পড়েন নিন গোপাল ভাঁড় এর দমফাটা হাসির গল্পগুলি ( Gopal Bhar Stories PDF ). ছোটবেলায় শোনা এই গল্পগুলি সকলের জন্যেই শিক্ষামূলক ও কৌতুকময়. আমাদের আগের পোস্ট টিও দেখে নিন যেখানে আমরা আরো ১০০ টি গোপাল ভার এর গল্প শেয়ার করেছি. আর এই গল্পগুলি নিজের মোবাইল এ সেভ করার জন্যে পোস্টটির নিচে গিয়ে ডাউনলোড ও করতে পারেন.
রঙ্গ রসিকতার জগতে গোপাল ভাঁড় এর নাম সবথেকে প্রথমেই আসে আর গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলি এতই চটুল, বুদ্ধিদীপ্ত এবং রসিকতা সম্পন্ন হয় যে আবাল বৃদ্ধ বণিতা থেকে শুরু করে রামগরুড়ের ছানারা ও হাসতে বাধ্য হয় প্রায় দুশো বছরেরও অধিক আবহমানকাল ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে তাঁর জীবন-রস সমৃদ্ধ গল্পগুলি যা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষী মানুষের মাঝে ও লোককথায় এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে। Gopal Bharer golpo গুলি এতই জনপ্রিয় যে এর মধ্যে কতগুলি গল্প প্রায় প্রবাদের মত ব্যবহার করা হয় লোকমুখে । ইতিমধ্যেই গোপাল ভাঁড়ের গল্পের সম্ভার নিয়ে তৈরি হয়েছে মজাদার সিরিয়াল বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ; বিভিন্ন অ্যানিমেশন ভিডিও তৈরি হয়েছে গোপাল ভাঁড়ের গল্পকে কেন্দ্র করে কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজে পাঠ করে গল্পগুলির পড়ার আনন্দটাই আলাদা ।
প্লিজ ভালো লাগলে সকলের সাথে শেয়ার করবেন এই পোস্ট টি.
- মহাজনের টাকার থলি
- গোপাল ও পাওনাদার
- গরীবের ঘোড়া রোগ
- গোপালের গুরু
- গোপালের ভাইপো
- গোপাল ভার এর আলু কেনা
- বিয়ের ঘটকালি
- গোপাল ভার এর চিঠি লেখা
- কোলাকুলি
- বিয়ের সম্বন্ধ
- কান টানলেই মাথা আসে
- দাবা খেলা
- গোপাল ও কবি
- গোপাল ও নবাব
- বরযাত্রী
- গোপাল ও মা কালী
- উটকো লোক
- আলুর গুদামে আগুন
- স্মৃতি-শক্তি
- গোপাল ও বালক
- কানভারী
- গোপাল ও কল্কে
- গোপালের ঘোড়া
- সূর্য উঠেছে কিনা
- গোপালের গোয়েন্দাগিরি
- ঘ্রাণেন অর্দ্ধ-ভোজনং
- গোপালের সূক্ষ্ম বিচার
- গোপাল ও মৌলবী
- গোপালের পাঞ্জাবি
- গোপালের ন্যায়
- গোপাল ভাঁড়ের ভাইপো
- গোপন কথা
- তোমার পালা
- বিদেশী পথিক
- Download Gopal Bhar Stories in PDF
Show full list
মহাজনের টাকার থলি
ভদ্রলোক টাকার থলে সহ নৌকা করে নদীর ওপারে যাচ্ছিলেন। মাঝ নদিতে হঠাৎ করে নৌকাটা ডুবে যায়। তীরে গোপাল ও তার বন্ধুবান্ধবরা দাড়িয়ে ছিল তারা অনেক কষ্টে ভদ্রলোককে তীরে টেনে তুলতে সমর্থ হয়। নাহলে স্রোতের টানে তাঁকে অক্কা পেতে হত। কিন্তু মহাজনের ভারি টাকার থলিটি বর্ষার ভরা নদীতে কোথায় তলিয়ে গেল। গোপালরা জানতে পারল না।
ডাঙায় তোলার কিছু পর ভদ্রলোক জ্ঞান ফিরে পেয়ে গোপালদের গালাগাল করতে থাকেন। আমার নদি থেকে না তুলেযদি টাকার থলেটি তুলতে পারতেন তবে বুঝতুম একটা বাহাদুরী কাজ করেছেন। আপনারা সব অকর্মার ঢেকি, একদম অপদার্থ। এরূপ লোকদের দুচোখে দেখতে পারি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব শুনে গোপাল বলে, আপনাকে মানুষ ভেবে জান বাঁচিয়ে মহাদোষ করে ফেলেছি তাই আমরা ঢেকি। যদি আগে জানতাম আপনি অকৃতজ্ঞ জন্তু বিশেষ–যার কাছে জানের আপনি অকৃতজ্ঞ জন্তু বিশেষ–যার কাছে জানের চেয়ে টাকার থলি বড়, তাহলে আপনার ওই মাংসের ঢিবিকে আমরা স্পর্শও করতাম না। আপনি ঢোক ঢোক লোনা জল খেয়ে টাকার টুং টুং শব্দ শুনতে শুনতে ভবপারে যাওয়ার ঢং ঢং বাদ্যি এতক্ষণ শুনতেন। এই বলে সকলে সেখান থেকে রাগ করে চলে গেল।
গোপাল ও পাওনাদার
গোপাল একজন লোকের কাছে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। সেই পাওনাদার গোপালকে পথের মাঝে পাকড়াও করে বললেন দুদিনের মধ্যে টাকা না দিলে আমি তোমার শ্রাদ্ধ করে ছেড়ে দেব বাছাধন। তখন কেমন মজা পাবে দেখবে। পাওনাদারের কথা শুনে গোপাল মুচকি হেসে বলেন, টাকা ধার দিয়ে ফেরত পাচ্ছেন না, উপরন্তু আমার শ্রাদ্ধের খরচও বহন করতে চাইছেন? ওই কাজটা দাদা আমার ছেলেকে করতে দিন। আমার শ্রাদ্ধ করলে আমি কি স্বর্গ থেকে টাকা নিয়ে আশীর্বাদ করতে আসব নাকি বন্ধু! এই বলে মুচকি মুচকি হাসলে লাগলো।
গরীবের ঘোড়া রোগ
মহিমাচরণ নামে এক গরীব প্রতিবেশী একদিন গোপালের কাছে এসে বললেন, বুঝলে ভায়া, একটা মাত্র ছেলে, ছেলেটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি শিউরে উঠি মাঝে মাঝে। ছেলেটা দেখছি আমায় শান্তিতে মরতেও দেবে না। মরে গেলে যে কি করবে কুল কিনারা পাই না। কোনও বুদ্ধি দিতে পারেন এ ব্যাপারে? কেন, কি হয়েছে তার? গরীবের ঘোড়া রোগ হলে যা হয়! খায়-দায় আর সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। একটুও ভাবনা-চিন্তা নেই-কি করে পরে খাবে পরবে। আমি মরে গেলে সংসারের কি হাল হবে? সে কোন কাজকর্মে মন দিচ্ছে না। তা অত-ভাবনা কিসের? বোঝাই যাচ্ছে আপনার ছেলে গো-বেচারা নয়, তাই রত্নটি ঘোড়া রোগে মারা যাবে না। ওই লায়েক ছেলেকে এক ডাগর মেয়ে দেখে বড় ঘরে বিয়ে দিয়ে বড়লোক করে দিন- ঘোড়া রোগও সেরে যাবে।
গোপালের গুরু
গোপালের একবার একটি গুরু হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে বনবাদাড়ে খুঁজে খুঁজে সে বিকেলে নিজের বাড়ির দাওয়ায় ধপাস করে বসে ছেলেকে ডেকে বললে, ও ভাই, জলাদি এক ঘটি জল আনো, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। গোপাল হা-হুতাশ করে বলতে থাকে, ভাইরে! আর বুঝি বাঁচি না। ঘরে গোপালের কোন ভাই থাকত না। একমাত্র ছেলে, বৌনিয়ে গোপালের সংসার। গোপালের স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল, সে গোপালের কথা শুনে বললে, মিনসের এতটা বয়েস হলো তবু যদি একটু কান্ডজ্ঞান থাকত! নিজের ছেলেকে ভাই বলে ডাকছে গা! ঘরে ছেলে ছাড়া কি আর কটা ভাই আছে গো তোমার! স্ত্রীর কথা শুনে গোপাল বললে, সাধের গুরু হারালে এমনই হয় মা! স্ত্রী মা ডাক শুনে একহাত জিভ বের করে সেখান থেকে পালিয়ে যেন বাঁচে। এ আবার কি কথা?
গোপালের ভাইপো
গোপালের ভাইপো গোপালের মতোই সেয়ানা। তবে গোপালের মত বুদ্ধি করে এত পয়সা রোজগার করতে পারত না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আর্থিক আনুকুল্যে গোপাল পাকাবাড়ি তুলেছিল কিন্তু তার ভাইপোর পক্ষে তখনও পাকাবাড়ি তোলা সম্ভব হয়নি। কুঁড়েঘরেই বাস করতে হতো তাকে। লোক দেখানো বুদ্ধি কম থাকার জন্য পয়সা রোজগার করত কম। গোপাল একদিন তার পাকাবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গড়গড়া টানতে টানতে তার ভাইপোকে ডাক দিয়ে বলল, ওরে হাবু, এই অসময়ে বাড়ির ভেতর বসে কি করছিস রে? এদিকে আয় আমি ছাদে বসে আছি। তোকে একটা জিনিষ দেখাব।
গোপালের ভাইপো হাবু বাড়ির ভেতরেই ছিল। গোপালের ডাক শুনতে পেয়ও সেদিন বাড়ির বাইরে বেরোয়নি বা গোপালের ডাকে সাড়াও দেয়নি। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল যে, তার কাকা তাকে সহসা ডাকে না; নুতন পাকা বাড়ির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্যই এখন ডাকাডাকি করছে। নইলে যে কাকা সচরাচর কোনও খোঁজ নেয় না, সে কেন দরাজ গলায় ডাকছে এই অসময়ে। গোপাল কাকার খোঁজ নেওয়ার কোন প্রয়োজন ভাইপোর নেই-ভাইপো এই সিদ্ধান্ত মনে মনে নিয়ে নিঃসাড়ে চুপচাপ রইল। গোপালের কথায় কান দিলোনা বা ছাদে গেলও না।
এই ঘটনার প্রায় দুবছর পরে গোপালের ভাইপো নিজের চেষ্টায় পাকাবাড়ি তৈরি করল অনেক কষ্টে টাকা রোজগার করে। তার নতুন পাকাবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সে গোপালকে বললে, ও গোপাল কাকা দুবছর আগে ছাদে দাঁড়িয়ে আমায় যেন কি বলেছিলে? তুমি আমার ছাদে এসো বলছি। গোপাল সেদিন বুঝতে পারল যে তার ভাইপো বোকা নয়- তার মতই সেয়ানা হয়েছে দেখছি। নইলে দুবছর পরে কেউ আবার সাড়া দেয়? গোপাল তখন মনে মনে তারিফের হাসি হাসতে লাগল তার ভাইপোও বেশ সেয়ানা হয়েছে দেখে।
গোপাল ভার এর আলু কেনা
গোপাল একবার হাটে আলু কিনতে গিয়েছিল। পথেই দেখা হল এক বন্ধুর সাথে। রসিক বন্ধুটি গোপালের আলু খরিদ করার কথা শুনে বলল, তুমি যদি আলু বিনি পয়সায় খরিদ করতে পার দশ টাকা পুরষ্কার পাবে। গোপালকে বন্ধুটি রসিকতা করার লোভে একটু উসকে দিল। মনে করেছিল গোপাল পারবে না।
গোপাল বন্ধুকে বললে, ও এই কথা? তুমি আমার সাথে হাটে চল দেখবে, দিব্যি বিনি পয়সায় আলু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরব। কাউকেও কোনও পয়সা দিব না। তা তুমি সচক্ষে দেখতে পারবে।
হাটে গিয়ে গোপাল প্রত্যেক আলু বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলে ভাই, আমি যদি তোমার কাছে থেকে পাঁচ সের আলু কিনি, কটা আলু ফাউ দেবে তুমি আমাকে বল? শীতের সময় সেদিন বাজারে আলুর প্রচুর আমদানি। আলুওয়ালারা বললে পাচঁটা করে আলু ফাউ পাবেন পাঁচ সের আলু কিনলে। এর বেশি দিতে পারব না।
গোপাল তখন প্রত্যেক আলুওয়ালার ঝুড়ি থেকে পাঁচটা করে আলু তুলে নিয়ে বলল, এই হাটে কেবল ফাউটা নিলাম, সামনের হাটে তোমাদের সকলের কাছ থেকে পাঁচ সের করে আলু কিনব।
সকলেই হ্যা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। গোপাল দিব্যি বিনি পয়সার আলু কিনে বাড়ি ফিরল।
বন্ধুকে বাধ্য হয়েই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গোপালকে দশ টাকা পুরষ্কার দিতে হল। না দিলে হয়ত গোপাল কোনও সময় ১০০ টাকা হাতে তুলে নিয়ে হাওয়া করে দেবে। তার চেয়ে আগে দেওয়া ভাল।
বিয়ের ঘটকালি
গোপাল একবার একটি বিয়ের ঘটকালি করে ছিল। মেয়েটি খোঁড়া, ছেলেটি কানা। কনেপক্ষ পাত্র পক্ষ গোপালের মুখের কথায় উপর নির্ভর করেই বিয়ে পাকাপাকি করে ফেলেছিল। কনেপক্ষ জানে না যে বর কানা, আবার পাত্রীপক্ষ জানে না যে মেয়ে খোঁড়া। গোপারের ভীষণ নাম ডাকের জন্য কেউ কাউকে অবিশ্বাস করতে পারে নি। সবকাজ গোপালের উপরই ছেড়ে দিয়েছে।
নির্বিঘ্নে বিয়ে হয়ে যাবার পর পাত্রকক্ষের কর্তা গোপালকে ডেকে বললেন, কনেপক্ষের লোকেরা জানতেই পারেনি যে, বর কানা। বরকে কানা দেখলে কোন বাপ মেয়েই দিত না। এর জন্য আপনার কাছে বেশ কৃতজ্ঞ আমরা। এই বলে পাত্রপক্ষের লোকেরা কিছু পুরষ্কার বাবদ টাকা দিল। গোপাল তা মুখটি চেপে নির্বিবঘ্নে তাদেরকে কিছু না বলে নিয়ে নিল।
এদিকে কন্যাপক্ষের লোক এল। মেয়েটি যে খোঁড়া পাত্রপক্ষের লোকেরা জানিতেই পারেনি, কি বল গোপাল! এই বলে কন্যাপক্ষের লোকেরা গোপালকে কিছু পুরষ্কার দিল।
দুপক্ষের কাছে মোটা বকসিস পেয়ে পুলকে গোপাল মনে মনে হাসতে হাসলে বলল, আপনারা মহাশয় ব্যক্তি। তাহলে সব কথা খুলে বলি শুনুন, আপনার মেয়েটি খোঁড়া আর বরও কানা। এতে অবশ্য দুপক্ষের চিন্তা ভাবনা করার কোনও কারণই নেই।
গোপালের কথা শুনে বর পক্ষের আক্কেল গুডুম। বললেন, অ্যাঁ, বলো কি। পাত্রী খোঁড়া? আগে এ কথা আমাদের বলেননি কেন?
গোপাল বললে, নইলে মানাবে কেন দাদা? না মানালে আমরাই যে বদনাম। আমি তো কারও কাছে বদনাম শুনতে রাজি নই। এখন, আপনাদের আর কারোর কিছু বলার থাকলো না।
গোপাল ভার এর চিঠি লেখা
গোপাল লেখাপড়া বিশেষ কিছু জানত না। যদি বা লেখাপাড় কিছু জানত কিন্তু হাতের লেখা ছিল খুব খারাপ। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভাঁড় হিসাবে তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাড়া পড়শীরা তাই তাকে সমীহ করে চলত- কেউ কেউ বা বিভিন্ন প্রয়োজনে গোপালের সঙ্গে এসে দেখা করত পরামর্শ নিত, গোপালের বুদ্ধি নিয়ে প্রায় সকলে চলত ।
একদিন এক বুড়ি এসে বলল, গোপাল ভাই, আমার একখানা চিঠি লিখে দাও না। আমার নছেলে পুরী থেকে দশক্রোশ দূরে নাগেশ্বরপুর গেছে। কোনও খবর পাচ্ছিনে বেশ কয়েকদিন হল। টাকা পয়সাও নাই যে কাউবে পাঠাব।
বুড়ির কথা শুনে গোপাল বললে, আজ তো আমি চিঠি লিখতে পারব না ঠাকমা।
কেন ভাই, আজ কি যে, তুমি চিঠি লিখতে পারবে না। অনেকদিন হয়ে গেছে আজ না লিখলেও নয়। আর তোমার দেখা সব সময়পাই না যে তোমাকে চিঠি লিখতে বলি। আজ দেখা পেয়েছি, একখানা চিঠি লিখে দাও না ভাই? আমি বুড়ো মানুষ কার কাছে যাব চিঠি লিখতে ভাই, তুমিই একমাত্র ভরসা।
আমার যে পায়ে ব্যাথ্যা গো ঠাকমা।
পায়ে ব্যথা তাতে কি হয়েছে? চিঠি লিখবে তো হাত দিয়ে? পায়ে কি তুমি চিঠি লিখবে নাকি। তোমার কথা শুনলে হাসি পায়। তোমার মত এমন কথা কোথাও শুনিনি।
গোপাল হেসে বলল, চিঠি তো লিখব হাত দিয়েই। কিন্তু আমার চিঠি অন্য কেউ যে পড়তে পারবে না। আমার লেকা চিঠি আমাকে নিজে গিয়ে পড়েদিয়ে আসতে হবে। আমার যে এখন পায়ে ব্যথা। এখান থেকে পুরী আবার পুরী থেকে দশ ক্রোশ দূরে নাগেশ্বরপুরে চিঠিটা তো আমি পুড়ে দিয়ে আসতে পারব না। তুমি অন্য কাউকে দিয়ে চিঠিখানা এবারকার মতো লিখিয়ে নাও, ঠাকমা। আমার পা ভাল হলে চিঠি লিখে দেব এবং নিজে দিয়ে পড়ে আসব।
বুড়ি মা এর পর আর কি বলবে। বাধ্য হয়ে চিঠি না লিখিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হল গোপালের বাড়ি থেকে।
কোলাকুলি
বিজয়ার পরদিন পথের মাঝে গোপাল অপরজনের সঙ্গে কোলাকুলি করল। কোলাকুলি করার সময় গোপাল অপরের ট্যাক থেকে একটি টাকা, আর অপরজন গোপালের ট্যাক থেকে কিছু খুচরো পয়সা বাগিয়ে নিল। সে খুচরো পয়সা গুনে দেখলে…. এক টাকারই খুচরা রয়েছে। গোপালের পকেটে মাত্র একটাকাই ছিল জেনে মনে মনে বেশ একটু ক্ষুন্ন হল, তখন গোপাল অপরজনকে বললে, এসো ভাই, আবার আমরা কোলাকুলি করি। যার ট্যাকে যা ছিল তাই ফিরিয়ে দিই। আমাদের উভয়ের যে একই পেশা, এই কোলাকুলির দ্বারা তো বেশ ভালই বোঝা গেল। এখন থেকে আমরা দুজন দুজনের বন্ধু।
বিয়ের সম্বন্ধ
গোপাল এক বাড়িতে প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করতে গিয়েছিল। বরের বাপ ছেলেকে ডেকে বললেন, ওরে পদ্মলোচন তোকে দেখতে এসেছে রে- একবার এ ঘরে আয়। সকলে তোকে দেখতে চায় বাবা।
যে ছেলেটি ঘরে এল, সে ছেলেটি কানা। গোপাল বরের বাবাকে জিজ্ঞেস করলে, এই বর বুঝি? বরের বাবা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
তখন গোপাল বললে, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন? তা বেশ রেখেছেন।
কান টানলেই মাথা আসে
পন্ডিত মশাই একবার মহারাজের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বললেন, আপনার ছেলে মোটেই লেখাপড়া করছে না! পড়ার সময় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আরও লেখাপড়ায় মাথা একেবারেই ঘামায় না।
রাজা ছেলের ওপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে পন্ডিত মশায়কে বললেন, এবারও যদি পাঠশালায় যায়, বেশ কষে কান টানবেন।
মহারাজের কথা শুনে গোপাল সঙ্গে সঙ্গে বলল আপনি যথার্থই বলেছেন, কান টানলেই মাথা আসে। সকলে তখন হেসেই লুটোপুটি।
দাবা খেলা
গোপাল মাঝে মাঝে কারও না কারোর সঙ্গে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে দাবা খেলতো। গোপালের সঙ্গে দাবা খেলার জ্ন্য প্রায়ই কেউ না কেউ দুই মাইল দূর থেকেও হেটে আসতেন। অন্ততঃ এক বাজি খেলতে না পারলে অথবা কারও সঙ্গে দাবায় হেরে গেলে গোপাল সে রাতে মোটেই ঘুমাতে পারতো না। সারারাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু ছটফট করত। দাবা খেলায় ভীষণ নেশা গোপালের বলতে গেলে, দাবা খেলার সময় গোপাল বাহ্যজ্ঞানই হারিয়ে ফেলত। একদিন গোপাল দাবা খেলছিল, আর এক চাল দিলেই কিস্তিমাত হয় আর কি?
এমন সময় বাড়ি থেকে একটা চাকর ছুটে এসে খবর দিলে, বাবু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন। কর্তা মাকে সাপে কামড়েছে। কর্তামা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। ডাক্তার আনতে হবে।
গোপাল তখন দাবার নেশায় এমনই মত্ত যে চাল দিতে দিতে চাকরকে বললে, কাদের সাপ? কার হুকুমে কর্তা মাকে কামড়াল? সাপটার বিরুদ্ধে রাজার দরবারে নালিশ ঠুকে দিয়ে, এখনি ছুটে চলে যা একটু পরেই আমি যাচ্ছি।
চাকর বেচারা কর্তাবাবুর কথা শুনে হ্য করে দাড়িয়ে রইল।
গোপাল ও কবি
‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের রচয়িতা কবি ভারতচন্দ্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। আদি রস পরিবেশনের ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ তখনকার দিনে কেউ ছিলেন না। কৃষ্ণচন্দ্রেরও সমঝদার শ্রোতা ছিলেন, কবি রাজাকে বিদ্যাসুন্দর পড়ে শুনাচ্ছিলেন।
গোপাল রাজসভায় ঢুকে কবিকে কাব্যের পান্ডুলিপিটা কাৎ করে ধরে পড়তে দেখে চেচিয়ে বল উঠল, একি করছেন কবি? আপনার কাব্য যে রসে টই টম্বুর। কাৎ করবেন না দাদা, রস গড়িয়ে পড়বে। সোজা করে ধরুন।
গোপালের কথা শুনে রাজসভাস্থ সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। কৃষ্ণচন্দ্র এরূপ সুন্দর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে গোপালকে মনের মতো পুরষ্কৃত করলেন।
গোপাল ও নবাব
এক ভদ্রলোক মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে কাজ করতেন। প্রয়োজনে গোপালকে একবার নবাব দরবারে যেতে হয়েছিল। গোপালকে দেখেই ভদ্রলোক তার হাতে পঞ্চাশটি টাকা দিয়ে বললেন, দাদা দয়া করে টাকাটা আপনি বাড়ী গিয়ে আমার স্ত্রীর হাতে চুপি চুপি দেবেন, আমার বাড়ির অন্য কেউ যেন টের না পায়, তাহলে খুব অনর্থ হবে।
গোপাল টাকাকে ট্যাকে গুজে বললে, আপনি নিশ্চিত থাকুন মশায়, আপনার এই টাকা দেওয়ার কথা কাক পক্ষীতেও টের পাবে না। এমন কি, আপনি যার হাতে টাকা দিতে বলেছেন তিনিও নয়। মানে, গোপাল সে টাকাটা কাউকেও না দিয়ে নিজেই আত্মসাং করবার মতলবে রইল।
বরযাত্রী
গোপাল একবার বরযাত্রী হয়ে বিয়ে বাড়ীতে গিয়েছিল। কনে পক্ষের একজন বয়ষ্ক রসিক ব্যক্তি গোপালের সঙ্গে রসিকতা করার উদ্দেশ্যে বললে, এই যে গোপাল তুমিও দেখছি বরযাত্রী হয়ে এসেছ। জানো তো আমাদের এখানে অনেক বাদর আছে। এখানে বাদরের অত্যাচার ভীষণ। অবশ্য তোমার চেহারও বাদরের মত। বাদরদের মধ্যিখানে তোমাকে মানাবে ভাল কি বলো? বাদর যদি কেউ ইতিপূর্বে না দেখে থাকে- এ যাত্রায় বাদর দেখাও হয়ে যাবে। আর কথা খাওয়াও দেখবে।
গোপাল তখন কনেপক্ষের সেই ভদ্রলোককে বলল, মশায় এর আগেও আমি ঢের বাদর দেখেছি কিন্তু আপনার মতো এমন অসভ্য বাদর কোথাও কোনদিন দেখিনি! এবার ভদ্রলোক মুখের মাপমত জবাব পেয়ে একেবারেই চুপ।
গোপাল ও মা কালী
গোপাল একদিন পাশা খেলতে খেলতে দাতের যন্ত্রনায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। অসম্ভব যন্ত্রণ যাকে বলে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সে শুয়ে পড়ে কাতরাতে কাতরাতে বলতে লাগল, দোহাই মা কালী! এ যাত্রায় আমার যন্ত্রণাটা কমিয়ে দাও….. আমি জোড়া পাঠা বলি দেব মা পুজো দেব ভাল করে তোমায় মা-
কিছুক্ষণ পরে মা কালীর কৃপায় তার যন্ত্রনার উপশম হল। সে আবার খোশ মেজাজে পাশা খেলতে লাগল মনের আনন্দে। গোপালের পাশা খেলার সাথী এক সময় গোপালকে বললে, মায়ের দয়ায় দাঁতের যন্ত্রণা তো চ্ট করে সেরে গেল। মায়ের কাছে তাহলে জোড়া পাঠা বলি দিচ্ছ তো? মনের বাসনা, পাঠা বলি হলে বলির মাংস খাওয়া যাবে। গোপাল পাশার চাল দিয়ে খোশ মেজাজে বললে, যন্ত্রণা আমার এমনিতেই সেরে যেত। এ ব্যাপারে আর মা কালীর কেরামতি কোথায়? যন্ত্রনায় অস্তির হয়েকি বলতে কি বলে ফেলেছি, সেজন্য আবার জোড়া পাঠা বলি দিতে হবে নাকি? মা কালী আমার মাথায় থাক। তারপর গোপাল দিব্যি খোশ মেজাজে পাশা খেলতে লাগল। ওদের কথায় আর পাত্তা দিল না। খেলার সাথির মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কথায় বলে- ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পেরে গোপালের দাঁতের যন্ত্রণা আবার অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। এবারকার যন্ত্রণা আগের চেয়েও ভয়ানক। গোপাল যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মা কালীর উদ্দেশ্য হাত জোড় করে কাতরাতে কাতরাতে বললে- হে মা করুণাময়ী, হে মা দয়াময়ী হে মা জগজ্জননী যে কথা বলেছি…. সেই কথাটিই ধরে নিলে মা? আমি কি সত্যি সত্যিই বলেছি তোমার কাছে জোড়া পাঁঠা বলি দেব না? এত বোঝ মা, ঠাট্টা বোঝ না? এবার খেলার সাথীর মুখে জোর হাসি ফুটে উঠল, বলির পাঁঠার প্রসাদ মাংস নির্ঘাত পাবে এই মনে ভেবে।
উটকো লোক
গোপাল একবার এক বড় মেলায় বেড়াতে গিয়েছিল। মেলায় গোপাল মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় একটা উটকো লোক এসে গোপালকি জড়িয়ে ধরলো আচ্ছা দাদা কাশিতে মরলে লোক স্বর্গে যায় আর ব্যাস কাশীতে মরলে নাকি গাধা হয়। কিন্তু যারা কাশি ও ব্যাসকাশীর ঠিক মাঝখানে মরে, তারা কি হয়? আপনি বলতে পারেন দাদা আমার জানতে ইচ্ছে?
গোপাল বললে- মশায়, তারা আপনার মতো উটকো হয়। কথা নেই বার্তা নাই চেনা নাই শুনা নাই…. দুম করে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন। একে বলে উটকো লোক।
আলুর গুদামে আগুন
একবার এক আলুর গুদামে আগুন লেগেছিল। গোপাল সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে তা দেখতে পেয়ে, একটা মুদির দোকান থেকে, একটু নুন চেয়ে নিল। তারপর সেই গুদামের পোড়া আলু, নুন সহযোগে দিব্যি খেতে লাগল। কিছু দুরে গুদামের মালিক মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। গোপাল নুন দিয়ে আরামে পোড়া আলু খেতে খেতে তার কাছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলে, মশায় আপনি কে?
এরূপ দুঃখিত ভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন কেন?
লোকটি বলল, আমি এই গুদামের মালিক। আমার চারটে আলুর গুদামের মধ্যে একটা পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল। গ্রহের ফেরে খুব লোকসানের মধ্যে পড়ে গেলাম।
গোপাল নির্বিকারভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা আপনার বাদ-বাকি গুদাম যে তিনটি আছে সেগুলি কবে কবে পুড়বে বলতে পারেন? তাহলে আলু পোড়া খেতে পারব।
গোপালের কথা শুনে আলুর গুদামের মালিক, চটে উঠে লাঠি নিয়ে মারতে তাড়া করল। গুদাম পুড়ে যাওয়ায় বেচারার এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ, তার উপর গোপালের এ হেন অলুক্ষণে কথা! বেগতিক দেখে গোপাল আর কোন কথা না বলে পালিয়ে বাঁচল। মনে মনে বলল বাবা বদমেজাজের চোটে সব আলূনি হয়ে গেল। তেল আক্রার এই বাজারে আলুভাজা বা আলুভাতের বদলে মুফতে আলু পোড়া খাওয়ার যে মজা সে কথা আর কোনদিন বলব না কোন বে আক্কেল ভদ্রলোককে।
স্মৃতি-শক্তি
গোপালের প্রখর ভাবে স্মৃতি-শক্তি ছিল। ভালভাবে বলতে হলে বলা যায় অসাধারণ। তার মনের পর্দায় যেন সবকিছু ছাপা হয়ে যায় অবিকল। হাবভাব এমনকি কথার টুকিটাকিও। সাধারণ মানুষের মধ্যে অমন স্মৃতি-শক্তি থাকার কথা নয়। একবার নিশ্চিব্দি পুরের জমিদার ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে না পাড়ায় মোড়ে গোপালকে দেখেতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন গোপাল তোমার অসুখ সেরেছে তো?
গোপাল কোন জবাব দেওয়ার আগেই জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে নিশ্চিব্দি পুরের জমিদার সেদিন ওখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। ঐ ঘটনার সাত আট বছর পরে, আবার নপাড়ার মোড়েই গোপালের সঙ্গে নিশ্চিন্দি পুরের জমিদারের হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। এবার কিন্তু জমিদার পাল্কি করে যাচ্ছিলেন। ভীষণ গরম পড়ে ছিল বলে পাল্কির দরজা খোলাই ছিল। হাওয়া লাগার জন্য জমিদার নতুন করে প্রশ্ন করা আগেই সেই সাত আট বছর আগেকার প্রশ্নের জবাব দিল, আমার অসুখ সেরে গেছে হুজুর। এখন আমি ভাল আছি।
জমিদার এ কথার মানে না বুঝতে পেরে, অবাক হয়ে গোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণপরে যখন কথাটার মানে বুঝতে পারলেন তখন হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ধন্যি গোপাল তোমার দ্বারাই এটা সম্ভব। ঠিক মনে রেখেছ …
গোপাল ও বালক
এক বালক গোপালের বাগানে ফল পেড়ে খাচ্ছিল। প্রতিবেশী লোকেরা ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এল বাগান থেকে। যথাসময়ে ছেলেটাকে গোপালের কাছে ধরে নিয়ে এসে হাজির করল। ছেলেটার বিচার করবার জন্য গোপালকে বলল দৈব ক্রমে সেই সময় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর প্রিয়বয়স্য গোপালের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তার জন্য গোপাল ও সবিনয় মহারাজের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিল।
মহারাজ খুব গম্ভীর হয়ে সেই বালককে লক্ষ্য করে কয়েকটি উপদেশের বানী শুনালেন। চুরি করা ভীষণ দোষ, কারো কোন জিনিষ চুরি করা উচিৎ নয়। যে কোন লোক চুরি করলে ভীষণ শাস্তি পেতে হয়। এইরূপ অনেক কিছু কথা বলার পর মহারাজ সেই বালককে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা তোমার যদি একটা বাগান থাকত আর সেই বাগানে ঢুকে তোমার মত কোন ছেলে যদি ফল চুরি করত তখন তুমি তাকে কি করতে তোমার মুখেই শুনতে চাই বলত দেখি?
বালক বিনিত হয়ে নম্রভাবে বলল, মহারাজ প্রথমবার আর কি করব? বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে যাতে আর কোন দিন চুরি না করে এবং আপনার মত এই উপদেশের কথামত বলে সাবধান করে ছেড়ে দিতারম প্রথম বারের মত। তা ছাড়া আর কি করব বলুন।
বালকের এই কথা শুনে মহারাজ হেসে ফেললেন, মনে মনে ভাবলেন বাঃ ছেলের বিচার বুদ্ধি দেখছি বেশ সুন্দর, ঠিক আছে ওর কথা মত এবার একে সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হোক।
বলা বাহুল্য মহারাজ সাবধান করে বালককে ছেড়ে দিলেন। দেখো আর যেন দ্বিতীয়বার তোমার কথামত কোনদিন যেন চুরি না কর। এবারের মত তোমাকে মাফ করে দেওয়া হল তোমারই কথামত।
কানভারী
একদিন গোপালের কোনও বন্ধু এসে মহারাজকে কানভারী করার জন্য গোপনে জানালে, গোপাল আপনার একজন কর্মচারী। লোকটাকে আপনি খুব বিশ্বাস করেন। তাই তার হাতেই টাকাকড়ি খরচ করার ভার দিয়েছেন। তিনি আপনার অনেক টাকা সরিয়েছেন…… আপনি হিসেব মিলিয়ে দেখুন।
মহারাজ প্রথমে কিছুতেই লোকটিকে কথা কানে তুলতে চান না। বলেন-গোপাল আমার বিশ্বাসী লোক, সে কখনও অমন কাজ করতে পারে না। কোনদিন টাকা পয়সা এদিক ওদিক করবার লোক সে নয়।আমি তাকে বিশ্বাস করি’ তখন লোকটি দফায় দফায় গোপালের খরচের নমুনা বলতে লাগল। সে অমুক তারিকে অত হাজার টাকা গাপ্ করেছে… অমুক তারিখে অমুক সম্পত্তি নিজের নামে কিনেছে হিসাবের খাতায়…… অমুক তারিখে এক হাজার টাকা জমা দিয়েছে…… আবার অমুক তারিখে…. জাল রসিদ দাখিল করে, তিন হাজার টাকা বার করে নিয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি কত কথা বলে গেল…… মহারাজ এইসব বিষয় অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর খাতাপত্র পরীক্ষা করে দেখলেন লোকটির সমস্ত কথাই সত্যি। কিন্তু সে টাকা মহারাজ নিজে থেকেই দিয়েছেন। যেমন দিয়েছেন প্রায় সবই মিলে যাচ্ছে, সেজন্য মনে মনে হাসতে লাগলেন।
তখন তিনি বললেন, আমার বাড়ীতে আমার অন্য কর্মচারী বা আমি কিছুই জানলাম না, অথচ, বাইরের লোক হয়ে তুমি এত সব খবর জানলে কি করে মশাই? গোপাল কি তোমাকে সব জানিয়েছে? লোকটি বললে, গোপালের যা আয় তার চাইতে ব্যায় অনেক বেশী। ও প্রচুর টাকা ওড়াচ্ছে অনবরত! তাই গোপালের নামে নালিশ করলাম সাবধান হওয়ার জন্য।
মহারাজ বললেন তা হটে। তোমার নাম-ধামটা বাপু আগে জানতে চাই। তুমি কোথায় থাক এবং তোমার নাম কি? লোকটি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলে, আমার নাম? কেন মহারাজ? আমি কি আপনার চুরি করেছি নাকি যে, আমার নাম-ধাম জানতে চাইছেন? আমি আপনাকে সত্যি কথাই বলছি।
মহারাজ বললেন, কারণ দুই নম্বর আসামী বলে তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হবে কিনা! তুমি হচ্ছো গোপালের পরামর্শদাতা ও বখরাদার। তা নইলে এমন সব গোপনীয় কথা খাতাপত্র না দেখেই তুমি জানতে পারলে কি করে? গোপাল যা কিছু করেছে, সব তোমারই পরামর্শমত। বোধ হয় ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে, তাই গোপালকে ধরিয়ে দিতে এসেছ-এই না? যাক নিজের চরকায় তেল দেও, পরের চরকায় তেল না দিলেও চলবে।
লোকটি মুখ নীচু করে চলে গেল।
গোপাল ও কল্কে
এখন বাবা তামাক খাচ্ছেন। গোপাল কলকে পাবার আশায় বসে আছে। গোঁসাই মাঝেমাঝে এমন জোরে টান দিচেছন যে তাতে গোপালের মনে হচ্ছে, এই বুঝি এবার গোঁসাইয়ের তামাক খাওয়া শেষ হলো। সে অমনি হাত বাড়াচ্ছে কলকের জন্যে। কিন্তু গোঁসাই এর তামাক খাওয়া আর শেষ হয় না।
শেষে গোঁসাইবাবা বলে উঠলেন কি হে! বারে বারে বেড়ালের মত থাবা বাড়াও কেন? কিছু দেখছ নাকি?
গোপাল বললে-ইদুর ভেবে হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি এটা ছুঁচো-ছাড়া আর কিছু নয়।
গোঁসাইবাবা এবার তোতলামির হাসি হেসে কলকেটা গোপালকে দিয়ে বললেন-এবার পেসাদ টান বাবা। আমার শাস্তি হয়ে গেছে।
গোপালের ঘোড়া
গোপাল একটা নতুন ঘোড়া কিনেছে। গোপাল তাই নিজে সখ করে তার সাজ পরাতে গিয়েছে। নিজের পছন্দমত কোনমতে সাজ এঁটে দেওয়ার পর, একটা চাকর বলে উঠলো। বাবু সাজ উলটো হলো যে।
গোপালের নিজের মনেও সন্দেহ হচ্ছিল যে, তার হয়তো সাজ পরানো ঠিক হয়নি। কিন্তু তাই বলে চাকরে ভুল ধরবে? এ হতেই পারে না।
তিনি চটে বললেন কেন? উলটো হবে কেন রে বোকা? চাকর বললে, এ দিকটা থাকবে আপনার মুখের দিকে ও দিকটা থাকবে পিঠের দিকে। তাহলেই ঠিক হবে বাবু। গোপাল ধমকে বলল ব্যাটা ফাজিল মূর্খ। তুই কী করে জানলি, আমি কোন দিকে মুখ করে বসবো তুই যেন সবজান্তা হয়ে বসে আছিস্? গোপাল কোনমতে ছোট হতে পারছিল না।
সূর্য উঠেছে কিনা
একদিন জরুরী দরকারের জন্য গোপাল খুব সকালে উঠেই রাজদরবারে যাবার কথা। সে স্ত্রীকে বললে, সে ঘুমিয়ে পড়লে স্ত্রী যেন তাকে ডেকে দেয় খুব ভোর বেলায়। ভোর হয়নি। স্বামীর ঘুম আগেই ভেঙ্গে গেল। সে বললে, দেখ তো, বাইরে সূর্য উঠল কিনা আমাকে বেরুতে হবেতাড়াতাড়ি। রাজবাড়িতে ভীষণ দরকার। স্ত্রী বললে ওমা, বাইরে যে অন্ধকার। কি দেখব? গোপাল চেঁচিয়ে বললে অন্ধকারে দেখতে না পাও, আলোটা জ্বেলে নিয়ে দিয়ে দেখলেই তো পারো সূর্য উঠেছে কিনা।
গোপালের গোয়েন্দাগিরি
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় যান-বাহনের খুবই অসুবিধা ছিল। স্থল-পথ ছাড়া জল-পথ দিয়েও লোক যাতায়াত করত। জল পথে বজরাই তখনকার দিনে যাতায়াতের একমাত্র উপায়।
এক মহিলাকে প্রায়ই দেখা যেত করে বজরায় উঠতে এবং এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতে একটি কাপড়ে জড়িয়ে শিশু কোলে করে। শিশুটিকে সর্দ্দি কাশির ভয়ে সব সময় কাপড় জামা দিয়ে জড়িয়ে ঢেকে রাখতেন, কেউ দেখলে মনে করত এক বছরের মত বয়স শিশুর সর্দ্দি কাশির ভয়ে এমনি ভাবে জড়ান।
গোপাল মাঝে মাঝে পথে বেড়াতে গিয়ে এই ভদ্রমহিলাকে দেখত এবং মনে মনে শিশুটির কথা ভাবত। একদিন কথা প্রসঙ্গে গোপাল মহারাজকে এই মেয়েটির কোলের শিশুটির ব্যাপারে তার সন্দেহের কথা খুলে বলল।
তখনকার দিনে দেশে প্রচুর চুরি ডাকাতি হত চুরি করা মালপত্র সেইসব জলপথে পাচার হয়ে যেত অন্য জায়গায়।
একদিন হঠাৎ যেই মেয়েটির সঙ্গে বজরায় দেখা, অমনি গোপাল ও ওর সঙ্গীরা মেয়েটিকে কোলের শিশু দেখাতে বলে। মেয়েটি কোন মতে শিশু দেখাতে রাজী হয় না। তখন গোপালরা জোর করে মেয়েটিকে কোলের ছেলেটিসহ রাজবাড়ীতে হাজির করে। মহারাজের সমনে ছেলেটিকে কোল থেকে নামাতে দেখা গেল-ছেলে নয়, জড়ানো ছেলের মধ্যে যত রাজ্যের সোনা-দানা চোরাই মাল।
বুদ্ধি ও সাহসের বলে চোর ধরার জন্য ও দেশের অনেক-উপকার করার জন্য মহারাজ গোপালকে অনেক পুরষ্কার দিলেন।
ঘ্রাণেন অর্দ্ধ-ভোজনং
এক হোটেলে হোটেলওয়ালা ও তার কোন বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল, এমন সময় দেখে যে গোপাল হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। ওই বন্ধুটি হোটেলের বন্ধুকে বলল, ওই লোকটাকে জব্দ করতে পারবে? হোটেলওয়ালী বলল এ এমন কি?
রাস্তায় হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গোপাল এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিল। হোটেলে মাংস-রান্না হচ্ছে। হঠাৎ হোটেলওয়ালা গোপালকে জব্দ করার জন্য ছুটে এসে তাকে বললে, মশাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাংসের গন্ধ শুঁকছেন নিশ্চয়ই দাম দিন শিগগির। গোপাল তো অবাক। কতক্ষণ পর বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠে বললে তোমার মাংসের গন্ধ শোঁকবার জন্যে আমি এখানে দাঁড়াইনি। দাঁড়িয়েছি, এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি ওর দরকারের জন্য। রাস্তাটা তো তোমার হোটেলের ইজারা মহল নয়। রাস্তাটা সরকারের অতএব, তোমার বলার কিছু নেই।
হোটেলওয়ালা ঝাঁজের সঙ্গে বললে তা’তে কি হয়েছে? ঘ্রাণেন অর্দ্ধ-ভোজনং। গন্ধ শুঁকলেই অর্দ্ধেক খাওয়া হলো। এক ডিশ মাংসের দাম আট আনা, তার অর্দ্ধেক চার আনা আপনাকে দিতে হবে।
তখন আট আনাতেই বড় এক প্লেট মাংস পাওয়া যেত। গোপাল চার আনার একটি সিকি পকেট থেকে বার করে হোটেলওয়ালার কানের কাছে ঠং ঠং করে বাজালে বারকতক। তারপর আবর সেটিকে পকেটে রেখে দিয়ে বললে ঘ্রাণে যদি অর্দ্ধেক-খাওয়া হয়, তবে শ্রবণেও অর্দ্ধেক পাওয়া হয়েছে। পয়সার বাদ্যি শুনেছো। গন্ধ-শোঁকার সঠিক দাম পাওয়া গেছে তোমার।
কথা কাটাকাটি শুনে সেখানে যেসব পথচারী দাঁড়িয়ে ভিড় করেছিলেন, তারা হেসে উঠলো হো হো কর। হোটেলওয়ালা মুর্খের মত জবাব পেয়ে মুখটি চুর্ন করে হোটেলের ভিতর চলে গেল গোপালের উপর টক্কর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গোপালকে জব্দ করতে এসে নিজেই জব্দ হয়ে গেল জব্বর ভাবে।
গোপালের সূক্ষ্ম বিচার
লোক পরম্পরায় গোপালের সূক্ষ্ম বিচার বৃদ্ধি দেখে এক প্রতিবেশী তার মোকদ্দমা চালাবার জন্য গোপালকে অনুরোধ করে। কিন্তু গোপাল মোকদ্দমার কাহিনী শুনে বারবার না-না করা সত্ত্বেও প্রতিবেশী লোকটি নাছোড়বান্দা হওয়ায় বাধ্য হয়ে গোপাল প্রতিবেশীর মোকদ্দমাটি হাতে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই মামলার হার হয়।
ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে বললে এ কি করলেন, আমার সব গেল। তখন গোপাল বলল, দেখুন ব্যারাম সেরে উঠতে উঠতেও লোক অনেক সময়ে হার্টফেল করে মারা যায়। তাকে ব্যারাম-মরা বলা যেতে পারে না। আপনার ব্যাপারটও ঠিক সেই রকম। মামলার বিচারে আপনি হারেন নি। হাকিমেরা মূলত তিনটি বিষয়ের উপর বিবেচনা করে রায় দেয় সাধারণত- তিনটি বিষয় হল অনুমান, প্রমাণ এবং স্বীকারোক্তি।
অনুমানটাও আপনার স্বপক্ষে ছিল, অর্থাৎ যে-কেউ মামলার বিবরণ শুনলে বলতে বাধ্য ছিল যে বিবাদী দোষী। হাকিমও নিশ্চয়ই তাই ভেবেছেন। কিন্তু অনুমানের উপর নির্ভর করে তো আর রায় দেওয়া চলে না।
দ্বিতীয়তঃ হলো প্রমাণ। প্রমাণ করা এত শক্ত যে, ওর ভেতরে শেষ পর্যন্ত গলদ থেকেই যায়। আমি আপনার মামলা প্রমাণ করে ছেড়েছি, এ কথা যাকে জিজ্ঞাসা করবেন সেই বলবে, কিন্তু ঐ যে বললাম-গলদ রয়ে গেছে গোড়ায়। থাকতেই হবে গলদ! বিপক্ষের উকিল আমাদের সব অকাট্য প্রমাণগুলি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
তৃতীয়তঃ বাকি রইল স্বীকারোক্তি। আসামী লোকটা যদি ভদ্রতা করে দোষ স্বীকার করে যেতো, তাহলে আর কোন কিছুতেই আটকাতো না আমাদের। কিন্তু তা সে কোনমতেই করলে না কিনা! তাতে আমি আর কি করতে পারি বলুন। মামলা জেতবার আগেই তো হার হলো। ব্যায়রাম থেকে সেরে উঠতে উঠতে হার্টফেল। এতে বলুন আমার কি দোষ আছে? কারণ এর বেশী আর ভদ্রলোককে কিছু বলতে পারেই না গোপাল।
ভদ্রলোক রেগেই চলে গেলেন।
গোপাল ও মৌলবী
শেখ আমীরশাহ খুব বিচক্ষণ মৌলবী ছিলেন। হিন্দুশাস্ত্রেও তাঁর বেশ দখল ছিল। তারই জোরে গোপালকে তিনি অনেক সময়ে ঠকাবার চেষ্টা করেন। অবশ্য তার ফলে নিজেই জব্দ হতেন সর্বদা। কিন্তু তাতে লজ্জা নেই তাঁর। বার বার গোপালকে ঠকাবার চেষ্টা করেও বুদ্ধিমান গোপালকে কোনমতেই ঠকানো যায় না বরং শেখ আমীরশাহই বারবার ঠকেন।
একদিন গোপান ভিন গাঁয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে গেছেন। শেখ আমীরশাহও সেই বন্ধুর বাড়িতে সেইদিন নিমন্ত্রিত। গোপাল গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে দেখেন শেখ আমিরশাহ ভোজনে বসেছেন। গোপাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খাচ্ছেন মৌলবী সাহেব?’
শেখ সাহেব শাস্ত্রের মারফত রসিকতা করবার লোভ সামলাতে পারলেন না এবার। বললেন, ‘এই যে গোপাল, তোমাদের অবতার ভোজন করছি।’ তিনি মাছ খাচ্ছিলেন, এবং মৎস্য হলো দশ-অবতারের প্রথম অবতার।
গোপালেরও শাস্ত্রজ্ঞান বেশ প্রখর। একথা শেখ সাহেব বেশ ভালোভাবেই জানেন।
গোপাল অর্থটা অন্যরকম বুঝবার ভাণ করলেন। তিনি বললেন, ‘অবতার? তৃতীয় অবতার নিশ্চয়ই?’
শেখ সাহেব ‘তোবা, তোবা’ করে লাফিয়ে উঠলেন ভোজন ত্যাগ ক’রে। কারণ হিন্দুদের তৃতীয় অবতার হলো–বরাহ বা শূকর অবতার এবং শূকরের মাংশ হলো মুসলমানদের পক্ষে নিষিদ্ধ খাদ্য।
বেশি জব্দ হয়েই সেদিন শেখ সাহেবকে উপোসেই থাকতে হলো। কারণ তিনি সেদিন আর কিছু খেতে পারলেন না। এদিকে গোপাল বন্ধুর বাড়িতে বেশ পেট ভরেই খেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বিদায় নিলেন। এবারও শেখ সাহেব হলেন ভীষণ জব্দ। তিনি খুব ব্যথিত হয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন আর কোনদিনও গোপালের সঙ্গে খারাপ রসিকতা বা খারাপ ব্যবহার করবেন না।
গোপালের পাঞ্জাবি
গোপাল নতুন পোষাক করিয়ে এনেছে। কাল রাত্রে তার বিয়ে। এই পোষাক পরেও গোপাল বিরক্তিভাবে তার মাকে বলল, ‘জানো মা, দর্জি ব্যাটা আমার পাঞ্জাবীটা লম্বায় দুই ইঞ্চি বড় করে ফেলেছে।’
পরদিন সকালবেলায় গোপাল জিনিস-পত্র কেনা-কাটা করবার জন্যে বেরিয়ে গেল। তখন মায়ের মনে হলো, বেচারার পাঞ্জাবীটা দুই ইঞ্চি লম্বা হয়েছে। কেটে ঠিক করে দিলে হয় তো! তিনি কাউকে কিছু না বলে উপরে উঠে গেলেন এবং ছেলের ঘরে বসে পাঞ্জাবীটা নিচ থেকে দুই ইঞ্চি কেটে বাদ দিয়ে দিলেন। তারপর কাটা মুখটা সেলাই করে রেখে নিচে নেমে এলেন।
গোপালের বাড়িতে ছিল দুই বোন। গত রাত্রিতে খাওয়ার সময় দাদার মন্তব্য তারাও শুনেছিল। ওই রকম বেমানান লম্বা পাঞ্জাবী প’রে বিয়ে করতে গেলে দাদাকে দেখে সবাই হাসবে, এ জিনিস তাদের সবার অসহ্য মনে হল। কিন্তু কেউ কাউরে নিজেদের মনের কথা খুলে বলল না। কিছু পরে বড় বোন আবার দুই ইঞ্চি কেটে বাদ দিয়ে সেলাই করে দিল। তারপর ছোটবোনও চুপি চুপি ঘরে প্রবেশ করে পাঞ্জাবির ঝুল নিচ থেকে আরো দুই ইঞ্চি কেটে সেলাই করে দিল। এদের কাজ কেউই জানতে পারল না।
সন্ধ্যাবেলায় বিয়ের সাজ পরতে গিয়ে গোপালের চক্ষুস্থির যে পাঞ্জাবী দুই ইঞ্চি লম্বা ছিল, তা উলটে এখন চার ইঞ্চি খাটো কি ক’রে হলো, তা সে কিছুতেই বুঝতে পারল না। সে ঘোড়ার গাড়ি ডেকে দোকানে ছুটল এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে। দোকানিকে জিজ্ঞাসা করাতে সে কিছুই বুঝতে পারল না। গোপাল রেগে মেগে দোকানীকে দু’চার কথা শুনিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলো।
বাড়ি এসে সকলের মুখে সব কথা শুনে গোপালের মেজাজ আরো খারাপ হলো। কিন্তু অন্যের উপর রাগ করে তো বিয়ে না করে থাকা যায় না। বাধ্য হয়ে গোপাল তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে আবার আর একটা পাঞ্জাবী কিনে তাই পরে রেগে-মেগে বিয়ে করতে গেল।
গোপালের ন্যায়
কুসঙ্গে পড়ে এক বালক পিতা-মাতাকে খুন করেছিল, স্রেফ টাকা পয়সা হস্তগত করার জন্যে। বালকের দাদা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় সুবিচারের আর্জি পেশ করল। বিচারে তার অপরাধ যখন প্রমাণ হয়ে গেল, তখন মহারাজের এক সভাসদ উঠে বক্তৃতা শুরু করলেল, ‘ধর্ম্মাবতার! অপরাধ গুরুতর বটে, তবে আমি বালকটির জন্য মহামান্য মহারাজের দয়া ভিক্ষা করছি। কারণ, বালকটি এখন পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ।’
… সঙ্গে সঙ্গে রাজসভার চারদিকে চাপা হাসি ও গুঞ্জন শুনে তিনি বেকুবের মত চারদিকে তাকাতে লাগলেন। কেন তিনি কি বেঁফাস কিছু বলছেন?
তখন গোপাল উঠে বলল, ‘ভেবে দেখুন, যে টাকার লোভে মা-বাবাকে হত্যা করতে পারে, সে তো পিতামাতার স্নেহের ঋণ উড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিচয় মন থেকে আগেই মুছে ফেলেছে, তখন সে পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ হয়েছে বলা যায় কি করে? অতএব, ওই পশুকে মার্জ্জনা না করাই উচিত। মহারাজ তখন বললেন, গোপাল ঠিক কথাই বলেছে–এর অবশ্যই সাজা হওয়া উচিত।’
গোপাল ভাঁড়ের ভাইপো
গোপাল ভাঁড়ের ভাইপো আর তার স্ত্রীর মধ্যে ভীষণ ঝগড়া বেধেছে। মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে গেলেন গোপাল। বললেন, ‘বলি কী নিয়ে এত ঝগড়া হচ্ছে শুনি?’
গোপালের ভাইপো বলল, ‘দেখুন তো কাকা, আমি আগামী বছর একটা দুধেল গাই কিনব বলেছি। আর আমার স্ত্রী বলছে, সে নাকি গাইয়ের দুধ দিয়ে পায়েস রাঁধবে।’ ভাইপোর স্ত্রীও সমান তেজে চেঁচিয়ে উঠল।
দু হাত তুলে দুজনকে থামতে ইঙ্গিত করে বললেন গোপাল, ‘আস্তে আস্তে! গাধা নাকি তোরা?’
দুজন একটু ঠান্ডা হলে গোপাল ভাইপোকে বললেন, ‘আরে গাধা, তোর বউয়ের পায়েস রাঁধা তো পরের কথা। আমি যে বাড়ির পেছনে সবজির বাগান করেছি, সেসব যে তোর গরু খাবে, সে খেয়াল আছে?’
গোপন কথা
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে একটা গোপন কথা বলব, কাউকে বলবে না তো?’
‘আপনার কোন কথাই আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি না’- গোপালের উত্তর!
তোমার পালা
ছোটবেলা গোপাল ভাঁড় কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে বুড়োরা তাকে ক্ষেপাত আর হাসত, ‘গোপাল, এর পর তোমার পালা।’ শুনে গোপালের খুব রাগ হত। বুড়োদের কিভাবে জব্দ করা যায়, সেই পথ খুঁজতে লাগল এবং এক সময় পেয়ে গেল। শবদাহ আর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে গিয়ে ঐসব বুড়োদের বলতে লাগল, ‘এর পর তোমার পালা!’ –
বিদেশী পথিক
এক বিদেশী পথিক রাত্রে অজানা জায়গায় এসে পড়েছে। তার উপর বৃষ্টি ও ঝড় নামল খুব জোরে। এই ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এ সময় কোথায় আশ্রয় না নিলে নয়। সে পথের ধারে এক বাড়ির দরজায় বার বার আঘাত করতে লাগল। এ গৃহ-স্বামীটি হচ্ছেন গোপাল। তিনি উপর থেকে জানালা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে হে বাপু তুমি? এত রাতে কড়া নাড়ানাড়ি করছ কেন? পথিক। আজ্ঞে আমি বহুদূর থেকে আসিয়াছি, বিদেশি পথিক। গোপাল। এখানে আপনার কি চাই? পথিক। রাত্রিটা এখানে থাকতে চাই মহাশয়। গোপাল। তা থাকতে পারো এখানে। তার জন্য আমাকে ডাকবার কোন দরকার ছিল না তো। ওটা সরকারী রাস্তা, যে কেউ ওখানে থাকতে পারে। বাড়ির বাইরের এই আশ্রয়টুকুর জন্য প্রার্থনার কোন প্রয়োজনই বা কী? না না, আমার কোন আপত্তিই নাই। তুমি নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পার। কিন্তু পরে সেই পথিককে আদর করে ঘরে ডেকে নিয়ে খেতে ও আশ্রয় দিয়ে এবং শুকনো কাপর চোপড় দিয়ে তার সেদিন বহু উপকার করে ছিল।
Download Gopal Bhar Stories in PDF | ডাউনলোড করুন গোপাল ভাঁড় এর গল্পগুলি পিডিএফ ফরমেট এ
People often searches for gopal bhar story, bengali funny short stories of gopal bhanr. Download the super funny tales of Gopal Bhar in PDF format from the below link.
Recommended Read,
Bengali Student Teacher Jokes