বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার সমস্ত তথ্য, ইতিহাস ~ Essay on Saraswati Puja in Bengali ( PDF )




মাঘের হিমেল হাওয়া যখন হু হু করে বইতে থাকে, কুয়াশা জড়ানো রাত যখন সময়টাকে দীর্ঘায়িত করে ,আমের মুকুল ও গাঁদা ফুলের গন্ধে যখন আকাশ বাতাস মুখরিত হয় ঠিক তখনই দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব হয়। মা সরস্বতী হলেন কলা ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ।

sarasswati puja details in bengali

বাগদেবীর আরাধনা বা সরস্বতী পুজো তাই বাঙালি তথা আপামর ভারতবাসীর প্রাণের উৎসব । সর্বপ্রকার ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে এই পূজা সকল বাঙালির মনে যে বিকাশ ঘটায় তা বাঙালি জাতিকে সারা বছর জুড়ে জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার ইন্ধন জোগায় ।

পূজার ইতিহাস, History of Saraswati Puja

বর্তমানে এই পূজা কেবলমাত্র বাঙালি গৃহস্থের অন্দরমহলে অথবা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ থাকলেও কয়েক শতাব্দী আগে পর্যন্তও সারা বাংলার বুকে এই পূজা ধুমধাম করে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হতো । এই প্রসঙ্গে বর্ধমানের রাজার তত্ত্বাবধান প্রচলিত থাকা বিখ্যাত সরস্বতী পুজোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই পূজা দর্শনের জন্য সমগ্র বাংলা তথা বাংলার বাইরে থেকেও জনসমাগম হতো । এ ছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে জল দিয়ে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার তাড়ি এবং দোয়াত কলম রেখে পুজো করার রীতি প্রচলিত ছিল । তবে শহরের দিকে বিত্তশালীর ব্যক্তিরাই মা সরস্বতীর মূর্তি নির্মাণ করতেন ও আরাধনা করতেন বলে শোনা যায় ।

দেবী সরস্বতীর বর্ণনা ও আচার আচরণ, Description and ritual details of Goddess Saraswati

সরস্বতী বৈদিক দেবী তবে এ যুগেও মা সরস্বতীর পূজা উপাচারের রীতি প্রচলিত আছে । বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে সরস্বতী কেবল জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবীতে পর্যবসিত হলেন। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে দেবী হয়েছেন। প্রতিমাকল্পে দেবী সরস্বতী শ্বেতবর্ণা , দেবী শ্বেতপদ্ম ও শ্বেত রাজহংসের ওপর অধিষ্ঠান করে থাকেন। দেবীর পরিধানে থাকে শ্বেতবস্ত্র ।দেবীর এক হাতে থাকে বীণা তাই দেবীর আরেক নাম বীণাপানি। দেবীর অন্য হাতে থাকে পুস্তক ।দেবীর সর্বাঙ্গে শুভ্রতা বিরাজ করায় দেবীকে শুভ্রতা ও পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করা হয় ।

Saraswati Puja Essay in Bangla

প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে কথিত আছে । ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পাঠশালাগুলিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার পুঁথি ও দোয়াত কলম রেখে দেবী সরস্বতীকে অর্চনা করার প্রথা বিদ্যমান ছিল ।

এই তিথিতে ছাত্র ~ ছাত্রীরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, স্লেট ও দোয়াত কলমে বাগদেবীর পূজার্চনা করত। ‘ম্লেচ্ছ’ ভাষা হিসেবে ইংরেজি পরিগণিত হত বলে সরস্বতী পুজোর দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল তবে গ্রামাঞ্চলে বিংশ শতাব্দীতেও এই প্রথার প্রচলন ছিল ।

সরস্বতী পূজা সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি সরস্বতী পূজার পদ্ধতি, সরস্বতী পূজার মন্ত্র সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।

দেবীর আরাধনা, Worship of Devi Saraswati

শাস্ত্রীয় বিধান মেনে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায় এবং তা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন, অভ্রআবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিস। বাসন্তী রঙের গাঁদা ও পলাশ ফুলও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।

Saraswati Puja Bangla Essay

লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল খায় না এবং পূজার দিন লেখাপড়া নিষিদ্ধ। পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, দোয়াত-কলম, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজান্তে সকলের মঙ্গল কামনার্থে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আপামর বাঙালির মধ্যে । তবে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরাই বিদ্যায়িনী দেবীর পুজোয় মেতে ওঠে। তারা ভক্তিভরে দেবীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে এবং দেবীর কাছে জ্ঞান ও বিদ্যালাভের প্রার্থনা জানায়।

সরস্বতী পূজা সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি সরস্বতী পূজার শুভেচ্ছা সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।

বাংলার সরস্বতী সংস্কৃতি, Saraswati culture of Bengal

বর্তমানে বাংলার সরস্বতী সংস্কৃতি অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা স্বতন্ত্র। আনন্দ প্রিয় বাঙালি এই পুজোকে কেন্দ্র করে আত্ম সংস্কৃতির চর্চায় মেতে ওঠে । শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা হয় । শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব সকাল থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়।

প্রায় সব হিন্দু পরিবারে ই এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃ তর্পণের আয়োজনও করা হয়ে থাকে । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও পরিবেশিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত আবার কোনও কোনও হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পর দিন অরন্ধন পালনের ও প্রথা রয়েছে।

saraswati-puja-1

সরস্বতী পূজা সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি সরস্বতী পূজা রচনা সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।

সরস্বতীর পরিবার, Family of Devi Saraswati

শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবী দূর্গা ও মহাদেবের কন্যা হলেন সরস্বতী। লক্ষ্মী–কার্তিক–গণেশের সহোদরা ভগ্নী। সরস্বতী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সহধর্মিণী, পালনকর্তা বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও ধবংসকর্তা মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে “ত্রিদেবী” নামে পরিচিতা। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করতে সাহায্য করা।

বিভিন্ন নামে দেবী সরস্বতী, Goddess Saraswati by various names

সরস্বতী বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া বাগদেবী, সারদা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, ভারতী প্রভৃতি নামে অভিহিতা।

পূজার আনন্দ, The joy of Saraswati Puja

পূজার আগে

পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় ।পূজা উপলক্ষে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ও বিভিন্ন ক্লাবগুলিতে সুন্দর সুন্দর মণ্ডপ নির্মিত হয় । ছাত্রছাত্রীরা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মণ্ডপ সাজানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। পুজোর আগের দিন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা আনার কাজ চলে। কুমোর বা মৃৎশিল্পীরা ছোট বড় নানা মাপের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেন।

শুক্লা পঞ্চমী

শুক্লা পঞ্চমী র ভোরেই ছাত্রছাত্রীরা স্নান সেরে পরিষ্কার বা নতুন জামাকাপড় পরে পুজোর আয়োজন করতে থাকে। তারপর দেবীর পায়ের কাছে বই ,খাতা ,কলম রেখে পুরোহিতের বলা মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সবাই একসাথে দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দেয়। নানা রকম ফুল দিয়ে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয় যার মধ্যে গাঁদা, পলাশ ফুল, বেলপাতা ইত্যাদি থাকে ।ফলের মধ্যে থাকে- কুল ,কমলালেবু, কলা,আপেল ইত্যাদি ।

পুজোর দিন

পুজোর সময়ে কাঁসর ঘণ্টা ধ্বনি এবং ঢাকের আওয়াজে চারিদিকে গমগম করতে থাকে ।ধূপও ধুনার সুগন্ধে একটা পবিত্র পরিবেশ তৈরি হয় । কোনো কোনো স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এদিন খিচুড়ি খাওয়ারও আয়োজন করে থাকে ।ওই দিন বিকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখার জন্য ভিড় জমে যায়। সন্ধ্যার সময় দেবীর আরতি হয়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নানা রকমের মানুষ ওই অনুষ্ঠানে সামিল হন।

সরস্বতী পূজা সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।

বিসর্জন, Bisarjan

সরস্বতী পুজো মাত্র এক দিনের পূজা তাই পূজার আনন্দ এক দিনেই শেষ হয়ে যায় ।পরদিন সকালে পুরোহিত বিসর্জনের মন্ত্রপাঠ করেন ও তারপর চিড়ে ও দই মেশানো দধিকর্মা নিবেদন করে নিয়মবিধি সমাপ্ত হয়। পূজাশেষে সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। আর তারপর সেই বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সহজেই সরস্বতী মায়ের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চলে আবার বিসর্জনের শেষে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ফিরে আসে।

উপসংহার, Conclusion

প্রতি বছরই দেবী সরস্বতীর আরাধনার দিনটি বিদ্যার্থীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকলে বিদ্যার আলোকে, বুদ্ধিমত্তায় চিরকাল সত্যের প্রতি অনুরাগী থাকার আশীর্বাদ চায়। মনে মনে হলে ও দেবীর কাছে সকলে যেন মিলিতভাবে বলে ওঠে,
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

Essay on Saraswati Puja in Bengali ( PDF )

Download PDF

FAQ (সম্ভাব্য প্রশ্নাবলি )

সরস্বতী পুজোর তিথিটি কী নামে পরিচিত ?

উত্তর: সরস্বতী পুজোর তিথি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত।

পুরাকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ কোন দেবীর পূজা করতেন ?

উত্তর : তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন ।

পূজার পরের দিন দেবী সরস্বতীকে কী নিবেদন করা হয় ?

উত্তর : পূজার পর দিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়।

দেবী সরস্বতীর বিভিন্ন নামগুলি কি কি ?

উত্তর: সরস্বতী বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া বাগদেবী, সারদা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, ভারতী প্রভৃতি নামে অভিহিতা।

বসন্তের কোন বিশেষ ফুলটি দেবী সরস্বতীর পছন্দ বলে মানা হয়ে থাকে ?

উত্তর: বসন্তের অন্যতম ফুল পলাশ দেবীর পছন্দের বলে জানা যায়।

মা সরস্বতীকে বীণাপানি কেন বলা হয় ?

দেবীর এক হাতে থাকে বীণা তাই দেবীর আরেক নাম বীণাপানি

Recent Posts