ডঃ বিক্রম সারাভাইয়ের সম্পূর্ণ নাম বিক্রম আম্বালাল সারাভাই, যিনি ছিলেন ভারতের প্রথিতযশা একজন পদার্থবিজ্ঞানী তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর প্রভূত অবদান রয়েছে। এছাড়াও তিনি ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO এর প্রাণপুরুষ। বিক্রম সারাভাইয়ের প্রচেষ্টাতেই আমাদের দেশ আজ মহাকাশে পাড়ি জমানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তাই তিনি ভারতের অন্তরীক্ষ গবেষণার জনক হিসেবেও সুপরিচিত।
বিক্রম সারাভাইয়ের জন্ম ও শৈশবকাল, Birth and Childhood of Vikram Sarabhai
বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের গুজরাট রাজ্যের আমেদাবাদ শহরে। তাঁর জন্ম হয় ১৯১৯ সালের ১২ আগস্ট। তাঁর পিতার নাম ছিল আম্বালাল সারাভাই এবং মাতার নাম সরলা দেবী। বিক্রম আমদাবাদের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে এই সারাভাই পরিবার ছিল সেই অঞ্চলের অন্যতম বিখ্যাত ব্যবসায়ী পরিবার। তাঁর পিতা উত্তরাধিকার সূত্রে দুইটি কাপড় মিলের মালিকানা লাভ করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের অবদান ছিল। যদিও এই পরিবারের ছেলে হয়েও বিক্রমের আকর্ষণ ছিল বহুমুখী যা ছিল বিজ্ঞান থেকে ক্রীড়া হয়ে সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।
শ্যামল মিত্রের জীবনী, Best biography of eminent singer Shyamal Mitra in Bengali
শিক্ষাজীবন, Education
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বিক্রম সারাভাই আমেদাবাদের গুজরাত কলেজে ভর্তি হন, সেখান থেকে তিনি বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং সেখানকার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪০ সালে ন্যাচারাল
সায়েন্স বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর কেমব্রিজেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রির উদ্দেশ্যে গবেষণার কাজ শুরু করে দেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যার কারণে তাঁর পড়াশোনা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ১৯৪৫ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে এবং ভারতে থেকেই নিজের গবেষণার কাজ কে এগিয়ে নিয়ে যান।
কেমব্রিজ থেকে দেশে ফিরে বিক্রম স্যার সি ভি রামনের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সময় ব্যয় না করে স্যার সি ভি রামনের তত্ত্বাবধানেই গবেষণার কাজ শুরু করে দেন। কিছু সময় পর তিনি ফের কেমব্রিজে চলে যান এবং সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ‘কসমিক রে ইনভেস্টিগেশনস ইন ট্রপিক্যাল ল্যাটিচিউডস’ বিষয়ে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী, Best biography of renouned author Sanjib Chattopadhyay in Bengali
কর্মজীবন এবং গবেষণার সময়কালীন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Various experiences during career and research
বিক্রম সারাভাই ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশে ফিরে এসে নিজের পরিবার এবং বন্ধুদের সহায়তায় আমদাবাদে ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর গড়ে তোলেন ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ (PRL)। এই সংস্থা-ই ছিল ইসরোর পূর্বসূরি। কিন্তু তিনি এখানেই থেমে যান নি, কিছু কাল পর, ১৯৬৬ সালে তিনি ঔষধ তৈরির প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে বরোদায় কমিউনিটি সায়েন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার হিসেবে সুপরিচিত।
এগুলো ছাড়াও তিনি নিজের শহর আমদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অপারেশান্স রিসার্চ গ্রুপ’ নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এছাড়াও ‘নেহেরু ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’, ‘ফাস্ট ব্রিডার টেস্ট রিঅ্যাক্টর’, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এবং দর্পণ অ্যাকাডেমি সহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।
অন্যদিকে আমেদাবাদের ‘নেহেরু ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’, কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন প্রজেক্ট’, হায়দ্রাবাদের ‘ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এবং ঝাড়খন্ডে অবস্থিত ‘ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’ প্রমুখ প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করার ব্যাপারে তিনিই প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের মূল ক্ষেত্রও ছিল সৌরজগত অধ্যয়ন, পৃথিবী এবং গ্ৰহ বিজ্ঞান।
পরবর্তী সময়ে পদার্থবিদ্ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার মৃত্যুর পর বিক্রম সারাভাই ১৯৬৬ সালে অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনিই ভারতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টস প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর উন্নতিকরণের ক্ষেত্রেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। শিক্ষা এবং নিজের দেশের নানা ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্য বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
এমনকি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও দেশীয় নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। কর্মক্ষেত্রে তিনি যেসব বিশেষ কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, সেগুলো হল :
● পদার্থবিদ্যা বিভাগের সভাপতি, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস (1962)।
● I.A.E.A. ও ভিয়েনা এর সাধারণ সম্মেলনের সভাপতি, (1970)।
● ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান (1966-1971)।
● ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক চতুর্থ জাতিসংঘ সম্মেলনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (1971)।
● স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার,প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান (1963-1971)।
বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali
বিক্রম সারাভাইয়ের বৈবাহিক জীবন, Married Life
বিক্রম সারাভাইয়ের বিবাহ করেছিলেন মৃণালিনী স্বামীনাথনকে। কেরালার বাসিন্দা মৃণালিনী ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের একজন সুখ্যাত শিল্পী। পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির কোল আলো করেছিল তাঁদের এক কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান। এই দম্পতির তাঁদের পুত্রের নাম রেখেছিলেন কার্তিকেয় সারাভাই এবং কন্যার নান মল্লিকা সারাভাই। মল্লিকাও পরবর্তীতে মায়ের অনুপ্রেরণায় নৃত্য জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন।
বিক্রম সারাভাইয়ের জীবনাবসান, Death of Vikram Sarabhai
বিক্রম সারাভাই ১৯৭১-সালের ডিসেম্বর মাসে একটি রুশ রকেটের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য কেরলের কোভালামে গিয়েছিলেন। এছাড়াও সেই বছরই তিনি থুম্বা রেলস্টেশনের উদ্বোধনও করেন। সেইখানেই ৩০ ডিসেম্বরে, মাত্র ৫২ বছর বয়সকালে বিক্রম সারাভাইয়ের মৃত্যু হয়। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়ে গেছে আজও।
বিশেষজ্ঞ ও বহু বিজ্ঞানীদের অনেকেরই অভিমত যে, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। উদ্বোধনের পর তিনি যে অতিথিশালার ছিলেন সেখানে একটি ঘরেই ৩১ ডিসেম্বর সকালে বিক্রম সারাভাইয়ের নিথর দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর দেহে কোনও রকম আঘাতের চিহ্ন ছিল না।
এই অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কে কোনও তদন্ত করা হয়নি; অথচ বেঁচে থাকাকালীন সময়ে তিনি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে বিমানে যাত্রাকালে তাঁর পাশের আসনটি ফাঁকাই রাখা হত, এছাড়া ট্রেন দিয়ে সফর করার সময় গোটা একটা কুপই তাঁর জন্য বুক করে নেওয়া হতো। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকেও কোন তদন্ত দাবি করা হয়নি, পরবর্তীকালে ছেলে কার্তিকেয় জানিয়েছিলেন যে তাঁদের ঠাকুমা সরলাদেবীর ইচ্ছে ছিলনা যে ছেলের মৃতদেহ নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হোক।
সলিল চৌধুরীর জীবনী, Best Biography of Salil Chowdhury in Bengali
বিজ্ঞানীকে প্রদত্ত সম্মান, Honors given to scientist
● ডঃ বিক্রম সারাভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ থেকে তাঁর নামে এক ডাকটিকিট চালু করা হয়েছিল।
● ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে চাঁদের এক গহ্বরের নাম ‘সারাভাই ক্রেটার’ রাখা হয়। চাঁদের ২৪.৭ ডিগ্রি উত্তরে এবং ২১.০ ডিগ্রি পশ্চিমে গোল বাটির মতো একটি গর্ত রয়েছে যার ব্যাস ৮ কিলোমিটার, গভীরতার দিক থেকে গহ্বরটি ১.৭ কিলোমিটার গভীর। এটিই সারাভাই গহ্বর নামে পরিচিত।
● বিক্রম সারাভাই কে সম্মান জানিয়ে ২০১৯ সালের চন্দ্রযান টু-এর ল্যান্ডারের নামকরণ করা হয়েছিল ‘বিক্রম’ নামে।
● বিক্রম সারাভাই এর জীবন কাহিনী নিয়ে সুখ্যাত লেখিকা অমৃতা শাহ ‘বিক্রম সারাভাই- এ লাইফ’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন৷
কিশোর কুমার এর জীবনী, Best biography of Kishore Kumar in Bengali
বিক্রম সারাভাই এর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা, Awards and Recognition
জীবদ্দশায় দেশের তথা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনস্বীকার্য অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে ড. বিক্রম সারাভাই প্রভূত খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিলেন। তাঁর অর্জিত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
● ১৯৬৬ সালে পদ্মভূষণ সম্মান অর্জন করেন।
● ১৯৭২ সালে তিনি মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ খেতাব অর্জন করেন।
উপসংহার, Conclusion
ব্রিটিশদের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মহাসড়ক তৈরি করার কাজে যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ আত্মনিয়োগ করেছিলেন, প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বিজ্ঞানকে বিভিন্ন ভাবে কাজে লাগিয়ে উপমহাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোচন করার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী সমূহ | Swami Vivekananda biography and Quotes in Bangla
- হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী ~ Biography of Humayun Ahmed in Bengali
- বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay
Frequently Asked Questions :
বিক্রম আম্বালাল সারাভাই, যিনি ছিলেন ভারতের প্রথিতযশা একজন পদার্থবিজ্ঞানী তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর প্রভূত অবদান রয়েছে।
১৯১৯ সালের ১২ আগস্ট
১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর
-মৃণালিনী স্বামীনাথন।