” নামক ছোটগল্প লিখেছিলেন যার জন্য তিনি সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
● ২০১২ সালে,পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক তিনি ‘ বঙ্গবিভূষণ ‘ পুরস্কারে ভূষিত হন।
- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী সমূহ | Swami Vivekananda biography and Quotes in Bangla
- হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী ~ Biography of Humayun Ahmed in Bengali
- বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay
উপসংহার, Conclusion
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখার মধ্য দিয়ে প্রসাদগুণের পাশাপাশি এক তীক্ষ্ণ জীবনদৃষ্টি এবং হাস্যরসাত্মক ভাব ফুটে ওঠে যা পাঠকদেরকে আকৃষ্ট করে। মূলত হাসির ও মজার গল্প, উপন্যাস তথা শিশু কিশোরদের জন্য উপযোগী সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে একাধারে গম্ভীর মনোভাবসম্পন্ন সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
FAQ
সাহিত্যের ইতিহাসে রম্য রচনারকারী হিসেবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় বাঙালি লেখক।
১৯৩৬ সালের ২৪ অক্টোবর।
বিখ্যাত উপন্যাসটির নাম হল “লোটাকম্বল”।
১৯৮১ সালে।