রবীন্দ্রনাথ একজন বড়ই রসিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর লেখা থেকে শুরু করে গান সবকিছুতেই আমরা প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাই।
আমরা অনেকেই ভাবী রবীন্দ্রনাথ খুব রাশভারী ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু তা একেবারেই নয়। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন, যেটির প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েকটি ঘটনা থেকে। তাঁর রসবোধ ও রসিকতার অনেক কাহিনী শান্তিনিকেতনের বুক থেকে পাওয়া গিয়েছে। আজ ২৫ শে বৈশাখ তাঁর ১৬৪তম জন্মজয়ন্তী, সেই উপলক্ষ্যে আমরা তাঁর কিছু রসিকতার কাহিনী আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবো।

চলুন তাঁর কিছু মজার কাহিনী ভাগ করে নিই যা তাঁর রসবোধকে তুলে ধরবে:-
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১
সাহিত্যিক ‘বনফুল’ অর্থাৎ শ্রী বলাইচাঁদের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি যখন শান্তিনিকেতনে পৌঁছান তখন তিনি জানতে পারেন রবীন্দ্রনাথ কানে কম শোনেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’, তখন বলাইবাবুর ভাই জোরে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।’ তখন রবীন্দ্রনাথ হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!’

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ২
একবার শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের ফুটবল খেলা হচ্ছিল, সেই খেলায় শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোল করে জিতেছিল। এরজন্য শান্তিনিকেতনের সকল ছেলেরা খুব খুশি হয়েছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন ‘জিতেছে ভালো, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে।’

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৩
রবীন্দ্রনাথ একবার এক ভদ্রলোককে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি দণ্ড দেব।’ এটি শুনে সেই ভদ্রলোক খুবই বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি ভাবছিলেন তিনি কী এমন অপরাধ করেছেন কে জানে, তাই তিনি বাধ্য হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন, আমি কী অপরাধ করেছি?’ তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গতকাল আপনার লাঠি মানে দণ্ডটা আমার এখানে ফেলে গিয়েছিলেন। এই নিন আপনার দণ্ড।’ এই বলে তিনি সেই ভদ্রলোকের লাঠিটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা রসিকতার কিছু অজানা কাহিনী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি বিশ্ব বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৪
একবার রবীন্দ্রনাথ ঘুমোচ্ছিলেন আর তাঁর ঘরের জানালা খোলা ছিল। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের জ্যোৎস্না আলো তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল তাই তিনি তাঁর ভৃত্য মহাদেবকে ডেকে বলেছিলেন, ‘ওরে মহাদেব, চাঁদটাকে একটু ঢাকা দে বাবা।’ এটি শুনে তাঁর ভৃত্য মহাদেব তো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভাবছিলেন চাঁদকে আবার কীভাবে ঢাকা দেওয়া যায়? তখন রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, ‘জানালাটা বন্ধ কর, তাহলেই চাঁদ ঢাকা পড়বে।’

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৫
একবার রবীন্দ্রনাথের কাছে এক ভদ্রলোক কলম ধার চেয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোক কলম চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী’। রবীন্দ্রনাথ তখন কলমটা দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই জানি। লাইন দুটো দাঁড়াল এ রকম : সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী। সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি!’
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৬
একবার সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বেড়াচ্ছিলেন। তখন হঠাৎই রবীন্দ্রনাথের কাতরক্তি শুনতে পান সুধাকান্তবাবু, তখন তাঁর দিকে তাকাতেই গুরুদেব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘পা-কে চরনকমল বা পাদ-পদ্ম কেনকলে জান?’ এই প্রশ্ন শুনে তো সুধাকান্তবাবুর অবাক, তাঁর এই বিস্ময় ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বলেছিলেন ‘তাই যদি না হয়, তাহলে শরীরের এত জায়গা থাকতে মোজা ভেদ করে মৌমাছিটা পায়ের একেবারে তলায় হুলটা বিঁধালো কেন!’

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৭
রবীন্দ্রনাথের বরাবরের অভ্যাস ছিল নতুন কোন উপন্যাস লেখার পর সেটিকে শান্তিনিকেতনের গুনীজনের সমাবেশে পড়ে শোনানোর। তাঁর সেই গুণীজনের সমাবেশে প্রায়ই যোগ দিতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একদিন আসরের বাইরে জুতো খুলে রাখার জন্য তাঁর জুতো চুরি হয়ে গিয়েছিল, তাই পরেরদিন তিনি তাঁর জুতো জোড়া কাগজে মুড়ে বগলদাবা করে আসরে ঢুকেছিলেন। এটি দেখে কবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘শরৎ তোমার বগলে ওটা কী পাদুকাপুরাণ?’ গুরুদেবের মুখে এই কথা শুনে আসরের সকলে হাসতে শুরু করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা রসিকতার কিছু অজানা কাহিনী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি রবীন্দ্র জয়ন্তীর শুভেচ্ছা বার্তা সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৮
কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রদের একজন। তিনি সবসময়ই কবির সান্নিধ্যেই থাকতেন। শান্তিনিকেতনের কুয়োর ধারে একটি গাবগাছ ছিল। একদিন সেইদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথ বিশী যাচ্ছিলেন, হঠাৎ গাবগাছের কাছে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, ‘জানিস, একসময় এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এটা অশোক গাছ। তারপরে যখন বড় হলো দেখি, অশোক নয়, গাব গাছ।’ তারপর প্রমথনাথের দিকে তাকিয়ে কবি বলেছিলেন ‘তোকেও অশোক গাছ বলে লাগিয়েছিলাম, বোধ করি তুইও গাব গাছ।’

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ৯
একবার রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক ভক্তের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, তাঁকে বসার জন্য একটি চেয়ারও দেওয়া হয়েছিল যেটি দেখে কবি ভক্তকে বলেছিলেন, ‘চেয়ারটা বেশ সুন্দর। তা চেয়ারটা সজীব তো?’ কিন্তু ভক্ত কবির কথা বুঝতেই পারেন নি, তিনি হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কবির মুখের দিকে। ভক্তের এই অবাক করা মুখ দেখে কবি নিজে থেকেই বলে উঠলেন, ‘বুঝতে পারনি বুঝি? আমি জিজ্ঞেস করছি, চেয়ারটা সজীব কি না, মানে এতে ছারপোকা আছে কি না।’
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১০
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ দিকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন, ‘আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।’ সেই লোকটির দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিয়েছিলেন, ‘তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১১
একবার এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে। সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সংগীতজ্ঞ একের পর এক ব্যক্তিরা তাদের গায়কি উপস্থাপন করছিল। সেখানে বিখ্যাত ধ্রুপদ গানের শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর গান গাইলেন ও এরপর সকলে রবীন্দ্রনাথকে গান করবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কবিগুরু গান গাইতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু সকলের আবদারে শেষ পর্যন্ত তিনি গান গাইতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন ও বলেছিলেন, “বুঝেছি তোমরা আমাকে ছাড়বে না। গোপেশ্বরের পর এবার দাড়িশ্বরের পালা।” গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় গোঁফ ছিল আর অন্যদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দাড়ি বড় ছিল তাই তিনি নিজেকে বলেছিলেন দাড়িশ্বর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা রসিকতার কিছু অজানা কাহিনী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের উক্তি ও ছবি সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১২
একবার এক সভাতে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় দারুণ এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সভায় গুরুদেবও উপস্থিত ছিলেন। সভাটি শেষ হওয়ার পর সকলে বলাবলি করছিলেন, ‘দেখেছ বলাইচাঁদ কী দারুণ বলল!’ এদিকে সেদিন রবীন্দ্রনাথ সবাইকে থামিয়ে বলেছিলেন, “এখানে এত অবাক হওয়ার কী আছে! ওঁর নাম-ই তো বলাই, বলাই তো ওঁর কাজ।” রবীন্দ্রনাথের এই রসিকতায় বলাইচাঁদ সহ সভার সকলে হেসে উঠেছিলেন।

রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১৩
একবার সুনয়নী তাঁর রবিকাকাকে নাতনি (শিবানী) ও নাতজামাই দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। কবি তখন বাঁকুড়ায় ছিলেন। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের আসর বসত, সেই আসরে শিবানী সেবার গান গেয়েছিলেন। তার গান শুনে কবি খুব খুশী হয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রতিদিন শিবানী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। শিবানীর সাহস ও কৌতূহল বরাবরই একটু বেশি ছিল। সে একদিন গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,‘ আচ্ছা দাদাভাই, আপনি কখনও প্রেমে পড়েছেন?’ তখন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ গো নাতনি, তবে তা শুধু পড়াই হয়েছিল, ওঠা আর হয়ে ওঠেনি।’
রসিক রবীন্দ্রনাথ – গল্প ১৪
একবার মৈত্রেয়ী দেবী গুরুদেবের কাছে তাঁর বিয়ের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন তখন গুরুদেব বলেছিলেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই। আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল। বৌঠানেরা বিয়ের জন্য জোরাজোরি শুরু করলে আমি বললাম, তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আমার কোন মতামত নেই। … আমি কোথাও যেতে পারব না।’
তখন মৈত্রেয়ী দেবী অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘কেন আপনি বিয়ে করতেও যান নি?’ কবিগুরু ততধিক অবাক কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন যাব? আমার একটা মান সম্মান আছে না?’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা রসিকতার কিছু অজানা কাহিনী সংক্রান্ত আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি রবীন্দ্রনাথের সেই অজানা দিক, যা পাঠ্যবইতে নেই সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে
উপসংহার
কবিগুরুর শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর রসবোধ ও রসিকতার কাহিনী উঠে আসে। সেই আশ্রম চত্বরে আজও তাঁর জীবনদর্শন, সাহিত্যবোধ ও রসবোধের ছাপ রয়ে গেছে। তাঁর সময়কালে অনেক গুণী ব্যক্তিরাই শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। আশা করছি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের পছন্দ হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই পোস্টটি আপনি আপনাদের বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও চেনা পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারেন।