অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ, Best essay on Subculture and current youth in Bengali



ভূমিকা, Introduction 

সংস্কৃতি হল জাতির স্বরূপ, আর সংস্কৃতির নেতিবাচক রূপ হল অপসংস্কৃতি। কোনো ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলিগুলো ও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার মাধ্যমে নিজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং সমাজকে সুরুচিসম্পন্ন এবং উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সংস্কৃতির চেতনা। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা অপসংস্কৃতিতে ভরে উঠেছে, যার বিশেষ প্রভাব পড়ছে যুবসমাজের উপর, এর ফলে যুবসমাজ ক্রমশ অসংযত কার্যকলাপের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মসূচি। অপসংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে নিজ দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ

সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি, Culture and counterculture

সংস্কৃতি সম্পর্কিত আলোচনায় লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন-

 “সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহভাবে বাঁচা” 

অর্থাৎ বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে মানুষের নৈমিত্তিক প্রচেষ্টাই হল সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি হল ঠিক তার  বিপরীত। আমাদের দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে আমরা সর্বদাই গর্ব বোধ করি। কিন্তু দেশের বেশ কিছু অংশে অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছে, যার প্রভাব বিভিন্ন জাতির উপরই পরিলক্ষিত। একটি দেশে তথা সমাজে বসবাসকারী মানুষের চিন্তাধারা, কর্ম এবং চলন-বলন হল সংস্কৃতির বাহন, অর্থাৎ যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সামাজিক জীবনে সংস্কৃতি রূপে বিকশিত হয়।

সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি

সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি রাষ্ট্র তৈরি করে তখন সেই সমাজের বিভিন্ন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতিই নির্দিষ্ট রাষ্ট্রটির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এই সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে নিত্যদিনের রীতিনীতি, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতিতে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভৌগােলিক অবস্থান, ধর্মীয় সব বিধি বিধান, সমাজের নৈতিক অনুশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, দর্শন প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে এক একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

যেকোনো জাতির প্রাণশক্তি অন্তর্নিহিত রয়েছে তাদের সংস্কৃতির মধ্যে আর প্রত্যেকটি সংস্কৃতিরই নিজের মতা অনুসারে বিকশিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে দেশভেদে বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির উপাদানগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি আর আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।

এই বলে এমনটা নয় যে সকল বিদেশি সংস্কৃতির মানেই অপসংস্কৃতি। যেসব সংস্কৃতি মানব চিত্তকে কলুষিত করে তোলে, ডেকে আনে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়, বিনষ্ট করে নৈতিকতা, সেটাই হল অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতি হল সংস্কৃতিরই এক বিকৃত রূপ। নিজ দেশের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার বদলে মানুষ অন্য দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে নিচ্ছে, সেক্ষেত্রে ভালো খারাপের কোনো বাছবিচারও থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো আমাদের দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি বলে আর কিছুই থাকবেনা।

কম্পিউটার শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, What is the Importance of computer education in Bengali

বাঙালিদের সংস্কৃতি, Bengali culture

বাঙালি সংস্কৃতির কাছে রয়েছে সুপ্রাচীনকালের ঐতিহ্যধরা। সময় বিশেষে বিভিন্ন কিছু গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে নানা রূপ-রূপান্তরের পর এই সংস্কৃতি বর্তমান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বাংলা সংস্কৃতি। এর সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের প্রভাবও যােগ হয়েছিল, পাশাপাশি বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতিতে দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-ভােটব্রহ্ম প্রমুখ জাতির মেলবন্ধনও ঘটেছিল। মধ্যযুগে এসে যােগদান করলেন মুসলিম সংস্কৃতিও। প্রাচীন ও মধ্যযুগের পার হয়ে আসার পর বর্তমানের বাঙালি সংস্কৃতির রূপ বেশ কিছুটা পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত। 

শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali

ভারতীয় সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, Invasion of subculture in Indian culture

অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সংস্কৃতির ভালো মন্দ যাচাই না করে সেগুলো আয়ত্ত করে নেওয়ার চেষ্টায় আমরা অজান্তেই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছি।

ড. আহমদ শরীফ এক প্রবন্ধে সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছেন যে,

 ” চলনে বলনে, মনে-মেজাজে, কথায়-কাজে, ভাবে-ভাবনায়, আচার-আচরণে অনবরত সুন্দরের অনুশীলন ও অভিব্যক্তিই সংস্কৃতিবানতা। ” 

কিন্তু আজকের সময়ে সংস্কৃতিতে অনাচারের প্রবেশ ঘটেছে। উনিশ শতকের শুরুর দিকের সময়কালে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উদ্দাম উজ্জ্বলতা, ভােগবিলাসী প্রবণতা আর জাঁকজমক যেন চড়াও হয়ে জেঁকে বসেছিল ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর। তবে সেই অমঙ্গল তথা অকল্যাণকর সংস্কৃতি আমাদের জাতিকে পুরােপুরি গ্রাস করতে পারেনি।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন

জাতির জাগ্রত বিবেকের নিকট হার মানতে হয়েছিল অশুভবােধকে। কিন্তু যখন দিনবদলের পালা এলো অর্থাৎ বিশ্বায়নের সুযােগ পেয়ে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। এরপর চিরায়ত ভারতীয় সংস্কৃতির উপর বিদেশি জীবনযাত্রার চর্চা শুরু হয়, পােশাক-পরিচ্ছদে পরিবর্তন আসে, পাশ্চাত্য আচার-আচরণ অনুকরণ করাটা যেন আভিজাত্য প্রকাশের মাপকাঠি হয়ে ওঠে। সমাজজীবনে বিবেক বােধ এবং সততা যেন হারিয়ে যেতে থাকে, অন্যদিকে বিনােদন উৎকট সংগীতে ভরে ওঠে, সাথে উদ্দাম নৃত্য এবং রুচিহীন সব চলচ্চিত্র ক্রমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।

জাতির মানুষের জীবন থেকে যেন সৌন্দর্য্য এবং শুভবােধ ক্রমশ বিলীন হয়ে পড়ছে। জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অবিচ্ছেদ্য। আমাদের সমাজে বসবাসকারী মানুষজনের প্রত্যেক কার্যকলাপই সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা কোনো সমাজই নিজের সংস্কৃতিকে কখনও অস্বীকার করতে পারে না। তাই বলা যায় যে সংস্কৃতি ও জীবন হল একে অপরের পরিপূরক।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali

অপসংস্কৃতি এবং আজকের যুবসমাজ, Counterculture and today’s youth

অপসংস্কৃতি তরুণ বয়সকালে বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়, স্থূলতা এবং মাদকের করাল গ্রাসে আজকের তারুণ্য নিমজ্জমান হয়ে আছে, যা তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরই প্রতিচ্ছবি। পাশ্চাত্যের আজব সব পােশাকে প্রলুব্ধ আজকের তরুণ সমাজ; তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চালচলনে আমাদের দেশের ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

পাশ্চাত্য দেশগুলোর ভােগবিলাসী জীবনধারার দিকে তারা মােহান্ধ হয়ে পড়ছে। এমনকি দেশের টিভি চ্যানেলগুলােতেও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছে। নিজের স্বকীয়তা, সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ তথা বিবেক বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিলাসী স্রোতেই আজকের তারুণ্য অবগাহন করছে। এক কথায় অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে সেই তরুণ সমাজ আজ যেন অনৈতিকতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের তরুণ সমাজ অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে, যার ফলে সমাজের অগ্রগতিও পিছিয়ে পড়ছে।

অপসংস্কৃতি এবং আজকের যুবসমাজ

আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হয়, আর এই উন্নয়নশীল দেশের উন্নতিতে বাধা পড়বে যদি জাতির অন্তর্ভুক্ত তরুণ সমাজ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সারা বিশ্বের সকল দেশের সংস্কৃতিকেই সম্মান করা উচিত, তবে সবচেয়ে বেশি সম্মানের যোগ্য হল নিজ দেশের সংস্কৃতি। সমাজের তরুণরা ভবিষ্যতের পথিকৃৎ, তারাই দেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং বিশ্বের সম্মুখে গর্বের সাথে তুলে ধরতে পারবে।

কিন্তু এই তরুণ সমাজ যদি নিজের সংস্কৃতির সম্মান রক্ষার কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়, তবে নিজ দেশের সংস্কৃতির সম্মানহানি ঘটে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজ, Students and Eradication of illiteracy in Bengali

খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রভাব, Effects on diet

 ভিন্ন দেশের সংস্কৃতির প্রভাব স্বরূপ আমাদের যুবসমাজের খাদ্যাভ্যাসেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম আজকাল যেকোনো খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করেই বিভিন্ন মাধ্যমে খাবারের বিজ্ঞাপন দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। সংস্কৃতির নতুন সংযোজন হিসেবে দেখা দিয়েছে ফাস্টফুড সংস্কৃতি।

খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রভাব

বর্তমানকালের তরুণ-তরুণী সহ শিশু-কিশোরেরা, এমনকি বয়স্কদের মধ্যেও এই সংস্কৃতির চর্চা হতে দেখা যাচ্ছে, যা দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোকে ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করার প্রবণতা সৃষ্টি করছে। তাই আজকালের অনেক তরুণ তরুণীরা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম অবধি জানেনা, খাওয়া তো দূরেই থাক।

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

যুবসমাজের চাল চলনের উপর প্রভাব, Impact on youth mobility

বর্তমান সময়ে সমাজের তরুণদের মধ্যে পাশ্চাত্যের একটি বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, সেটি হল ক্লাবে যাওয়া, পার্টি করা, নেশা জাতীয় দ্রব্য সহকারে আড্ডার আসর জমানো। যুবসমাজে এখন প্রায় প্রতিটি ছোটো বড় বিষয় উৎযাপন করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের আচারগুলোকে অনুসরণ করে। এইভাবে কখন যে তারা মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে তা হয়তো নিজেও বুঝতে পারে না।

যুবসমাজের চাল চলনের উপর প্রভাব

প্রায়ই খবরে দেখা যায় মাদকের ছোবলে কোনো যুবকের মৃত্যু হয়েছে অথবা স্মাগলারদের পাল্লায় পড়ে নিজের সর্বস্ব হারাতে বসেছে অনেকে। অন্যদিকে আজকের ছেলে মেয়েরা গুরুজনদেরকে সম্মান করার প্রথাও যেন ভুলতে বসেছে, আগেকার দিনে যেমন বাসে বা ট্রেনে যাতায়াত করার সময় বয়স্কদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে নিজের বসার জায়গাটায় ওদের বসিয়ে দিতে দেখা যেত, কিন্তু এখনকার সময়ে এমন কিছু খুব একটা দেখা যায় না।

এখনকার যুবসমাজ বড়দের সামনেও যেমন খুশি ব্যবহার করে, নিজের ভদ্রতা জ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলছে তারা। এইভাবে চলতে থাকলে দেশীয় সংস্কৃতির অপমৃত্যু হতে বাধ্য।

উপসংহার, Conclusion

দেশের সংস্কৃতির লক্ষ্যই হল দেশের জনগণের আর্থসামাজিক সংস্কৃতি বজায় রাখা এবং মনােজাগতিক মুক্তি ঘটানো। কিন্তু এর উপর অপসংস্কৃতির বিরূপ আগ্রাসন ঘটার মানেই হল জাতীয় ঐতিহ্যকে পঙ্গু করে দেওয়া, বা সংস্কৃতিকে সমূলে বিনষ্ট করে দেওয়া।

অপসংস্কৃতির বিরূপ আগ্রাসন

এসবের প্রভাব তরুণ সমাজের উপরই বেশি দেখা যায়, তাই এই অপসংস্কৃতির হাত থেকে এই তরুণ প্রজন্মই সমগ্র জাতিকে রক্ষা করতে পারবে। সমগ্র বিশ্বের তাবৎ সংস্কৃতির ভালাে দিকগুলো গ্রহণ করে, মন্দ দিকগুলোকে বর্জন করে দেওয়ার মাধ্যমেই আমাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে তুলতে হবে। দেশের সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে আমাদের সকলের লক্ষ্য থাকা উচিত যেন আমরা অবশ্যই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি।

Recent Posts