পাশ্চাত্য শিক্ষার যুক্তিবাদী ও উদারনৈতিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে সব বঙ্গসন্তান নির্ভীক চিত্তে নতুন ধারায় শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সংস্কার আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।তিনি ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আধুনিক ভারত সৃষ্টি করার ব্রত অবলম্বন করেন।আধুনিক ভারত চেতনায় তাঁকে,’Morning star of Reformation’ তাই বলা হয়ে থাকে । মধ্যযুগের অন্ধকারময় জগৎ থেকে তুলে এনে বাঙালিকে নতুন যুগের ,নতুন প্রভাতের আলো তিনিই দেখিয়েছিলেন ।
বাল্যজীবন ও শিক্ষা, Childhood days and education of Raja Rammohan Roy
হুগলী জেলার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে, ২২শে মে,১৭৭২ সালে , এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজা রামমোহন রায়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিল এই ‘রায়’ পদবী বলে অনুমান করা হয় । পিতার নাম রামকান্ত রায় এবং মায়ের নাম তারিণী দেবী। রামকান্তের মধ্যমা পত্নী ছিলেন তারিণী দেবী যাঁর ছিল এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহ ত্যাগ করে কাশী, পাটনা ও নেপালসহ নানা স্থানে পরিভ্রমণ করেন। নন্দকুমার বিদ্যালংকারের সহযোগিতায় রামমোহনের হয়েছিল সংস্কৃতে বুৎপত্তি ও বেদান্তের প্রতি গভীর অনুরাগ । বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার সূত্রপাত তাঁর বারাণসীতে হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি পাটনা থেকে আরবি ও পারসি ভাষায় ও পারদর্শী হন । তাছাড়া তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাতে ও প্রভূত বুৎপত্তি লাভ করেন ।
সম্রাট অশোকের জীবনচরিত – Life Story of emperor Ashoka in Bengali
কর্মজীবন , Career
রামমোহন রায় অল্প বয়সে কলকাতায় মহাজনের পদে কর্মরত ছিলেন ।১৭৯৬ সালে রামমোহন অর্থ উপার্জন আরম্ভ করেন এবং তিনি ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন । জন ডিগবির অধীনে থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে তিনি দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেছেন ১৮০৩ সাল থেকে ১৮১৪ সাল অবধি । রামমোহন কলকাতায় স্থায়ী রূপে বসবাস শুরু করেন ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এবং তখন থেকেই রামমোহন রায়ের সংস্কার-চেতনার সূত্রপাত ঘটে।একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে রামমোহন রায় বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য সচেষ্ট হন ।
১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ প্রকাশিত হলে রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গ কটূক্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠেন। রামমোহন এই প্রতিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিও ন্যায়সঙ্গত ভাষায় নিজের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছিলেন। । ১৮১৪ সালে কলকাতায় এসে উদার চিন্তাশীল সংস্থা -প্রেমী কিছু মানুষের সঙ্গে মিলিতভাবে ‘আত্মীয় সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।পরবর্তীকালে এই আত্মীয় সভাকেই তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ হিসেবে নামকরণও রূপদান করেন । এই সভায় ধর্মীয় ,সামাজিক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ও আলোচিত হতো। সাহেবদের বাংলা শেখানোর উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় বাংলা ও ইংরেজি -দুই ভাষাতেই ব্যাকরণ রচনা করছিলেন।
রামমোহন রায় এবং একেশ্বরবাদ : Rammohan Roy and unitarianism
রামমোহন তীব্রভাবে মূর্তিপূজা ,বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা এবং অর্থশূন্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নিন্দা করেছিলেন। এ সবের জন্য তিনি পুরোহিত শ্রেণীকেই দায়ী করেন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ও প্রচার করেছিলেন যে ‘একেশ্বরবাদ’ ই ধর্মের মূল কথা ।বেদান্তের উপর নির্ভর করেই তিনি এই আদর্শকে সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তুলতে সচেষ্ট হন ।তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রাহ্মসমাজ’ ছিল এই একেশ্বরবাদী ধর্মের ই প্রতিষ্ঠান যার লক্ষ্য ছিল পৌত্তলিকতাবাদ ত্যাগ করে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করা।বেদ উপনিষদের যুক্তিবাদের উপর ব্রাহ্মসমাজটি প্রতিষ্ঠিত করে তিনি হিন্দু ধর্ম ও সমাজের সংস্কার সাধনে ব্রতী হন।
কম্পিউটারের ইতিহাস ~ History of Computer in Bengali
সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায়, Raja Rammohan Roy as social reformer
সকল রকমের দীনতা ,নৃশংসতা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রামমোহন রায় ছিলেন সদা ব্যস্ত একজন প্রতিবাদী।শোষিত কৃষকদের দুরবস্থা নিরসনের জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। প্রশাসনের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জরুরি বিচার ,লবণ শুল্কের অবসান ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহনের প্রগতিবাদী চিন্তাধারা ক্রমশ গৃহীত হয়।মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর সংগ্রাম ছিল অবিরাম। বাল্যবিবাহ, কন্যা বিক্রিয়, সতীদাহ, পুরুষের বহুবিবাহ ইত্যাদি নৃশংস প্রথাগুলির বিরুদ্ধেও রামমোহন আজীবন সংগ্রাম করেন। ১৮২২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ‘সতীদাহ আইন’ চালু হয়। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করার জন্য তিনি লর্ড বেন্টিংক কে অভিনন্দন জানান ।সতীদাহের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। রামমোহন রায় হিন্দু- বিধবা বিবাহের পক্ষপাতিও ছিলেন। হিন্দু বিধবারা যাতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী হতে পারে তার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। রামমোহন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে হিন্দু সমাজের বহু অমানবীয় প্রথা পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বলে তিনি “নব ভারতের স্রষ্টা” হিসেবে পরিগণিত হন। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে অলংকৃত করে ছিলেন।
রামমোহন রায়ের শিক্ষা সংস্কার, Educational reforms of Raja Rammohan Roy
শিক্ষা সংস্কারে তাঁর প্রবল প্রয়াসের জন্য রামমোহন রায় সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন ।এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে তাঁর আগ্রহ ছিল অদ্বিতীয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার দৈনিক ভিত্তি -এর ঐশ্বর্য ,বৈচিত্র সর্বোপরি তাঁর উদারতা ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি তিনি ভারতীয়দের আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবহারের মধ্যেই জাতি কুসংস্কারমুক্ত হবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তাই ডেভিড হেয়ার নামক এক মিশনারির সহযোগিতায় বহু স্কুল স্থাপন করে তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট হন । ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের লর্ড বেন্টিংক রামমোহন রায়ের সমর্থনে দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ।
রামমোহন নিজে একটি অ্যাংলো- হিন্দু স্কুল স্থাপন করেছিলেন ।সেখানে পাঠক্রমে ভলতেয়ারের রচনা ,ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজেও রামমোহন অগ্রণী ছিলেন। এছাড়া তিনি আধুনিক বাংলার শিক্ষানীতি রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ।তিনি স্বদেশীও বিদেশি বন্ধুদের সাহায্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।’স্কুল বুক সোসাইটি’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি নতুন শিক্ষানীতির উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনাতে পর্যন্ত আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রামমোহন পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে একত্রে বেদান্ত শিক্ষা অধ্যয়নের জন্য একটি বেদান্ত কলেজের স্থাপনা করেছিলেন।
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবন কাহিনী – Story of Mahatma Gandhi’s Life in Bengali
সাহিত্যচর্চা , Literary genious
বাংলা গদ্যের স্রষ্টা হিসেবেও রামমোহন রায়ের প্রশংসনীয় ভূমিকা আছে।তিনি বাংলা গদ্যের উন্নতি বিধান করেন ।তাঁর রচিত “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” (বাংলা ব্যাকরণ পুস্তক) , আধুনিক পণ্ডিতদের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য ও ভাষা প্রসারের জন্য তিনি শ্রীরামপুরের মিশনারিদের সঙ্গেও সহযোগিতা করেন। বাংলায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সম্বাদ কৌমুদী’ সম্পাদনার কাজও তিনি স্বার্থকভাবে করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একাধিক পত্র পত্রিকার সম্পাদনা ও করেন। এসব পত্র-পত্রিকা বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের সহায়ক হয়েছিল। বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্য রচনায় বিশেষ রূপে পারদর্শী ছিলেন রামমোহন রায় ।তাঁর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো , বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্তসার ,ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, গোস্বামীর সহিত বিচার, সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ ,কবিতাকারের সহিত বিচার,পথ্যপ্রদান।বাংলা ভাষায় ‘যতিচিহ্ন’ ব্যবহারের পদ্ধতি টি তিনিই উদ্ভাবন করেছিলেন। সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদান আজও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
শেষ জীবন ও মৃত্যু , Last days and death of Raja Rammohan Roy
১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপল্টনে এই মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষের মহাপ্রয়াণ ঘটে। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয় ব্রিস্টলে ।
নৃত্যগুরু উদয় শঙ্করের জীবনকাহিনী – Uday Shankar Biography in Bengali
উপসংহার , Conclusion
নতুন যুগের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় আমাদের জাতীয় জীবনকে সুস্থ ,সবল ও সংস্কারমুক্ত করার জন্য সারা জীবন ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ভারতের মাটিতে পাশ্চাত্য শিক্ষা -দীক্ষা সর্বপ্রথম অঙ্কুরিত হয়। তাই সমগ্র দেশবাসী তাঁকে “নবযুগের স্রষ্টা; ভারত প্রথিক” আখ্যায় ভূষিত করেছে। তাঁর সমাজ সংস্কারের চেতনা ,ভারতবাসীর উন্নয়নের সাধনা, মানবতাবোধ, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অবশ্যই ভারতবর্ষকে পুনর্জীবন দান করেছিল।প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন ভারত নবজাগরণের অগ্রদূত।
Frequently asked questions:
রাজা রামমোহন রায় কত সালে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
হুগলী জেলার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে, ২২শে মে,১৭৭২ সালে রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন।
রামমোহন রায় পিতা- মাতার নাম কী ছিল?
রামমোহন রায়ের পিতার নাম- রামকান্ত রায় ছ এবং মাতা ছিলেন তারিণী দেবী।
রামমোহন রায় কার সহযোগিতায় বহু স্কুল স্থাপন করেছিলেন ?
ডেভিড হেয়ার
ব্রাহ্মসমাজ 'কে প্রতিষ্ঠা করেন?
রাজা রামমোহন রায়
রাজা রামমোহন রায় কবে প্রয়াণ করেন?
১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন প্রয়াণ করেন।