পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা জীবনী, Best biography of Meghnad Saha in Bengali   


মেঘনাদ সাহা ছিলেন একজন ভারতীয় তথা বাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। শিক্ষাজীবনে তিনি মূলত গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও, পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয় সম্পর্কেও প্রভূত গবেষণা করেছিলেন তিনি। মেঘনাদ সাহা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ‘তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তাঁর আবিষ্কার করা সাহা আয়নীভবন সমীকরণটি সুদূর আকাশে থাকা নক্ষত্রের রাসায়নিক এবং ভৌত ধর্মগুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা জীবনী

ভারতবর্ষে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা করার জন্য তিনি ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অসীম অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৭ সালে লন্ডনের ‘রয়াল সোসাইটি’ তাঁকে এফআরএস (FRS) অর্থাৎ Fellow of Royal Society হিসেবে নির্বাচিত করেছিল।

পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity 

 জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণার প্রবাদ পুরুষ মেঘনাদ সাহার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৩ সালের ৬ ই অক্টোবর। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত কালিয়াকৈর উপজেলায় অথবা বলা যায় বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার অদূরে অবস্থিত শ্যাওড়াতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতার নাম ছিল জগন্নাথ সাহা, যিনি পেশাগত ভাবে ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গ্রামের বাজারে তাদের একটি মুদির দোকান ছিল। সেই দোকানটির মধ্য দিয়ে সামান্য আয়ে কায়ক্লেশে পরিবারের ভরণপােষণ চলত। মাতার নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী।

পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জন্ম ও পরিবার পরিচয়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- এর জীবনী, Best Biography of Sunil Gangopadhyay in Bengali

বিজ্ঞানীর শৈশবকালের বিবরণ, Childhood days of the scientist 

 বর্ণপরিচয়ের শিক্ষা শেষে মেঘনাদকে তাঁর গ্রামে থাকা একটি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি পিতার সাথে মুদি দোকানে বসাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। পড়াশুনার প্রতি মেঘনাদের প্রবল আগ্রহ ছিল, তাই দোকানের কাজের সাথে তাঁকে স্কুলে যাওয়ার সুযােগও করে নিতে হত। 

বিজ্ঞানীর শৈশবকালের বিবরণ

তখনকার সময়ে সমাজের ধর্মগোঁড়া উচ্চবংশীয় অহংকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিদ্যমান কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে এবং শৈশব ও কিশোর বয়সে বিভিন্ন সময়ে জাতপাতের শিকার হওয়ার কারণে মেঘনাদের হৃদয়ে বৈদিক হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির প্রতি বিরক্তি বোধ জন্মেছিল।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার শিক্ষাজীবন, Educational life 

মেঘনাদ সাহা ছেলেবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। পারিবারিক কাজকর্ম সেরে পড়াশােনার জন্য যে সামান্য সময়টুকু তিনি পেতেন , তাতেই তাঁর স্কুলের পাঠ তৈরি করে নিতেন। এইভাবে করে পিতার সাথে মুদি দোকানের কাজ এবং পড়াশােনার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করেছিলেন তিনি, যদিও পিতা ছোটবেলা থেকেই মেঘনাদের বিদ্যাশিক্ষা অপেক্ষা তাদের দোকানের কাজকর্ম শেখাটাই বেশি আবশ্যক বলে মনে করতেন।

কিন্তু ছেলের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ দেখে মা এবং দাদার চেষ্টায় পড়াশুনায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান মেঘনাদ। তাছাড়া তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইতিহাস ও গণিত বিষয়ে তাঁর মেধার কথা পিতার কাছে প্রকাশ করলে পিতা তাঁর পড়াশুনার জন্য হাই স্কুলে ভর্তি করতে সম্মত হন। অতঃপর তিনি তাদের শেওড়াতলী গ্রাম থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে অবস্থিত শিমুলিয়ায় মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

উক্ত বিদ্যালয় তৎকালীন সময়ে মিডল স্কুল হিসেবে পরিচিত ছিল, যা চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি অবধি পড়ার স্কুল ছিল। কিন্তু যাতায়াতের অসুবিধার কারণে বিদ্যালয়ের কাছেই এক 

জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার শিক্ষাজীবন

চিকিৎসকের বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, এর বিনিময়ে চিকিৎসকের বাড়ির কিছু কাজকর্ম করে দিতে হতাে মেঘনাদকে। মিডল স্কুল থেকে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি, ফলস্বরূপ বৃত্তি লাভ করেন মেঘনাদ।

সেই বৃত্তি নিয়েই ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। একে একে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ১৯১১ সালে তিনি গণিতে অনার্স নিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকেই ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।

যীশু খ্রীষ্ট জীবনী, Best biography of Jesus Christ in Bengali

অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন, Career as a professor

 ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিখ্যাত আইনজীবী তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং অর্থানুকূল্যে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিত বিভাগের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্যে  রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ উদ্বোধন করেছিলেন।

অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন

উপাচার্য মেঘনাথ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্নাতকোত্তর ফলফল ভাল থাকার কারণে তাদেরকে গণিত বিভাগের প্রভাষক পদে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান মেঘনাদের পছন্দসই বিষয় হওয়ার কারণে উপাচার্যের অনুমতি সহকারে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে আসেন তিনি। ১৯২১ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপকের কাজে নিযুক্ত হন।

তিনি উক্ত কলেজে সাইক্লোট্রান যন্ত্রের ব্যবহার করে পারমাণু গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। 

অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন, Discoveries of Meghnad Saha

 মেঘনাদ সাহা আজীবন তাঁর নিরলস গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন বিষয়গুলোতে আলােকপাত করেছিলেন। ‘থিওরি অব থারমাল’ এবং ‘আয়ােনাইজেশান’ এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘ সাহা সমীকরণ ‘ নামক এক মূল্যবান সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন।

উক্ত সূত্র বিভিন্ন চাপে এবং উষ্ণতায় যে কোনাে পদার্থে আয়নের মাত্রা কতটা হবে তা জানতে সহায়তা করে। অন্যদিকে মেঘনাদ সাহাই “ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স” – এর গােড়াপত্তন তথা গবেষণার সূত্রপাত করেছিলেন। তাছাড়া সাহা সমীকরণের প্রয়ােগ করে সূর্যের বর্ণমন্ডল সংক্রান্ত বহু রহস্য সমাধান হয়ে গিয়েছিল। এইভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। 

অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন

এ আর রহমান এর জীবনী, Best detailed biography of A.R. Rahman in Bengali

দাম্পত্য জীবনের কিছু তথ্য, Married life 

মেঘনাদ সাহা দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন রাধারাণী সাহা কে। পরবর্তী সময় এই দম্পতির ঘরে ৩ জন পুত্র এবং ৪ জন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। পুত্রদের নাম : অজিত, রঞ্জিত, প্রসেনজিৎ; এবং কন্যার নাম: ঊষা, কৃষ্ণা, চিত্রা, সঙ্ঘমিত্রা।

মেঘনাদ সাহার রচিত কিছু গ্রন্থ, Books written by Meghnad Saha

মেঘনাদ সাহা অধ্যাপনার পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বেশ কিছু বিজ্ঞানসম্মত লেখা অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। সেই গ্রন্থগুলোর নাম :

● “ দি প্রিন্সিপাল অব রিলেটিভিটি ‘ , 

● ‘ ট্রিটাইজ অন হিট ’ , 

● ‘ ট্রিটাইজ অন মর্ডান ফিজিক্স ’ , 

● ‘ জুনিয়র টেক্সট বুক অব হিট উইথ মেটিওরােলজি । 

মেঘনাদ সাহার রচিত কিছু গ্রন্থ

মেঘনাদ সাহার অবদান, Contribution of Meghnad Saha 

মেঘনাদ সাহা নিজের অধ্যবসায় এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জীবনের অতি সাধারণ অবস্থা থেকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি কেবলমাত্র একজন বিশ্ববিশ্রুত পদার্থবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে তা নয়, বরং ভারতের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সহ ভারতের নদীবিজ্ঞানের গবেষণার সূত্রপাতও মেঘনাদের আন্তরিক চেষ্টার ফলে সুস্পষ্ট রূপ নিয়েছিল।

মেঘনাদ সাহার দূরদৃষ্টি এবং সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই “দামােদর ভ্যালি কর্পোরেশন” গড়ে উঠেছিল। তিনি ভারতীয় নদী নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটির একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ফলস্বরূপ নদীর ভয়ঙ্কর বন্যার সমস্যা থেকে জনগন এবং অন্যান্য প্রাণী ও গাছপালাগুলো রেহাই পেয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার করার ক্ষেত্রেও মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য।

মেঘনাদ সাহার অবদান

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জীবনী, Best biography of Bill Clinton in Bengali

মেঘনাদ সাহা’র প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, Notable awards received by Meghnad Saha

বিজ্ঞান জগতে প্রভূত অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল :

● ফেলো অফ দ্য রয়েল সোসাইটি

● গ্রিফিথ পুরস্কার (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

মেঘনাদ সাহার জীবনাবসান, Death of the renowned physicist

 মেঘনাল সাহা ১৯৫৬ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬৩ বছর। তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই সময় তিনি নিজের কর্মস্থল ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভবনের পরিকল্পনা কমিশনের দিকে যাচ্ছিলেন; তাঁকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নেওয়ার পর সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে মারা যান তিনি। তিনি মৃত্যুর প্রায় ১০ মাস পূর্ব থেকেই উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। 

মেঘনাদ সাহার জীবনাবসান

উপসংহার, Conclusion 

মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন নিজের দেশকে, জাতিকে, তথা দেশের অর্থনীতিকে। বিশ্বের দরবারে বিজ্ঞান বিষয়ে আমাদের যে বিশেষ কিছু গর্ব করার মত জায়গা রয়েছে, সেই খানে মেঘনাদ সাহার নামও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অবদানের মধ্য দিয়ে তিনি সর্বদাই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Frequently asked questions:

মেঘনাদ সাহার জন্ম কবে হয় ?

অক্টোবর ৬ ১৮৯৩ সালে ।

মেঘনাদ সাহার পিতামাতার নাম কী ?

 জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবী ।

মেঘনাদ সাহার উল্লেখযোগ্য পুরস্কার কী ?

 ফেলো অফ দ্য রয়েল সোসাইটি।

মেঘনাদ সাহার স্ত্রীর নাম কী ?

রাধারাণী সাহা ।

মেঘনাদ সাহার পরিচিতির কারণ কী ?

তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব, সাহা আয়নীভবন সমীকরণ, হিন্দু বর্ষপঞ্জি সংস্কার, ভারতের নদী পরিকল্পনা ।

মেঘনাদ সাহা কবে মারা যান ?

১৯৫৬ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি ।

Recent Posts