মানবজীবনে পরিবেশের ভূমিকা, Role of environment in human life in Bengali


ভূমিকা, Introduction 

মানবজীবনে পরিবেশের প্রত্যক্ষ তথা পরােক্ষ প্রভাবকে কোনাে ভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব না। মানুষের তথা জীবজগতের বিকাশ যে পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে সম্ভব হয় সেটাই তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন –

চলে যাব —তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

মানবজীবনে পরিবেশের ভূমিকা

পরিবেশের সাথে আমাদের এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।  শিশুর জন্ম, বৃদ্ধি তথা বিকাশ তার চারপাশের পরিবেশের মধ্যে দিয়েই হয়ে থাকে, আর পরিবেশ স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন, তোষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়েই তার অভ্যন্তরস্থ মানুষকে গড়ে তোলে। তাই পরিবেশকে মানুষের দ্বিতীয় জননী বলা হয়। একটি সুস্থ মন তথা দেহের অধিকারী মা একটি সুস্থ এবং সুন্দর শিশু জন্ম দেন, ঠিক তেমনই একটি সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশের মধ্যে দিয়েই সুস্থ এবং সুন্দর মানুষ গড়ে ওঠে।

মানবজীবনে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশের প্রকারভেদ, Types of environment influencing human life

পরিবেশকে বৃহত্তর অর্থে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— কৃত্রিম পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ বলতে আমাদের চারপাশে থাকা প্রাণ সঞ্চারকারী সকল উপাদানকে বোঝায়, আর কৃত্রিম পরিবেশ বলতে মানব সৃষ্ট পরিবেশকে বোঝায়।

মানবজীবনে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশের প্রকারভেদ

প্রাকৃতিক পরিবেশ, Natural environment

প্রকৃতির মধ্যে থেকেই মানুষের বেড়ে ওঠা। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক যুগ যুগান্তর ধরে বিদ্যমান। এই প্রকৃতির খোলা আকাশের নিচে থেকেই মানুষ উদারতার শিক্ষা পায়। চারপাশে থাকা শ্যামল, সবুজ অরণ্য মানুষের মনকে আনন্দ দান করে। সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে মানবজাতির প্রত্যক্ষ

মানবজীবনে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশের প্রকারভেদ

 তথা পরোক্ষ লীলা চলে এসেছে আদিমকাল থেকেই। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় আজ মানুষ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার, Best article on Environmental pollution and its remedies

কৃত্রিম পরিবেশ, Artificial environment

●  পারিবারিক পরিবেশ :

প্রত্যেক মানুষের প্রথম পরিচয় তথা প্রথম আশ্রয় হল তার পরিবার। সকলের জীবনেই পরিবারের এক গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পরিবারের সাহায্যে যেকোনো ব্যক্তি এক আদর্শ নাগরিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি সুস্থ পরিবার তার অন্তর্গত যেকোনো ব্যক্তিকেই সর্বাধিক সুস্থ জীবনদান করতে পারে।

●  বিদ্যালয় পরিবেশ

বাড়ি ঘরের পরিবেশের পর বিদ্যালয় হল সেই স্থান যার পরিবেশ আমাদেরকে আদর্শ ভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। বিদ্যালয়ের পরিবেশের প্রভাব প্রত্যেক মুহূর্তে একটি শিশুর মধ্যে মানসিক ক্রিয়া করে। অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয় সেখানে। একটি মানুষের চরিত্র গঠনের দিক থেকে বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, কারণ স্কুল-কলেজই হল একজন ব্যক্তির জীবন গঠনের প্রস্তুতি পর্বের ভীত। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থাই আদর্শ জীবনের পথ সুগম করতে সহায়তা করে। তাই বিদ্যালয়ের পরিবেশ যথার্থ হলেই আমরা এক আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবো।

●  সামাজিক পরিবেশ

একটি সুস্থ সামাজিক পরিবেশ পৃথিবীর প্রতিটি সুস্থ ব্যক্তির কাম্য। কারও সামাজিক পরিবেশ যতটা উন্নত হবে সেই পরিবেশে বাসকারী জনগণও ততটাই উন্নত ধরনের চিন্তাধারার অধিকারী হবে। যে সমাজ অর্থনৈতিক দিকে অনগ্রসর এবং অনুন্নত হয় সেখানে  মানব জীবনের উন্নতির ধারাও কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত থাকে।

সামাজিক পরিবেশ

আর এইসব অনুন্নত জনগণকেই কাজে লাগাতে উদ্যত থাকে সমাজবিরোধী মানুষেরা। যারা কুৎসিত মনোভাবাপন্ন হয় তাদের মধ্যে উগ্রতা প্রদান করতে চায় সমাজবিরোধীরা এবং এই উগ্রতার প্রভাবে বিভিন্ন কুকর্মের মধ্য দিয়ে তারা সমাজকে পঙ্গু করে তুলে। তাই সবাই মিলে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর ও তার প্রতিকার, Details about Dengue fever and its remedy in Bengali

মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব, Influence of environment on human life

মানবজাতির জীবনে পরিবেশ দু’ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। একটি হল সামাজিক প্রভাব, আর অন্যটি প্রাকৃতিক প্রভাব।

সামাজিক পরিবেশের ভূমিকা, Role of social environment

মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমাজ জীবনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটি সুস্থ সমাজ তথা সুস্থ পারিবারিক ও নৈতিক পরিবেশ মানুষকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে, পাশাপাশি সমাজ-আদর্শের স্বচ্ছ ধারণা মানবজাতিকে সামাজিকতা বােধে দীক্ষা দেয়। আমাদের সমাজের ক্ষুদ্রতম একক হল এক একটি পরিবার।

যেকোনো শিশুর জন্ম, বৃদ্ধি তথা প্রাথমিক বিকাশ ঘটে নিজের পরিবারিক পরিবেশের মধ্যেই থেকেই। তাই শিশুর মানসিকতা গঠনের ক্ষেত্রে তার পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে শিশুদের প্রাথমিক বিকাশ ক্ষেত্র পরিবার হওয়া সত্বেও তার সামগ্রিক বিকাশ ক্ষেত্র হল বৃহত্তর সমাজ। একটি সুশৃঙ্খল সমাজ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি মানবজাতির উন্নতির পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। কিন্তু বর্তমানের বিকৃত সামাজিক পরিবেশের প্রভাব মানুষের মধ্যে সুদূরপ্রসারী, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে।

মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব

শৈশবকাল থেকেই বই ভর্তি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নার্সারিতে ইঁদুর দৌড় শুরু করে দেয় শিশুরা, এর ফলে তাদের জন্য মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযােগ রাখতে ব্যর্থ হয় অভিভাবকেরা। সময়ের সাথে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এই শিশুরাই একটা সময় মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে পড়ে। আর এসবের পরিণতি হিসেবে তারা কখনও হয়ে পড়ে নেশাগ্রস্ত, কখনবা আত্মহত্যার প্রবণতা উঁকি দেয় তাদের মনে, আবার কখনাে কোনাে অপরাধমূলক কাজকর্মেও লিপ্ত হয়ে পড়ে তারা।

একদিন বিপ্লবের অংশীদার হতে পারতো যে যৌবন, তা আজ স্বার্থের চোরাবালিতে ডুবে থাকছে। মানুষের এই অধঃপতনে দিশাহীন হয়ে পড়ছে বর্তমানের সমাজ। সমাজের মানুষজনের উন্নতির ক্ষেত্রে প্রয়ােজন হল একটি আদর্শ সামাজিক পরিবেশ, যেখানে শিক্ষার সাথে থাকবে জীবনের সহজ সংযােগ, তবেই আমাদের সমাজে সুস্থতা বজায় থাকবে। এসব পাশাপাশি জরুরী রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সামাজিক মূল্যবােধ, তবেই জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা থাকবে। 

শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali

 প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা, Role of natural environment

আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ দু-ভাবে সহায়ক, প্রথমত, জীবনযাপনের সহায়ক শক্তি; দ্বিতীয়ত, পৃথিবীকে মানবজাতির বাসযােগ্য করে তুলতে সাহায্য করে প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু বর্তমানের নগরসভ্যতার আগ্রাসনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এই প্রকৃতিও আজ যেন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সভ্যতার বিকাশ ঘটার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্রমশ নষ্ট হয়ে চলেছে।

সৃষ্টির সূচনাকালে প্রকৃতির সকল উপাদানগুলিতে যে বিশুদ্ধতা ছিল তা আজ আর একইরূপে নেই। নিজের প্রয়োজনে মানুষ নির্বিচারে অরণ্যভূমি ধ্বংস করে গড়ে তুলছেন নগর সভ্যতা, এভাবেই ক্রমশ যন্ত্র সভ্যতার অগ্রগতি হচ্ছে, এছাড়াও আণবিক তথা পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো প্রকৃতির জল, স্থল এবং অন্তরীক্ষকে করে তুলেছে দূষিত, যার প্রভাবে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি অবলুপ্ত হয়ে পড়ছে, আর এইভাবেই জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে, যা প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির সর্বনাশ ডেকে আনছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা

জলস্তর নেমে যাচ্ছে, তাছাড়া দূষণের ব্যাপকতায় বাড়ছে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্ট জাতীয় অসুখের মহামারি। অন্যদিকে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’-এর ফলে মেরুপ্রান্তে বরফও গলে যাচ্ছে। এই দুরবস্থা থেকে আমাদের সভ্যতার গতিমুখকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরজন্য মানবসভ্যতার বিকাশকে বিপর্যয়হীন করে তুলতে হবে, এই বিপর্যয়হীন বিকাশ হল সেইরূপ বিকাশ যা মানবজাতির বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটাতে পারবে এবং পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদাকে মেটানোর ক্ষমতায় কোনো আঘাত করবে না।

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

পরিবেশ দূষণ, Environmental pollution

 পরিবেশ থেকে মানবজাতির বহুল প্রাপ্তি ঘটে, তা কখনও ইতিবাচক, কখনও বা নেতিবাচক। তবে অনেক সময় এই মানবজাতি নিজেই পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে দূষিতও করে, আর সেই দূষণের প্রভাবই আজ সর্বত্র বিরাজমান।

পরিবেশ দূষণ

আজ দূষণের করাল গ্রাসে বায়ু, জল, আকাশ, মাটি, শব্দ সবই পতিত। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও ক্রমাগত লুণ্ঠিত হচ্ছে, যার ফলে সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশও ক্রমাগত দূষিত, যার প্রভাবে দেখা দিচ্ছে নীতিহীনতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সুবিধাবাদ তথা স্বার্থপরতার ছড়াছড়ি। এই সকল সমস্যার ফলস্বরূপ মানুষের সামাজিক সম্পর্কে এসেছে ভাঙনদশা। অন্যদিকে যন্ত্রের ব্যবহারের প্রভাবে দিনের পর দিন মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠছে যন্ত্র-সর্বস্ব, কৃত্রিম তথা আন্তরিকতাবিহীন। তাই মানুষের মনুষ্যত্ববোধও বলতে গেলে আজ ভূলুণ্ঠিত।

উপসংহার, Conclusion 

আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সুস্থ না থাকার অর্থ হল ব্যক্তির অপমৃত্যু তথা জাতির অপমৃত্যু। চারপাশের প্রকৃতি এবং সমাজের সহায়তায় গড়ে ওঠে একজন পূর্ণ মানুষ, যে পরবর্তী সময়ে সভ্যতাকে পরিচালনা করার অধিকার পায়। এই পূর্ণ মানুষই যদি পরিবেশে নিজের ভারসাম্য হারায় তবে সমাজের অগ্রগতিও বাধাপ্রাপ্ত হবে, তাই জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—

“ যদিও পথ আছে, তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে  নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবােধের দ্বীপের মতাে কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানবসাগর। “

আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ

এক কথায় পরিবেশের আনুকূল্যের উপরই মানবজাতির অস্তিত্ব, বিকাশ এবং সফলতা নির্ভর করে আছে। তাই প্রত্যেকেরই পরিবেশকে নির্মল এবং অনুকূল রাখার ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া উচিত।

Recent Posts