কবীর দাস যিনি মূলত সন্ত কবীর বলে বহুল পরিচিত ছিলেন একজন পঞ্চদশ শতাব্দীর ভারতীয় মরমী কবি এবং সাধু, যার রচনাগুলি হিন্দু ধর্মের ভক্তি আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রাথমিক জীবন একটি মুসলিম পরিবারে অতিবাহিত করেও তিনি তাঁর গুরু, হিন্দু ভক্তি আন্দোলনের নেতা রামানন্দের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
কবিতার কারণেই কবীর সারা বিশ্বজুড়ে সম্মানিত হয়েছিলেন এবং এই কবিতার ই মধ্যে দিয়ে তিনি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের পরিস্থিতি গুলো সুন্দরভাবে বর্ণিত করেছিলেন । সুতরাং, আজও তাঁর কবিতা ও গানগুলি সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁকে অনুসরণ করা মানে নিজের অন্তরকে বোঝা, নিজেকে উপলব্ধি করা এবং পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে নিজেকে সুন্দরভাবে মানিয়ে চলা।
হিন্দু – মুসলমান সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী সন্ত কবীর তাঁর রচনার মাধ্যমে মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেমের কথা এবং জীবনের কথা বলেছিলেন যার মধ্যে প্রত্যক্ষ কোন তত্ত্ব ছিলনা।
কবীরের দোহা, Kabir’s Doha
কবিতার আকারে লেখা উপদেশ সম্বলিত ছোট ছোট বাণীকে ,’দোহা’ বলা হয়ে থাকে।
কবীরের অমূল্য বানী মৌখিক পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে এবং গানের মধ্যে দিয়ে তার কথা ছড়িয়ে পড়তো যুগের ওপারে। কবীরের ‘দোহা’ ছিল শিক্ষায় পরিপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় ; কেবল বিভিন্ন নামে তাঁর উপাসনা করা হয়। কবীর বিভিন্ন বিখ্যাত দোহে রচনা করে গেছেন যা হিন্দি ভাষায় বেশি প্রচলিত ছিল।পরবর্তীকালে তার গান ও কবিতাকে সুফি ধারা এবং মরমিয়াবাদের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়ে থাকে।
সন্ত কবীর ও তার অমূল্য দোহা আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি গুরু নানক এর জীবনী সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।
প্রেম সম্বন্ধীয় কবিরের দোহা সমূহ, Love related Kabir’s Doha
- ‘এই বিশ্বের সকল কৃপার আধার যিনি, সেই জগত চেনে না তাঁকে
যেমন আমরা চোখ দিয়ে সব দেখি কিন্তু নিজের চোখকে নিজেই পাইনা দেখতে’ - মোর প্রিয়’র লাল রঙ, তাই যে দিকে দেখি সব ই লাল মনে হয়;
তার রঙে আমিও যে রাঙা হলাম ,সেই রঙ দেখতে গিয়ে - সব রসায়ন দেখছে দুচোখ, প্রেমসম যে নাই কিছু,
রতি পরিমাণ দেহে করলে প্রবেশ,
স্বর্ণ হয়ে যায় সর্বাঙ্গ। - পুঁথি পাঠ করে কজন হতে পারে পণ্ডিত?
আড়াই অক্ষর প্রেমের পাঠ করে যে পণ্ডিত হয়, সে-ই যে আসল জ্ঞানী ॥ - মোর আঁখির মাঝে এসো তুমি,
চোখ বুজে নি তখনি ,
আর দেখব না কাউকে তার পর
না কাউকে দেখতে দেব তোমায়। - দশ দুয়ারের এই খাঁচায় থাকে একটি ঝড়ের পাখি
থেকে গেলেই তা অবাকজনক , চলে গেলে তা আশ্চর্য কিসের? - বিষাদের বিষধর সাপ দেহে প্রবেশ করে হৃদয় করেছে ক্ষত
সাধু তাতে তিলমাত্র অঙ্গ নাড়ে না, যা খুশি সে করুক নিজেরমত - প্রিয়র বিরহ সুরে বাজে মোর রঙিন অঙ্গ বীণা অহরহ,
কেউ শোনে না সেই বীণার সুর, শোনে আমার হৃদয় আর মোর প্রিয় - না পারি যেতে তোমার মাঝে, না পারি ডাকতে আমার কাছে
নিরুপায় আমি; জ্বলে পুড়ে মরছি বিরহের আঁচে॥ - বিরহের আগুনে পুড়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরি
এই আমি;
তরুর ছায়াতলে না পারি বসতে, মোর বেদনার তাপে তরুও জ্বলে ওঠে॥ - বিরহের আগুনে জ্বলে ঘুরে মরি,
নেভাতে যাই নদীর কাছে
আমায় দেখে নদীই জ্বলে ওঠে,
সন্ত, বলো এ জ্বলন কোথায় নেভাই? - আগুনে হাঁটা সহজ,
সহজ লাগে খড়গের ধার
কঠিন হল ভালোবাসা ,
আর , ভালোবেসে যাওয়া একই ভাবে চিরকাল॥ - প্রদান করেছে সে তৈল পরিপূর্ণ দ্বীপ
আর সলতে অফুরান ,
জগতের কার্য শেষ আমার,
এই হাটে আর করব না প্রত্যাগমন - এই মায়া বড় প্রবঞ্চক, ভুলিয়ে দেয় পুরো জগত কে
এই মায়াকেও যে ভোলাতে পারে
ধন্য সেই প্রবঞ্চক কে। - মায়া চলে গেলও মান ত্যাগ করা হয় না সহজ ,
বহু মুনি ঋষিকে আত্মসাৎ করেছে এই মান,
মান সবাইকে খেয়ে ফেলে করে খানখান - জগত মরলেও মরি না আমি
আমি পেয়েছি মোর অমর সেই জীবনদাতা কে - সীমা আর অসীমের গণ্ডি অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে কবীর
দেখ অসীমের ময়দানে কবীর শায়িত যে - হয় বিরহের মৃত্যু দাও, নয়তো দর্শন দাও
অষ্ট প্রহরের এই দহন আর সহ্য হবার নয় - হেসে কেউ কিছু লাভ করেনি প্রিয়, পেয়েছে চোখের অশ্রুজলে
হেসেখেলে সহজেই পাওয়া গেলে ,
কে আর চাইতো তাকে? - হৃদয়ের ভেতর জাজ্বল্যমান দাবানলের ধোঁয়া যায় না দেখা,
যার জ্বলে সে দেখে আর,
নয়তো দেখে যে জ্বালায় সেই আগুন - রাতের বিরহের অভিশাপ কাটিয়ে যেমন ভোরে পাখি দেখা পায় সঙ্গীর
কিন্তু যে বিরহ পেল রামকে হারিয়ে, সে পায় না দেখা তার দিন রাত্রি - কবীর বলেন ; মৃত্যুর পর প্রভুর দেখা পাওয়ার কথা ভেবে কী হবে?
লোহা মাটিতে বিলীন হবার পরে পরশপাথরের কী লাভ? - বৈদ্য ডাকা হলে তিনি দেখেন ধরে কবীরের নাড়ি
বৈদ্য জানবেন কি করে জে সে বেদনা যে হৃদয়ের অনেক গভীরে॥ - না আছে নিজ হৃদয়ের ওপর আস্থা
না জানি প্রেম কারে বলে
না জানি প্রেমের নিয়ম,
কী করে রইবো প্রিয়র সনে॥ - ওগো সাঁই! তুমি তো সব পারো, শক্ত করে ধরো আমার হাত
নিয়ে যাও পরমধামে, ছেড়ো না মাঝ পথে তোমার সাথ।
সন্ত কবীর ও তার অমূল্য দোহা আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি গৌতম বুদ্ধের অমৃত বাণী সম্পর্কিত আমাদের পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।
জীবন সম্পর্কিত কবীরের দোহা, Kabir’s Doha related to life
- শিক্ষক এবং প্রভু দুজনেই দাঁড়িয়ে আছেন, আমি কার কার পা আগে স্পর্শ করি? তবে আমার শিক্ষক / গুরু দুজনেই আমাকে বলেছিলেন যে ঈশ্বর ই মহান।
- আপনি যদি সত্যিই খারাপ কাউকে খুঁজে পেতে শুরু করেন তবে আপনি কাউকেই পাবেন না; তবে নিজের ভিতরে খোঁজ করা শুরু করলে দেখা যাবে আপনার অন্তঃকরণ ই খারাপ এবং অন্য কেউ নয়।
- উদ্বেগ ই হল সেই চোর যে একটি হৃদয় কে গ্রাস করে। একজন ডাক্তার কী করতে পারেন? তার ওষুধ কতদূর পৌঁছাবে ??
- প্রত্যেকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করে এবং খারাপ সময়ে তাঁর কাছে স্তবগান করে তবে শুভ সময়ে কেউ তাকে স্মরণ করে না। কিন্তু যদি তাঁকেখারাপ সময়ের সাথে সাথে ভালো সময়ও স্মরণ করা হয় এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে পারা যায়,তবে জীবনে কখনও খারাপ সময় আসবে না।
- নিজের গৌরব ও খ্যাতির জন্য গর্বিত হওয়া নিরর্থক। আপনি যে উচ্চতা অর্জন করেছেন তার জন্য অহঙ্কারী হয়ে উঠবেন না।
শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককেই মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে এবং সবার মতো না আপনাকেও সেই মাটিতে পড়ে থাকতে হবে যার শীর্ষে ঘাস উঠবে। - ঈশ্বর আপনার মধ্যে শায়িত আছেন ঠিক তেমনই ঠিক যেমন অক্ষিতারা আপনার চোখের মধ্যে উপস্থিত ।
তবে, এই অজ্ঞ লোকেরা এই সত্যটির মর্মার্থ বোঝে না এবং তাই বাইরে তারা সর্বত্র ঈশ্বরে সন্ধান করতে থাকে ”” - যখন আমরা জন্মগ্রহণ করি, সবাই হাসে কিন্তু আমরা কাঁদি। ‘তাই জীবদ্দশায় ভাল কাজ করুন অর এমন কাজ করবেন না যে আপনি পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পরে তারা আপনার পিছনে হাসবে
- কবীর বলেছেন যে সবকিছুই ভঙ্গুর এবং কিছুই তার আসল রূপে পূর্ণতা পায় না।
ভাল-মন্দ, নর-নারী, নাস্তিক-আস্তিক
সবাই তার আসল রূপ থেকে চূর্ণবিচূর্ণ।প্রকৃতি কাউকে ই রেহাই দেয় না। - শব্দের চেয়ে আরও কঠোর এবং তীক্ষ্ণ কোন অস্ত্র নেই। এটি ই সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ।
কবীর বলেছেন এমন কথা বলতে যা.কেবল শান্তির পথ প্রদর্শন করবে;কারও ক্ষতি করার জন্য নিজের অহংকার প্রদর্শন করা উচিত নয় যাতে কেউ মনে কষ্ট পায়। সু বাক্য এবং শান্তির বাণী আমাদের আত্মা এবং দেহকে শুদ্ধ যার থেকে আনরা নিজের অহংকার, ক্রোধ এবং অন্যান্য খারাপ জিনিস ত্যাগ করতে পারে। শুধু তাই নয়;এটি শ্রবণকারী ব্যক্তিকেও শান্তি দিয়ে থাকে। - আগামীকাল আপনার যা কিছু করার দরকার তা এখনই করুন। সময় মুহুর্তে হারিয়ে যায় এবং সেটিকে ধরে রাখা যায় না । মুহূর্তটি যদি চলে যায় তবে কাজটি চিরদিনের জন্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
- বৃক্ষ যতই বৃহৎ হোক না কেন,তার মূল্য তখনই পাওয়া যাবে যখন সে তার ছায়াতে পথিক কে আশ্রয় দেবে এবং তার ফল মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে।
- সবকিছুই নিজের সময়মতো ঘটে;
অনবরত গাছে জল দিলেও ফল তখনই পাওয়া যায় যখন সঠিক ঋতু আসে ॥ - বাজার চত্বরে দাঁড়িয়ে কবীর সবার শুভ কামনা করেন ;
বন্ধু শত্রু নির্বিশেষে সবার উদ্দেশ্যে ।
সন্ত কবীর ও তার অমূল্য দোহা আমাদের আজকের এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে আশা করি সম্রাট অশোক জীবনী সম্পর্কিত পোস্টটি ও আপনাদের মনের মতন হবে।
উপসংহার :
সন্ত কবীর তাঁর রচনাগুলি ও গানগুলির মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনের সত্যকে উদঘাটিত করেছেন। কবির রচিত অসংখ্য দোহা গুলির মধ্যে থেকে কিছু নির্বাচিত দোহা উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রত্যেক দোহা গুলির মধ্যেই তাঁর জীবনদর্শনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
তিনি মানবজাতিকে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ ও ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়ে তাদের পথপ্রদর্শন করতে চেয়েছেন। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত সেই বাণী গুলির সঠিক মর্মার্থ বুঝে নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করা , হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ করা।
সন্ত কবীর ও তার অমূল্য দোহা সংক্রান্ত আজকের এই পোষ্টটি আপনাদের পছন্দ হলে আশা করব আপনারা আপনাদের বন্ধু মহলে, পরিজনকেও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্টটি শেয়ার করে নেবেন।
FAQ :
সন্ত কবির কোন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
ভক্তি আন্দোলন
কবীর কে ছিলেন?
কবীর দাস যিনি মূলত সন্ত কবীর বলে বহুল পরিচিত, ছিলেন একজন পঞ্চদশ শতাব্দীর ভারতীয় মরমী কবি এবং সাধু।
দোহা কি?
কবিতার আকারে লেখা উপদেশ সম্বলিত ছোট ছোট বাণীকে দোহা বলা হয়ে থাকে।
কবীরের রচিত দোহা কোন ভাষায় বেশি প্রচলিত?
হিন্দি ভাষায়।
ঈশ্বর সম্বন্ধে কবীরের কি ধারণা ছিল?
কবীর বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় ; কেবল বিভিন্ন নামে তাঁর উপাসনা করা। হয়।