প্রত্যেকেরই তার জীবদ্দশায় চারধাম পরিদর্শন করা উচিত। হিন্দু পুরাণ বলে চারধাম যাত্রা করলে সব পাপ মুছে যায়। জীবনে বার বার চার ধাম যাত্রা করার সুযোগ আসে না। তবে যদি কখনও আসে তখন সেই সুযোগ হাতছাড়া না করাই উচিত। এই যাত্রার পথ দীর্ঘ তথা কঠিন হলেও শেষপর্যন্ত লক্ষ্যপূরণ হলে এক বড় প্রাপ্তিও থাকে।
যাত্রা কিভাবে শুরু করবেন, How to start the journey
তীর্থযাত্রীরা মূলত হরিদ্বার থেকেই তাদের চার ধাম যাত্রা শুরু করেন। হরিদ্বার থেকেই যমুনোত্রী যেতে হয়। সেখান দিয়ে প্রবাহিত পবিত্র যমুনা নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করার পর শুরু হয় ভ্রমণার্থীদের তীর্থযাত্রা। প্রথম যাত্রা হয় গঙ্গোত্রীর দিকে। তারপর সেখান থেকে যেতে হবে কেদারনাথ। সর্বশেষে ধাম হল বদ্রীনাথ। এই যাত্রাপথে অজস্র বিখ্যাত মন্দিরও দর্শন করতে পারবেন। সেই মন্দিরগুলিতে গিয়ে পূজো করেন অনেকেই। তাছাড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই। এই সবকিছুর মাধ্যমেই নিজের মন আর শরীরকে পরিশোধন করে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
ভ্রমণ নিয়ে উক্তি, বানী, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, Best quotes on travelling in Bengali
প্রতিটি ধাম সম্পর্কে কিছু তথ্য, Information about Char Dham
প্রথম ধাম: যমুনোত্রী, Yamunotri
যমুনা নদীর কাছে নিবেদিত করা হয়েছে এই শহর। অনেকের মতে কালিন্দী নামের এক পর্বত হল যমুনা নদীর উৎস। হিন্দুপুরাণ অনুসারে, যমরাজের বোন হলেন যমুনা। ভাইফোঁটার সময় যমরাজ বোনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে ব্যক্তি যমুনা নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করবে, তাকে কখনও যমলোকে যেতে হবে না। সে পরিত্রাণ পাবে। তাই দেবী যমুনা এখানে পূজিত হন।
যমুনোত্রী যেতে হলে জানকিচট্টি থেকে কম সময়ে পৌঁছতে পারেন। তীর্থযাত্রীরা চাইলে টাট্টুতে চড়ে অথবা পালকিতে চেপেও যমুনোত্রী যেতে পারেন। যেভাবেই যাওয়া হোক, এক্ষেত্রে জন প্রতি খরচ পড়ে ৫০০ থেকে প্রায় ১২০০ টাকার মতো। এখানকার প্রধান মন্দির ছাড়াও আরো বেশ দেখার জায়গা রয়েছে। যেমন সুর্যকুণ্ড, সপ্তর্ষিকুণ্ড এবং জানকিচট্টিও। ট্রেকিংয়ের জন্য অন্যতম উপযুক্ত জায়গা হল জানকিচট্টি।
ভারতের ১০ টি স্থানে ভ্রমণ করুন কম খরচে, Travel India’s best places with low budget in Bengali
দ্বিতীয় ধাম: গঙ্গোত্রী, Gangotri
উত্তরকাশী জেলায় গঙ্গোত্রীর অবস্থান, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গঙ্গোত্রী অঞ্চলের মূল বৈশিষ্ঠ্য হল চোখকে প্রশান্তি দানকারী সবুজের সৌন্দর্য্য আর বিশুদ্ধ জল। হিন্দু পুরাণের মতে গঙ্গোত্রীই হল গঙ্গা নদীর উৎস।
গঙ্গোত্রীর জল প্রবাহিত হয়েছে চার ধামের পরের দু’টি শহরের মধ্যে দিয়েও, প্রথমে বদ্রীনাথ হয়ে, তারপর কেদারনাথে। গঙ্গোত্রীতে রয়েছে গঙ্গোত্রী মন্দির এবং উষ্ণ প্রস্রবন গাঙনানি যার জলে রয়েছে গন্ধক; যা ব্যথা, বেদনা উপশম করার উপাদান।
যুগ যুগ ধরে মানুষের বিশ্বাস যে, গঙ্গোত্রী উৎসে একবার স্নান করলে জীবনের সব পাপ ধুয়ে যায়। রাজা ভগীরথ এই পবিত্র স্থানেই ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়েই দেবী গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে এসে পতিত পাবনী রূপে মর্তে প্রবাহিত হন। রাজা যে পাথরের উপর বসে দীর্ঘ সময় ধরে তপস্যা করছিলেন, সেই পাথরের উপরই মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে ।
তৃতীয় ধাম: কেদারনাথ, Kedarnath
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুপ্তকাশী জেলায় রয়েছে কেদারনাথ ধাম। অনেকগুলো পাহাড় পার হয়ে, কখনও বা চোখজুড়োনো সবুজের হাতছানি, আবার কখনও উষ্ণ ঝরনার স্রোত, অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক সীমাহীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে কেদারনাথ পৌঁছনো যায়।
অনেকের বিশ্বাস যে শিবের দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের মধ্যে কেদারনাথ হল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে আপনি দেখতে পাবেন ভৈরব মন্দির, মহাপন্থ ইত্যাদি এবং ওপরের দিকে আছে সাতোপন্থ—যাকে স্বর্গে যাওয়ার প্রবেশদ্বার বলা হয়।
তবে কেদারনাথ ধাম দর্শন করার জন্য আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করে রাখা আবশ্যিক। অফলাইনে হোক অথবা অনলাইন, দুই ভাবেই রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেন। সেক্ষেত্রে যাত্রীকে একটি ট্রিপ কার্ড দেওয়া হয়।
এই কার্ড গোটা যাত্রায় নিজের সঙ্গে রাখতে হবে। অনলাইনে https://uttarakhandtourism.gov.in/ এই সাইটের মাধ্যমে বুকিং করতে পারবেন। অন্যদিকে যাত্রীর মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও থাকা জরুরি। গুপ্তকাশী বা শোনপ্রয়াগের কোনো মেডিক্যাল সেন্টারে গিয়ে ডাক্তারের থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই কেদারনাথ ভ্রমণে যাওয়া সম্ভব। যদি কারও রিপোর্টে কোনও কঠিন অসুখ বা ব্যাধির উল্লেখ থাকে তবে উক্ত ব্যক্তির হেঁটে কেদারনাথ যাওয়া উচিত হবে না। সেক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের সাহায্যেও কেদারনাথে যাওয়া সম্ভব।
চতুর্থ ধাম: বদ্রীনাথ, Badrinath
এই পবিত্র শহর গাড়োয়াল হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত। অলকানন্দা নদীর তীরে স্থিত বদ্রীনাথ মন্দির ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে সমর্পিত। বদ্রীনাথের মন্দিরে যাওয়ার জন্য জোশীমঠ থেকে একটি গাড়ি ভা়ড়া করতে হবে।
তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গাড়িগুলোকে বদ্রীনাথ যেতে দেওয়া হয়। যেমন সকালে ৬-৭, ৯-১০,১১-১২, আবার দুপুরে ২-৩ এবং বিকেলে ৪.৩০-৫.৩০ অবধি। এছাড়াও মন্দিরের ভেতরে ঢোকার জন্য লাইন থাকে। প্রতি বছরের এপ্রিল থেকে মে মাস অবধি মন্দিরটি খোলা থাকে এবং নভেম্বর থেকে বন্ধ থাকে।
যাত্রার পূর্বে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে, Things to keep in mind before traveling
● পূর্নার্থীদের এই তীর্থযাত্রা শুরু করার পূর্বে মন্দির দর্শনের সঠিক সময় সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো। সাধারণত চার ধাম যাত্রা এপ্রিল বা মে মাস থেকে শুরু হয় এবং শেষ হয় অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাসের দিকে। সাধারণত মে ও জুন মাসে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকে। তবে কেউ চাইলে সেপ্টেম্বর মাসেও যাত্রার পরিকল্পনা করতে পারেন। তাতে হয়তো ভিড়ের দাপট তেমন বেশি সহ্য করতে হবে না।
● তীর্থযাত্রা শুরুর মাস দু’য়েক আগে থেকে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। চারধাম যাত্রায় যাওয়ার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ ও ফিট থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অনুশীলনে মনোযোগ দিতে হবে। এসবের পাশাপাশি চিকিৎসকের মতামত নিয়ে জরুরি ওষুধপত্র সঙ্গে নিতেও ভুলবেন না।
চার ধাম কিভাবে যাবেন, How to reach Char Dham
ভারতীয় রেলের পরিষেবার সহায়তায় স্বল্প খরচেই এই চার ধাম যাত্রা করতে পারবেন। নাগপুর, মুম্বই এবং সুরাট থেকে চারধামের যাত্রা করা যাবে। ১২ দিন ও ১১ রাতের এই সম্পূর্ণ তীর্থ ভ্রমণে যাত্রীদের যেসব জায়গায় ঘোরানো হবে সেগুলি হল, হরিদ্বার – বর্কত – জানকিচট্টি – যমুনোত্রী – উত্তরকাশি – গঙ্গোত্রী – গুপ্তকাশি – শোন প্রয়াগ – কেদার এবং বদ্রী।
এই যাত্রায় খরচও তেমন বেশি হবেনা। কেউ যদি একা এই তীর্থ যাত্রায় সামিল হয় তবে খরচ হবে প্রায় ৭৭,৬০০ টাকার মত। তবে একজনের বেশি যদি কেউ এই পরিষেবার দ্বারা ভ্রমণে যান, সেক্ষেত্রে জনপ্রতি তাদের খরচ পড়বে প্রায় ৫৮,৯০০ টাকার মত। তবে যাত্রীরা এই পরিষেবা ছাড়া অন্যভাবেও যাত্রা করতে পারেন নিজের সুবিধা অনুসারে।
চার ধামে থাকা খাওয়ার সুবিধা, Lodging facilities at Char Dham
তীর্থ স্থানগুলোর আশেপাশে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে অনেক কম খরচেই যাত্রীরা রাত্রিযাপন করতে পারবেন, পাশাপাশি খাওয়া দাওয়াও করতে পারবেন।
● যমুনোত্রী ধামের কাছে থাকার ব্যবস্থা খুব কম সংখ্যক রয়েছে। তবে জাঙ্কি চটি, সায়না চটি, বারকোট এবং হনুমান চট্টির মত জায়গাগুলিতে যাত্রা পথকে ঘিরে থাকা বাজেটের হোটেল ও লজ পেয়ে যেতে পারেন। এছাড়া আরো কিছু থাকার জায়গার মধ্যে রয়েছে হোটেল সম্রাট, চৌহান অ্যানেক্সি, করণ প্রাসাদ।
● কেদারনাথ ধাম ভ্রমণ করতে গেলে বহু বাজেটের আবাসন হোটেল, ডিলাক্স হোটেল ও লজ পর্যটকদের একটি অভিজাত পরিষেবা প্রদান করে। রুদ্রপ্রয়াগ এবং গুপ্তাক্ষী পকেট থেকে শুরু করে বিলাসবহুল হোটেল সহ ছোটো বড় প্রচুর সংখ্যক হোটেল আছে।
এছাড়াও চরধাম ক্যাম্প, হোটেল প্রিয়দর্শনী, মোনাল রিসর্টের মত কয়েকটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা পেয়ে যাবেন। এছাড়াও, কেদারনাথ ধামে ভ্রমণের সময় অসংখ্য ধর্মশালার সন্ধান পাওয়া যায়।
● ভোলাগিরি আশ্রম, মানব কল্যাণ আশ্রম, পরমথ লোক আশ্রম ইত্যাদি কয়েকটি ধর্মশালা / আশ্রম রয়েছে যা বদ্রীনাথ ধামে আসা দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দরভাবে থাকার ব্যবস্থা করে। তাছাড়াও কাছাকাছি অনেকগুলি বাজেট, ডিলাক্স ও বিলাসবহুলও হোটেল রয়েছে ।
● গঙ্গোত্রী যাওয়ার ক্ষেত্রে থাকার ব্যবস্থার জন্য উত্তরকাশিতে যাওয়াই সঠিক হবে। সেখানে একান্ত রিসর্ট, মহিমা রিসোর্ট, শিখর নেচার রিসর্ট এবং আরও বেশ কিছু রিসর্ট রয়েছে। তাছাড়াও থাকার ব্যবস্থা করার জন্য অনেক শিবির এবং কম বাজেটের আবাসন হোটেলগুলি রয়েছে।
- কলকাতার ২১ টি দর্শনীয় স্থান, যেখানে না গেলে বাকি থেকে যায় কলকাতাকে চেনা
- ব্যাঙ্গালোরের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলির লিস্ট ~ বাংলাতে ব্যাঙ্গালোর ভ্রমণ গাইড
- ভ্রমণপিপাসুদের জন্যে রইলো হায়দ্রাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলির সম্পর্কে সমস্ত তথ্য
- বিশ্বের অন্যতম ২০ টি দর্শনীয় স্থান
- বাংলাদেশের ১৫ টি সেরা ভ্রমণ স্থান – Best Places to visit in Bangladesh [ Bengali Guide ]
উপসংহার, Conclusion
চার ধাম যাত্রা সমস্ত দিক থেকেই আকর্ষণীয়। ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং যাত্রাপথের অন্যান্য বিরল অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে এই যাত্রায়। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে তীর্থযাত্রীদের জন্য এই দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল স্থিত চার ধামের পথ উন্মুক্ত রাখা হয়।