বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ তথা তামাম বাঙালিদের মধ্যে গোপাল ভাঁড় একটি বিখ্যাত চরিত্র. ছোটবেলা থেকেই সকলেই কমবেশি পড়েছে গোপাল ভাঁড় এর হাসির ছোট গল্প গুলি. ছোটরা ছাড়াও বড়োরাও এই চটুল কাহিনীগুলি পছন্দ করেন. এখন গোপাল ভাঁড় এর বিভিন্ন অ্যানিমেশন ভিডিও এসে গেলেও ওই গল্পগুলি পড়ার আনন্দ এ আলাদা. সেইজন্যে আমরা সমস্ত দারুন দারুন গোপাল ভাঁড়ের গল্প ( gopal bhar stories ) নিয়ে এসে গেছি.
- গোপাল ভাঁড় এর ব্যাপারে কিছু কথা
- পড়ে নিন গোপাল ভাঁড় এর সবকটি গল্প | Read All Gopal Bhar Stories
- রাম নাম জপলে ভূত ছাড়ে
- রাজবৈদ্য নিয়োগ
- চোখের সমস্যা
- গোপাল, গোপাল
- গোপালের ভাইপো
- গ্রামের মোড়ল
- গোপাল যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
- ঘটি যেনো না ভাঙে
- দক্ষিণ দিকে মুখ
- পায়ে ব্যথা
- বৈরাগী ও গোপাল
- বাঁদরের উৎপাত
- গোপালের জ্যোতিষ চর্চা
- মন্দিরে কুকুর
- গাধাও তামাক খায় না
- মাছি
- বাবা কিন্তু প্রায়শই আসতেন
- গাধা আর তোমার মধ্যে ব্যবধান
- শালগ্রাম কলুষিত
- পশার কি রকম হলো
- প্রতিযোগীতা
- তুমি চুরি করেছ
- ধনী হবার সহজ উপায়
- বিনি পয়সায় মেলা
- বিশুদ্ধ নবগ্রহ সিদ্ধ পঞ্জিকা
- বৃষ দোহন
- গৌরী সেন
- গোপালের পায়ে ফোঁড়া
- সুদ ছাড়তে দিয়ে ব্যবসা কখনো মাটি দেব না
- গোপালের বিয়ে
- গোপালের মেয়ে জামাই
- গঙ্গা পার
- ডবল চাকরির ঝামেলা
- গোপাল ও মিষ্টির দোকান
- গোপাল ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
- আরো অন্যান্য গোপাল ভাঁড় এর গল্প
গোপাল ভাঁড় কে ছিলেন ? Who was Gopal Bhar ?
ভাঁড় বা বিদূষক কথাটির অর্থ হলো যারা তাদের কৌতুকবোধ দ্বারা মানুষ কে আনন্দপ্রদান করেন, এই গোপাল ভাঁড় ছিলেন এরম এ একজন মানুষ.
১৭১০ সালের শেষের দিক থেকে নদীয়া জেলার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এর সভাসদ ছিলেন গোপাল ভাঁড়. তাঁর কৌতুকরসবোধের জন্যে তাঁর সারা দেশব্যাপী খ্যাতি ছিল. তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রসিকতাগুলি মানুষ এর মুখে মুখে গ্রামেগঞ্জে থেকে সারা দেশে বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে যাই.
গোপাল এর গল্প গুলো খুব হাসির এবং চটুল হলেও তাঁর জীবন কিন্তু খুব একটা আনন্দপূর্ণ ছিলনা. গোপাল একটি নিম্ন বর্ণের পরিবার এর ছিলেন, তাঁর বাবা মারা যান ছোটবেলাতেই এবং তাঁর মাকে জোর করে সতীদাহ প্রথাতে মারা হয়. যাইহোক বোরো হয়ে গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভা তে কাজ পেয়ে যান এবং তাঁর পরে তাঁর জীবন বদলে যায়.
গোপাল ভাঁড় এর সাথে নাসীরুদ্দিন, তেনালি রামান ও বীরবল এর তুলনা করা হয় কারণ ওদের মতো তাঁর গল্পগুলিও সংক্ষিপ্ত, আনন্দদায়ক এবং সকলের পড়ার জন্যে.
পড়ুন গোপাল ভাঁড় এর সমস্ত জোকস গল্পগুলি | Read All Gopal Bhar Jokes and Stories
আমরা চেষ্টা করেছি গোপাল ভাঁড় এর ছোটগল্প যতগুলি রয়েছে তা এখানে রাখার, পড়ুন আর ভালো লাগলে শেয়ার করুন.
We have tried to collect and keep all the Funny Bengali Stories of Gopal Bhar at one place. To read those please scroll.
রাম নাম জপলে ভূত ছাড়ে
বেড়াতে বেরিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার গোপালের হাত চেপে ধরে আস্তে আস্তে মোচড়াতে লাগলেন।
গোপাল: আমার হাত নির্দোষ, ওকে রেহাই দিন।
রাজা: জোর করে ছাড়িয়ে নাও।
গোপাল: সেটা বেয়াদবি হবে।
রাজা: উহু, তাহলে হাত ছাড়ব না।
গোপাল তখন যে রোগের যে দাওয়াই বলে রাম নাম জপতে থাকলেন।
রাজা: এতে কি আর কাজ হবে? দাওয়াই কোথায়?
গোপাল: রাম নাম জপাই তো মোক্ষম দাওয়াই।
রাজা: মানে?
গোপাল: পিতামহ, প্রপিতামহের আমল থেকে শুনে আসছি, রাম নাম জপলে ভূত ছাড়ে।
রাজা গোপালের হাত ছেড়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
রাজবৈদ্য নিয়োগ
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে রাজবৈদ্য নিয়োগ দেওয়া হবে। দেশদেশান্তর থেকে চিকিত্সকেরা এলেন যোগ দিতে। গোপালকে রাজা দায়িত্ব দিলেন চিকিত্সক নির্বাচনের। গোপাল খুশিমনে বসলেন তাঁদের মেধা পরীক্ষায়।
—আপনার চিকিত্সালয়ের আশপাশে ভূতের উপদ্রব আছে?
—জি আছে। প্রচুর ভূত। ওদের অত্যাচারে ঠিকমতো চিকিত্সা পর্যন্ত করতে পারি না। দিন দিন ওদের সংখ্যা বাড়ছেই।
এবার দ্বিতীয় চিকিত্সকের পালা।
—আপনার চিকিত্সালয়ের আশপাশে ভূতের উপদ্রব কেমন?
—আশ্চর্য, আপনি জানলেন কীভাবে! ওদের জ্বালায় আমি অস্থির। দিন দিন ওদের সংখ্যা বাড়ছেই।
এভাবে দেখা গেল সবার চিকিত্সালয়ের আশপাশেই ভূতের উপদ্রব আছে। একজনকে শুধু পাওয়া গেল, যাঁর কোনো ভূতসংক্রান্ত ঝামেলা নেই। গোপাল তাঁকে রাজবৈদ্য নিয়োগ দিলেন। পরে দেখা গেল এই চিকিত্সকই সেরা। রাজাও খুশি। একদিন রাজা ধরলেন গোপালকে। গোপাল বললেন, ‘আজ্ঞে মহারাজ, দেখুন, সবার চিকিত্সাকেন্দ্রের আশপাশে ভূতের উপদ্রব শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। এর অর্থ হলো, তাঁদের রোগী মরে আর ভূতের সংখ্যা বাড়ে…আর যাঁকে নিলাম, তাঁর ওখানে কোনো ভূতের উপদ্রব নেই…অর্থাত্ তাঁর রোগীএকজনও মরে না।
অফিস নিয়ে মজার গল্প ও জোকস | Office Jokes in Bengali
চোখের সমস্যা
গোপালের তখন বয়স হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পারে না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, কী গোপাল, গতকাল আসনি কেন?
—আজ্ঞে চোখে সমস্যা হয়েছে। সবকিছু দুটো দেখি। কাল এসেছিলাম। এসে দেখি দুটো দরবার। কোনটায় ঢুকব, ভাবতে ভাবতেই…।
—এ তো তোমার জন্য ভালোই হলো। তুমি বড়লোক হয়ে গেলে। আগে দেখতে তোমার একটা বলদ, এখন দেখবে দুটো বলদ।
—ঠিকই বলেছেন মহারাজ। আগে দেখতাম আপনার দুটো পা, এখন দেখছি চারটা পা…ঠিক আমার বলদের মতোই!
গোপাল, গোপাল
গোপাল ভাঁড় একবার তার ছেলেকে নিয়ে মেলায় বেড়াতে গিয়ে ছেলেকে হারিয়ে ফেলে। ছেলে তখন একটুও না ঘাবড়ে ‘গোপাল, গোপাল’ বলে চেঁচাতে থাকে। ছেলের চিৎকার শুনে গোপাল ছুটে এসে ধমক দেয় ছেলেকে, ‘ছিঃ ছিঃ, আমার নাম ধরে ডাকছিস, বাবা বলে ডাকতে পারিস না?’
ছেলে তখন বলল, ‘হুঁ, বাবা বলে ডাকি আর মেলার সব লোক ছুটে আসুক!’
গোপালের ভাইপো
গোপালের ভাইপো আর তার স্ত্রীর মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হচ্ছে দেখে গোপাল তাদের থামাতে গেল। গোপালকে দেখে তার ভাইপো বলতে লাগল, ‘দেখুন তো কাকা, আমি আগামী বছর একটা দুধেল গাই কিনব আর তাই শুনে আমার বউ বলছে, সে নাকি গাইয়ের দুধ দিয়ে পায়েস বানিয়ে তার বাপের বাড়ির গুষ্টিকে খাওয়াবে•••।’ গোপাল হাত তুলে তাদের থামাল। ‘আস্তে•••’ ভাইপো থামল। এবার গোপাল ভাঁড় খেঁকিয়ে উঠল, ‘বদমাশ, তোর বউয়ের পায়েস তো পরে•••বাড়ির পিছে আমি যে শাক-সবজির বাগান করেছি, সেগুলো যে তোর গরু খাবে, সে খেয়াল আছে?’
গ্রামের মোড়ল
গোপাল একবার গ্রামের মোড়ল হয়েছিল। তো একদিন ভোরবেলায় এক লোক এসে ডাকতে লাগল, ‘গোপাল? গোপাল?’ গোপাল ভাঁড় কোনো উত্তর না দিয়ে শুয়েই রইল। এবার লোকটা চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ‘মোড়ল সাহেব, মোড়ল সাহেব।’ এবারও গোপাল কোনো কথা না বলে মটকা মেরে শুয়ে রইল। গোপালের বউ ছুটে এসে বলল, ‘কী ব্যাপার, লোকটা মোড়ল সাহেব মোড়ল সাহেব বলে চেঁচিয়ে পড়া মাত করছে, তুমি কিছুই বলছ না!’ গোপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আহা, ডাকুক না কিছুক্ষণ, পাড়ার লোকজন জানুক আমি মোড়ল হয়েছি।’
ছাত্র শিক্ষক জোকস | Student Teacher Jokes in Bengali
গোপাল যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
গোপাল যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গোপাল এক গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে বসল। বেশি গরম লাগায় ফতুয়াটা খুলে পাশে রেখে একটু আয়েশ করে বসল। বসে বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, নিজেই জানে না।
ঘুম যখন ভাঙল গোপাল দেখে, তার ফতুয়াটা চুরি হয়ে গেছে। হায় হায়! এখন কী হবে! খালি গায়ে তো আর শ্বশুরবাড়ি ওঠা যায় না। কী আর করা। সে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলতে লাগল, ‘হে ভগবান, রাস্তায় অন্তত ১০টি মুদ্রা যেন কুড়িয়ে পাই, তাহলে পাঁচ মুদ্রায় আমার জন্য একটা ভালো ফতুয়া কিনতে পারি। আর তোমার জন্য পাঁচটি মুদ্রা মন্দিরে দান করতে পারি•••।’ আর কী আশ্চর্য! ভাবতে ভাবতেই দেখে, রাস্তার ধারে কয়েকটি মুদ্রা পড়ে আছে। খুশি হয়ে উঠল গোপাল, গুনে দেখে পাঁচটি মুদ্রা! গোপাল স্বগত বলে উঠল, ‘হে ভগবান, আমাকে তোমার বিশ্বাস হলো না, নিজের ভাগটা আগেই রেখে দিলে?
ঘটি যেনো না ভাঙে
রামবাবুর সাথে গল্প করতে করতে গোপালের খুব তেষ্টা পেয়েছে। সে ওর ভৃত্যকে ডেকে ঠাস ঠাস তিনটে চড় লাগিয়ে দিয়ে বলছে, ‘যা এক ঘটি জল নিয়ে আয় ঘটি যেনো না ভাঙে।’ ব্যাপার দেখে রামবাবু বলছে, ‘গোপাল, ঘটি ভাঙার আগেই ওকে চড় মেরে বসলে যে?’ গোপাল জবাব দিচ্ছে, ‘আরে ভেঙে ফেলার পর মেরে কি আর লাভ আছে? এর চেয়ে আগেই মেরে দিলাম। সাবধান থাকবে।’
দক্ষিণ দিকে মুখ
গোপাল বেয়াই-বেয়াইনের সাথে বেড়াতে গিয়ে এক ঝোপের আড়ালে প্রস্রাব করতে বসেছে। বেয়াই বলছে, ‘গোপাল উত্তর দিকে মুখ করে প্রস্রাব করছো, ওদিকে মুখ করে প্রস্রাব করা শাস্ত্রে মানা আছে।’ আবার বেয়াইন বলছে, ‘দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রস্রাব করাও শাস্ত্রে মানা।’ শুনে গোপাল বলছে, ‘আমরা ছোট মানুষ, বেয়াই যেই মুখ বললেন সেই মুখেও প্রস্রাব করি, আবার বেয়াইন যেই মুখ বললেন সেই মুখেও করি।’
পায়ে ব্যথা
একদিন এক প্রতিবেশী গোপাল ভাঁড়ের কাছে এসে :
‘আমাকে একটা চিঠি লিখে দাও।’
‘আমি চিঠি লিখতে পারবো না, আমার পায়ে ব্যথা।’
প্রতিবেশী আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘চিঠি তো লিখবে হাত দিয়ে, পায়ে ব্যথা তাতে কী হয়েছে?’
‘কারণ আমি অতোদূর হেঁটে যেতে পারবো না।’
‘অতোদূর হাঁটতে পারবে না মানে?’
‘মানে আমার লেখা চিঠি আমি ছাড়া আর কেউ পড়তে পারবে না। আমার হাতের লেখা খুব খারাপ তো। যাকে চিঠি পাঠাবে, তাকে তো আমাকেই পড়ে দিয়ে আসতে হবে, তাই না? পায়ে ব্যথা নিয়ে যাবো কিভাবে?’
বৈরাগী ও গোপাল
একজন বৈরাগী গোপালকে চিনত না। সে গোপালের সামনে এসে বলল, “ঈশ্বরের সেবার জন্য আপনি কিছু চাঁদা দেবেন?”
গোপাল কিছু না বলে বৈরাগীকে একটা টাকা দিল।
টাকাটা পেয়ে বৈরাগী খুশি হয়ে পথ হাঁটতে লাগল। কিছুটা যেতেই গোপাল তাকে ডাকল, “ও বৈরাগী, একবারটি আমার কাছে এসো।”
বৈরাগী খুশিমনে তার কাছে আসলে গোপাল বলল, “তোমার বয়স কত?”
“আঠারো আজ্ঞে।”
“আমার বয়স পঞ্চান্ন।”
“তাতে কি হল?”
“এইমাত্র ঈশ্বরের সেবার জন্য যে একটা টাকা নিয়েছ সেটা ফেরত দাও, কারণ তোমার আগেই আমি স্বর্গে যাব এবং ঈশ্বরের সেবার সুবর্ণ সুযোগ পাব।”
বিদ্যের জাহাজ
গোপালের সাথে এক ভদ্রলোকের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন রামবাবু, ‘বুঝলে গোপাল, ইনি হলেন শ্রী বিদ্যাচরণ মিশ্র। তোমার মতো অকাট মূর্খ নন, রীতিমত যাকে বলে বিদ্যের জাহাজ!’
‘তা জাহাজই যখন ডাঙায় কেনো? সাগরের জলে ভাসিয়ে দিন না!’ গোপালের সরল উত্তর।
বাঁদরের উৎপাত
গোপালকে বলছেন রামবাবু, ‘এখানে বাঁদরের বড্ড উৎপাত। তোমাকে তো দেখতে বেশ বাঁদরের মতোই! ওদের দলে তোমাকে ছেড়ে দিলে কি হবে বলতো? তুমি নিশ্চই কখনো বাঁদর দেখনি?’
‘আজ্ঞে না! আপনার মত বাঁদর আমি আগে আর কক্ষনো দেখিনি!’ গোপালের সোজা-সাপ্টা উত্তর।
গোপালের জ্যোতিষ চর্চা
গোপালের জ্যোতিষ চর্চার খ্যাতি শুনে দূর গ্রাম থেকে হাত দেখাতে এসেছেন এক ভদ্রলোক।
গোপাল খুব ঘটা করে হাত-টাত দেখে বলে, ‘আপনি তো অতি ভাগ্যবান মশাই! হাতে স্পষ্ট দেখছি আপনার দেহাবসান হবে কাশীতে।’
পূণ্যস্থানে মৃত্যু হবে জেনে ভদ্রলোক খুব খুশি মনে ফিরে গেলেন।
কিছুদিন যেতে না যেতেই ভদ্রলোকের ছেলে এসে উপস্থিত। সে তেড়েফুঁড়ে গোপালকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি গননা করে বলেছিলেন বাবার মৃত্যু হবে কাশীতে। কই, উনি তো বাড়িতেই মারা গেলেন?’
গোপাল আমতা আমতা করে বলে, ‘আমি কি তাই বলেছি নাকি? আমি বলতে চেয়েছি উনি কাশতে কাশতে মারা যাবেন। তা সেটা ঠিক বলেছি কি-না? বলুন?’
স্বামী স্ত্রী কে নিয়ে দমফাটা জোকস | Husband WIfe Jokes in Bengali
মন্দিরে কুকুর
মন্দিরে ঢুকতে যাবার সময় পেছন থেকে পন্ডিতের বাঁধা, ‘এ তুমি কী করছো গোপাল! মন্দিরে কুকুর নিয়ে ঢুকছো?’
‘কোথায় কুকুর?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে গোপাল।
‘এই তো তোমার পেছনে!’ একটি কুকুরের দিকে হাত তুলে দেখায় পন্ডিত।
‘এটি আমার কুকুর নয়!’
‘তোমার নয় বললেই হলো?’ রাগ দেখিয়ে বলে পন্ডিত, ‘তোমার পেছন পেছনেই তো যাচ্ছে!’
‘বটে? তা তুমিও তো আমার পেছন পেছন আসছো!’
গাধাও তামাক খায় না
গোপালের তামাক প্রীতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মোটেই পছন্দ করতেন না। একদিন গোপালকে সঙ্গে নিয়ে পালকিতে কোথাও যাচ্ছেন, দেখেন তামাক ক্ষেতে এক গাধা চড়ে বেড়াচ্ছে। সেই গাধা ক্ষেতের আগাছা খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তামাক পাতায় ভুলেও মুখ দিচ্ছে না।
সুযোগ পেয়ে রাজা বলেন, ‘দেখেছো হে গোপাল, একটা গাধাও তামাক খায় না!’
শুনে গোপাল বলে, ‘আজ্ঞে রাজা মশাই, তা যা বলেছেন। কেবল গাধারাই তামাক খায় না।’
মাছি
মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় থরে থরে সাজানো মিষ্টি দেখে গোপালের খুব লোভ হয়েছে। কিন্তু ট্যাকে নেই একটি পয়সাও।
ভেতরে গোপাল ঢুকে দেখে ময়রার ছোট ছেলেটি বসে আছে।
গোপাল শুধায়, ‘কি-রে, তোর বাপ কই?’
‘পেছনে। বিশ্রাম নিচ্ছে।’
‘তোর বাপ আমি আমি খুব বন্ধু বুঝলি? আমার নাম মাছি। ক’টা মিষ্টি খাই? তোর বাপ কিচ্ছু মনে করবে না।’ বলেই গোপাল টপাটপ মিষ্টি মুখে পুরতে শুরু করেছে।
মিষ্টি নিমিষে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলে চেঁচিয়ে বলে বলে, ‘বাবা, মাছি কিন্তু সব মিষ্টি খেয়ে ফেলছে!’
শুনে পেছন থেকে ময়রা বলে, ‘আরে খেতে দে! মাছি আর কট্টুকু খাবে?’
বাবা কিন্তু প্রায়শই আসতেন
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সব সভাসদদের সামনে গোপালকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘বুঝলে গোপাল, আমার সাথে তোমার চেহারার কিন্তু দারুণ মিল! তা বাবার শাসনামলে তোমার মা কি এদিকে আসতেন-টাসতেন নাকি?
’গদগদ হয়ে গোপাল বলে, ‘আজ্ঞে না রাজামশাই! তবে মা না এলেও বাবা কিন্তু প্রায়শই আসতেন!’
গাধা আর তোমার মধ্যে ব্যবধান
রাজা গোপাল ভাঁড় কে প্রশ্ন করল, গাধা আর তোমার মধ্যে ব্যবধান কতটুকু? গোপাল রাজা থেকে নিজের দুরত্ব টা মেপে তারপর জবাব দিল, বেশি না, মাত্র সাড়ে চার হাত ব্যবধান।
শালগ্রাম কলুষিত
একদিন এক পূজারী বামুন শালগ্রাম শিলা কাঁধে নিয়ে যজমান বাড়ি যাচ্ছেন, এমন সময়ে পথের মাঝে তাঁর ভয়ানক মলত্যাগের বেগ হল। অগত্যা সেই শালগ্রাম তিনি পাশে গাছের কাছে রেখেই অন্য এক গাছের আড়ালে বসে পড়লেন।
সেই পূজারী বামুন রাজবাড়িতেও পুজো করতেন। ব্রাক্ষ্মণের ভাগ্য মন্দ ঠিক সেই সময়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যাচ্ছিলেন সেই পথে। রাজা দেখলেন পূজারী ঠাকুর নারায়ন রেখে গাছেন পিছনে বসে মলত্যাগ করছেন। রাজা পূজারী ঠাকুরকে চিনতে পেরেই চলে গেলেন রাজবাড়িতে।
সেই সময় সেই দিয়ে এক প্রতিবেশীও যাচ্ছিল। সে বামুনের কথা রাজাকে বলতে পরদিন পূজারী যখন রাজবাড়িতে পূজা করতে এসেছেন, তখন রাজার আদেশ শুনে তিনি হতবাক। পূজারী শালগ্রাম অপবিত্র করেছেন, এ পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত তিনি যতদিন না করবেন, ততদিন আর রাজবাড়ির বিগ্রহের পূজা করতে তিনি পারবেন না। এমন কি, পূর্বের মত অন্য যজমানদের বড়ি পূজা অচ্চনা করেছেন তিনি- এমন কথা যদি রাজা জানতে পারেন, তাহলে কঠোর দন্ড দেওয়া হবে পূজারীকে।
পূজারী বামুন পূজা না করেই কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেলেন। শালগ্রাম কলুষিত করার প্রায়শ্চিত্ত একট ব্যায় সাধ্যব্যাপার। গরীব বামুন কোথায় পাবেন অত টাকা? টাকা না হলে কি করে হবে। ব্রাক্ষ্মণকে কাঁদতে দেখে সকলেরই দয়া হল তার উপরে, কিন্তু রাজার কাছে তার হয়ে দুকথা বলবার সাহস কারও হলও না। সকলে গোপালের কাছে যেতে বলল, একটা উপায় গোপাল বের করবেই। শেষে ব্রাক্ষ্মণ কেঁদে কেটে ধরলেন গোপালকে। রাজার একান্ত প্রিয়পাত্র ওই গোপাল, রাজাকে যদি কিছু বলতে হয়, তবে গোপালকে দিয়ে বলানোই ভাল। গোপাল ছাড়া বামুনের আর কোনও উপায় নাই।
গোপাল বললে, দুচারদিন ধৈর্য্য ধরে থাকুন ঠাকুর মশাই, সুযোগ না এলে কথা কয়ে লাভ হবে না। আমি এর একটা বিহিত করতে পারব আশা করছি। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যান। আপনার কথা আমার মনে থাকবে। সময় সুযোগ না হলে রাজাকে বলে কিছুই লাভ হবে না। এই বলে গোপাল বামুন ঠাকুরকে বিদায় দিল তখনকার মত।
দুই একদিন পরেই রাজা একদিন ঘোড়ার গাড়িতে বেড়াতে বেরিয়েছেন। গোপালও সঙ্গে আছে। শীতের অপরাহ্ন খানিকটা বৃষ্টিও হয়েছে, গরম শালে সর্বাঙ্গ ঢেকেও তবু রাজ মাঝে মাঝে শীতে কাঁপছেন। এমন সময়ে হঠাৎ গাড়ির ঘোড়াটা মলত্যাগ করলে। অমনি গোপাল হতাশভাবে বলে ফেললে, কি সর্বনাশ।
রাজা অবাক হয়ে বললেন, কি সর্বনাশ।
গোপাল বললে, সর্বনাশ নয়? এই শীতের সন্ধ্যায় এখন স্মান করে মরতে হবে মহারাজাকেও আমাকেও। গরম মলত্যাগ করে আমাদের অশুচি করে দিলে। এখন কি করা যায় ভেবে দেখুন, মহারাজ।
মহারাজ সবিষ্ময়ে বললেন, ঘোড়া মলত্যাগ করেছে, তাতে আমরা আশুচি হবো কেন, আমি ত কিছু বুঝতে পারছি না। গোপাল তখনই উত্তর দিলে, তাহলে ব্রাক্ষ্মণ মলত্যাগ করাতে নারায়ন অশুচি হলেন কেন? ঘোড়াও যেমন বাহন মাত্র, ব্রাক্ষ্মণও তেমনি দেবতার বাহন ছিল মাত্র। তার কি অপরাধ হল বলুন।
রাজা বুদ্ধিমান ব্যক্তি তিনি এভাবে বিচার করে দেখেননি। গোপালের কথা শুনে তিনি অনেক চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, তুমি যা বললে, সেটা ন্যায়শাস্ত্রের হিসাবে সঙ্গত বটে, কিন্তু হিন্দুর ধর্ম সংষ্কার অনুযায়ী সঙ্গত নয়। মানুষে আর পশুতে সব বিষয়েরইপার্থক্য আছে। যাই হোক ব্রাক্ষ্মণ যে বাধ্য হয়েই এ রকম অবস্থায় মলত্যাগ করেছিল, তা আমি বুঝতে পারছি। প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবেই, তবে তার ব্যয় আমি দেবো। তুমি তাকে কালই প্রায়শ্চিত্ত করে আবার যথারীতি পূজা করতে বল। তোমাকে বুদ্ধিতে হারাতে পারব না, তবে নিশ্চয় বামুন ঠাকুর তোমাকে এরজন্য ঘুষ দিয়েছে আমার মনে হচ্ছে।
গোপাল কানে হাত দিয়ে বলে, রাম রাম। এ কথা বলবেন না মহারাজ। ঘুষ কেবল মহারাজের কাছে নিই, তাই বলে গরীব মানুষের কাছে ঘুষ নেব সে মতি যেন কোনদিন না হয় হুজুর। এই বামুন ঠাকুর খুব গরিব কিনা। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
পশার কি রকম হলো
গোপালের বন্ধু গোপালকে জিজ্ঞাসা করে, পশার কি রকম হলো হে? রাজবাড়িতে বেশ কয়েকমাস যাচ্ছ। রোজগার পাতি ভাল হচ্ছে তো?
গোপাল বলল, আশ্চর্য রকম। ছমাসে লক্ষ টাকা রোজগার করেছি।
বন্ধু হকচকিয়ে গেল একেবারে। বলি, বল কি হে? এ যে আশাতীত। লক্ষ টাকা ভাবার বিষয় বটে।
গোপাল বলল, আশাটা অন্যরকম ছিল, স্বীকার করছি। লক্ষ টাকা ব্যাপারটা কি শুনতে চাও? শোন, বন্ধু। প্রথম মাসে মহারাজের কাছে চালাকি করে এক টাকা আদায় করেছিলাম। তারপর এই পাচঁ মাসে শূণ্য পাচিছ। একের পিঠে পাচঁ শূন্য পাচ্ছি। একের পিঠে পাঁচ শূন্য- অর্থাৎ লক্ষ টাকা হলো না? তুমি যদি রোজগার বাড়িয়ে তুলতে চাও আমাকে অনুসরণ করতে পারো।
Huge Collection of Epic Bengali Jokes, Funny Bangla Short Stories
প্রতিযোগীতা
বর্দ্ধমানের রাজসভাতেও এক ভাঁড় ছিল। নাম তার নেপাল। সে সকলের কাছে বলত- গোপালের চাইতে তার বুদ্ধি অনেক বেশি, গোপালকে একবার সামনে পেলে সে তাকে বোকা বানিয়ে দিতে পারে কি না পারে, দেখা যাবে একবার। দৈবক্রমে একসময়ে গোপাল মহারাজের দরবার থেকে বর্দ্ধমান রাজসভায় গিয়ে উপস্থিত।
বর্দ্ধমান রাজ যখন শুনলেন গোপাল এসেছে, তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, তুমি এসেছ, বড় ভাল হয়েছে। আমার ভাঁড়টি সর্বদাই তোমার সঙ্গে প্রতিযোগীতা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে। এবার প্রমাণ হবে- সে বড়, না তুমি বড়। প্রতিযোগীতায় তুমি আমার-ভাঁড়কে হারাকে পারলে আশাতীত পুরষ্কার পাবে। নেপালের সঙ্গে এটে উঠতে পার কিনা দেখি। সে জিতলে সেও পাবে।
গোপাল ঈষৎ হেসে বললে, হুকুম করুন, কি করতে হবে।
রাজা বিচারের ভার দিলেন মহামন্ত্রীর উপর। বিজ্ঞ মহামন্ত্রী গোপাল এবং বর্দ্ধমানের ভাঁড় নেপাল দুজনকে ডেকে বললেন, তোমরা প্রত্যেকেই তিনজন করে লোক সংগ্রহ করবে ও তাদের কাল সকালে রাজসভায় হাজির করবে। ওই তিনজনের ভিতর একজন হবে দরিয়ার এ পারের লোক, একজন ওপারের , আর একজন মাঝ দরিয়ার লোক।
যে আজ্ঞে। বলে গোপাল এবং বর্দ্ধমানের ভাঁড় নেপাল দুজনেই বিদায় নিলে।
নেপাল ভাবল এবার আমি গোপালকে ঠকাবই ঠকাব, সে মুচকি হেসে নাচতে নাচতে বিদায় নিল। নেপাল পরদিন ভোরে নদির ঘাটে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে নদির এপার থেকে একজন, নদির ওপার থেকে একজন এবং মাঝনদীর নৌকার উপরে থেকে একজন লোককে ডেকে আনলে রাজার নাম করে এবং তাদের সভায় এনে হাজির করলে। তিনজন লোকত ভয়ে অস্থির। আমরা কোন দোষ করিনি বাবু, আমাদের কেন রাজসভায় নিয়ে এলেন। আমাদের কি দোষ ধরে নিয়ে এলো?
গোপালও যথাসময়ে রাজসভায় এসে হাজির হলো, তারও সঙ্গে তিনজন লোক, একজন তার ভিতর ভটচাজ ঠাকুর, একজন সন্ন্যাসী, একজন নারী। তাদের নিয়ে সে সভার একপাশে চুপ করে বসে রইল।
বর্দ্ধমানের ভাঁড় রাজা ও মন্ত্রীকে সন্বোধন করে বললে, হুকুমমত আমি এই তিনজন লোককে এনে হাজির করেছি। প্রথম লোকটি ছিল নদীর এপারে, দ্বিতীয় লোকটি ছিল নদীর ওপারে, এই তৃতীয় লোকটি মাঝ নদীতে নৌকার ওপরে ছিল। যদি বিশ্বাস না হয় এদেরকে জিজ্ঞসা করে দেখুন আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যা বলছি ওরাই সে কথা বলবে।
তারপর গোপালকে বলা হল, সে যাদের এনেছে তাদেরকে সামনে উপস্থিত করার জন্য। গোপাল জানাল এদেরকে বহুকষ্টে অনুনয় বিনয় করে রাজসভায় উপস্থিত সে করেছে। কেউই প্রথমে রাজসভায় আসতে চায়নি। বিশেষ করে সন্ন্যাসী ঠাকুর কোনমতেই রাজসভায় আসতে নারাজ গোপালের কথাবর্তায় সন্তুষ্ট হয়ে উনি রাজি হয়েছেন। পরিচয় দেবার জন্যে গোপাল করষোড়ে নিবেদন করলেন, মহান মহারাজ। মহামান্য মহামন্ত্রী এবং সভাসদগণ। এই যে তিনজনকে আমি রাজসভায় নিয়ে এসেছি, এরা কেউ আজ দরিয়া বা নদীর দিকে যান নি। কারণ আমার মনে হয়নি যে সুবিজ্ঞ মহামন্ত্রী দরিয়া বা নদী অর্থে বলতে সামনের গঙ্গানদী বুঝিয়েছেন। আমি অন্তত মহামন্ত্রীর নদি অর্থে এখানে বুঝেছি-ভব নদি। আমার অনুমান অভ্রান্ত মনে করে তাই এপার ওপার ও মধ্যস্থানের এক একটি লোক এনে রাজসভায় বহুকষ্টে হাজির করেছি…. এই যে ভট্চাজ্ ঠাকুর ইনি চাইছেন কি করে দেশে এর পান্ডিত্যের খ্যাতি দিনদিন ছড়িয়ে পড়বে, কি করে বেশ দুপয়সা উপার্জ্জন হবে, কি করে যশে মানে ধনে ইনি দেশও দশের ভিতরে একজন মহামান্য হয়ে উঠতে পারবেন। সম্পূর্ণভাবে ইহকাল নিয়েই ইনি ব্যস্ত আছেন। এক কথায় বলা যায় ইনি এ পারের লোক। এ পারের লোক এ ধরণের ছাড়া আমার অন্য কাউকে মনে হয় না। ….. আর এই যে সন্ন্যাসী ঠাকুর, ইনি ইহকাল নিয়ে মাথা ঘামান না মোটেই। সর্বদাই ভগবানের ধ্যানে-বিভোর কি করে ভগবান দর্শন করবেন সেই নিয়ে তন্ময়, খেতে দিন খাবে খেতে না দিন খাবে না, সুতরাং এদেরকেই বলা যায়, ও পারের লোক। …. আর এই যে, তৃতীয়টি, ও হল এই নগরের একটি বেশ্যা। বেশ্যা হইকালের কথাও ভাবে না, পরকালের কথাও ভাবে না। সে ইহকাল-পরকাল বলতে কিছুই বোঝে না। সে এপারের লোকও নয়, ওপারের লোকও নয়। অর্থাৎ সে মাঝ নদির লোক। এই আমার তিনজন লোকের পরিচয়। মহামন্ত্রীর আদেশমত কাজ করতে পেরেছি কিনা, এইবার সভাতা যাচাই করুন। আমার আর এর বেশি কিছুই বলার নেই। আপনারা সকলেই ভেবে বিচার করে দেখুন। ঠিক হয়েছে কিনা। সেটা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
সভায় ধন্য ধন্য রব উঠল। রাজা মহামন্ত্রী বললেন, গোপালের মত বুদ্ধিমান লোক ভাড়েদের ভেতর দূরের কথা বড় বড় পন্ডিত সমাজে দুর্লভ। নেপালেরও অহঙ্কার সেদিন থেকে দূরে গেল। রাজা এবার গোপালকে প্রচুর পুরষ্কার সহ বিদায় দিলেন। গোপাল শুধু সুরদিক ভাঁড় নয় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মহাপন্ডিতও বটে- দিকে দিকে তার এই গুনের কাহিনী ঘোষিত হল। কৃষ্ণনগরে মহারাজ ও গোপালের এই কাহিনীগুলোর গুনের কদর করতে ভুললেন না। সেদিন থেকে নেপাল গোপালের বন্ধু হয়ে গেল।
তুমি চুরি করেছ
একদিন রাজবাড়ির লোক গোপালকে চুরির দায়ে ফেলার জন্য জোর চেষ্টা করেছিল এবং গোপালকে ধরে এনে, হাকিমের সুমুখে খাড়া করে দিল। হাকিম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি চুরি করেছ?
গোপাল বললে, কেন মিছে কথা বাড়ান। করেছি কিনা সেইটিই তো বিচার করে প্রমাণ করবার ভার আপনার উপরে।
ধনী হবার সহজ উপায়
গোপালের বুদ্ধি প্রখর। একবাক্যে সকলে তা স্বীকার করত। তারজন্য গোপালের সঙ্গে নানান ধরনের লোক প্রায়ই দেখা করতে আসত।
একবার এক ভদ্রলোক এসে গোপালকে জিজ্ঞেস করল গোপাল, তোমার তো এত বুদ্ধি। তোমার বুদ্ধির জোরে আমাকে বিনা পুজিতে ধনী হবার সহজ উপায় বাৎলে দিত পার?
গোপাল হেসে বলেনে, ধনী হবার সহজ উপায় বাতলে দিতে পারি, ফি বার করুন দশ টাকা। আপনিও এরপর এইভাবে দেশবিদেশে, প্রতিবেশীদের কাছে চাউর কেরে দিন যে অল্প অল্প দক্ষিণায় ধনী বানানোর মন্ত্র আপনি জানেন। লোকের ভিড় আপনার কাছে ভেঙ্গে পড়বে। শর্ট-কাটে ধনী কে না হতে চায় বেকুব ছাড়া? আপনি সকলের কাছ থেকে এইভাবে ধনী বাননোর ফরমুলা বাতলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি দশটা করে টাকাও আদায় করতে পারেন তাহলে আপনি বিনা পুজিতে অতি সহজেই ধনী হয়ে যাবেন। ধনী হবার সহজ উপায় আপনি আর পাবেন না। বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করেই দেখুন না, মিথ্যে বলছি কি সত্যি বলছি। এই বলে গোপাল মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
বিনি পয়সায় মেলা
একবার গোপাল আহ্লাদ পুরে বেড়াতে এসেছিল। নতুন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এক অজানা দেবস্থানে উপস্থিত। সেদিন ছিল উৎসব তিথি। সামনে বিরাট আটচালা সাজানো। মধুর বাজনা বাজছে, গানও শোনা যাচ্ছে। পেছনে মন্দির দেখা যাচ্ছে না সামনে থেকে। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকরা প্রবেশ করছেন ভিড় করে দলে দলে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গোপাল তাকিয়ে আছে সেইদিকে। তার বড় ইচ্ছে, সেও একবার ভিতরে গিয়ে দেখে, কি জাতীয় তামাসা ওখানে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলে, এখানকার টিকিটের দাম কত ভাই?
দারোয়ান বললে, সে কি? এখানে তো কোন টিকিট লাগে না! বিনি পয়সায় মেলা দেখা যায়।
গোপাল যেন অকূলে কূল পেয়েছে — এইভাবে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল তাই, বলো। ভেট লাগে না বলেই এত ভিড়। এই বলে গোপালও ঢুকে পড়ল ভিড়ের মাঝে আনন্দের লোভে।
বিশুদ্ধ নবগ্রহ সিদ্ধ পঞ্জিকা
শ্রী গোপাল উবাচ- উদ্ভটচন্দ্র জ্যোতিষ রন্তা শাস্ত্রীজী নববর্ষের যে বিশুদ্ধ নবগ্রহ সিদ্ধ পঞ্জিকা প্রকাশ করেছেন, তার গোড়ার পর্বে দেশগত বর্ষফল এইভাবে গুঞ্জিত-
১. দেশের অবস্থা রকম ফেরে মন্দই যাবে না। কেউ খেতে পাবে কেউ পাবে না, কেউ চাকরিতে বহাল হবে, কেউ আবার বরখাস্তও হতে পারে।
২. গঙ্গার জলে ইলিশ কিছু পড়বে। আগের বারের চেয়ে কম হওয়ারই সম্ভাবনা। তবে কিছু বেশি হলেও অবাক হবার কিছু নেই, কারণ কতকগুলি শুভগ্রহেরও যোগাযোগ আছে। (কালির প্রভাবে পুকুরের ইলিশও স্থানবিশেষে বেশ মিলতে পারে।)
৩. বর্তমান গবুচন্দ্রের গৌরী সেন সরকারই টিকে থাকবেন, যদি না অসাধারণ কোন কোপ গ্রহ সন্নিবেশে আচমকা ওলোট পালোট না হয়ে যায়। আর বর্তমান গবু কানুন বহাল থাকলে হবুচন্দ্রই প্রধান অমাত্য থাকবেন, অবশ্য যদি না তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, বা দলের লোক তাকে ঠেঙ্গিয়ে অন্য কোন সরেস হারাচাঁদ বা পাটোয়ারী লালকে দলপতি বলে মনোনীত না করে!
৪. মাঝে মাঝে যান দুর্ঘটনা হবে, গরুর গাড়ি চাপা বা মানুষ চাপা পড়েও কিছু কিছু লোক মারা যেতে পারে!
বৃষ দোহন
কোনও একবদমাইস লোকের প্ররোচনায় মহারাজ একদিন গোপালকে আদেশ দিলেন, একটা বৃষ দোহন করে, তার দুধ আমায় কাল এনে দাও। গোপাল যত বলে যে, বৃষ দোহন করে দুধ পাওয়া যেতে পারে না, মহারাজ সে কথায় কান দিলেন না মোটেই। অগত্যা গোপালকে বেরুতে হল।
গোপালের মত ধুরন্ধর লোক টো টো করে ঘুরে কোন উপায় না বের করতে পেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবতে থাকে, কি করে এ যাত্রা বাঁচা যায়। গোপাল কোনও বুদ্ধিই মাথায় খাটাতে পারল না।
গোপালের স্ত্রী স্বামীর এই রকম অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বিষ্মিত হয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে। গোপাল বলে, মহারাজ আমাকে বৃষ দোহন করে দুধনিয়ে যেতে আদেশ দিয়েছেন। কি যে করি। কোথায় যাই, কে আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করবে ভেবেই কুলকিনারা কোনও পাচ্ছি না। যদি ষাঁড়ের দুধ দিতে না পারি গর্দান যাবে। নিশ্ছয়ই মহারাজ কারো প্ররোচনায় এমন অসম্ভব কাজ আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন। এখন কি করে রেহাই পাওয়া যাবে ভেবে স্থির করতে পারছি না।
গোপালের স্ত্রী স্বামীকে বললে, তুমি কাল আর বেরিয়োনা। যা করবার আমি করছি। এই সামান্য কাজের জন্য এত চিন্তা। গোপালের স্ত্রী গোপালের চেয়েও সরেস বুদ্ধি ধরে কখনও কখনও। পরদিন খুব ভোরবেলাতেই রাজবাড়ির সম্মূখে নদীর ঘাটে গিয়ে গোপালের স্ত্রী গাদা গাদা কাপড় সশব্দে কাচতে লাগলে।
ওইখানটিতে মহারাজ রোজ সকালে ভ্রমণ করেন। তিনি কাপড় কাচার শব্দ শুনে ভাবলেন এ সময় এখানে কিসের শব্দ? কাছে এসে দেখলেন, এক পরমা লাবণ্যবতী মহিলা ধোপানীর মত কাপড় কাচতে ব্যস্ত। দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ দেখলেন, আকৃতি দেখেই বুঝতে পারলেন এ নারী কোনো বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বংশের মহিলা। তিনি সবিস্ময়ে বললেন, ভদ্রে! এই কঠোর শ্রমের কাজ দাসীতেই করে। আপনি নিজে এই কাজ করছেন কেন? এর কারণ জানতে আমার একান্ত ইচ্ছে করছে, যদি বলেন খুবই আনন্দিত হব।
গোপাল মহিষী বললেন, কি করবো বলুন বাবা দাসীর অসুখ করেছে। অথচ নতুন দাসী খুঁজে আনবার সামর্থ আমার স্বামীর আজ আপাততঃ নেই। কারণ, তিনি প্রসব বেদনায় একান্ত কাতর। কাপড় সিদ্ধ হয়ে গেছে, কাজেই নিজে কাপড় কাচা ছাড়া আর উপায় কি? ঘরে আর কেউ নেই যে কাজটুকু করে দেয়। ২/১ দিন ভেজা কাপড় ফেলে রাখাও যায় না নষ্ট হয়ে যাবে।
মহারাজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, স্বামী প্রসব-বেদনায় কাতর? একি অসম্ভব কথা বলছেন আপনি? পুরুষেরা কি সন্তান প্রসব করতে পারে? এ আমি আপনারমুখে ছাড়া কোথাও কোনওদিন দেখা দুরের কথা শুনিনি।
গোপালের স্ত্রী বললেন, কেন হবে না? যে দেশে বৃষ দোহন করলে দুধ পাওয়া যায় সে দেশে পুরুষের পক্ষে সন্তান প্রসব করা কি এতই অসম্ভব। আজ শুনলাম আমাদের মাননীয় মহারাজ আদেশ দিয়েছেন একজনকে বৃষ দোহন করে দুধ আনতে-
মহারাজ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং অনুমান করলেন ইনি গোপালের স্ত্রী। তখন নিজে গোপালের বাড়ি গিয়ে গোপালকে ডেকে, প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। এবং সুকৌশলে এই ভুল ভাঙানোর জন্য গোপালের স্ত্রীকে বেশ ভালভাবেই পুরষ্কৃত করলেন এবং যার প্ররোচনার তিনি গোপালকে এই কাজের জন্য বিড়ম্বিত করেছিলেন, তাকেও প্রচুর জরিমানা করেন।
গৌরী সেন
গোপাল এক মুদি দোকান থেকে ধারে প্রায়ই মাল নিত, কিন্তু টাকা শোধ করতে চাইত না। লোকটি খুব সরল প্রকৃতির ছিল। গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পেয়ারের লোক বলে দোকানি ও টাকা চাইতে সাহস পেত না যদি রাজ রাগ করেন তাহলে গেছি।
একদিন দোকানির ভীষণ টাকার দরকার, বাড়িতে অসুখ! গোপাল মাল নিতে এলে দোকানি বললে, ধারে তো রোজই মাল নিয়ে যাচ্ছেন, টাকাটা আমার আজ দরকার আছে, দেবেন?
দোকানির কথা শুনে গোপাল মুচকি হেসে বললে, আপনার কাজ মাল দেওয়া-দিয়ে যান, আমার কাজ মাল নেওয়া-টাকা যে দেবার সেই দেবে ভাই!
দোকানি বলল, সেকথা বললে কি চলে দাদা? টাকা কে দেবে তাই বলে মাল নিলে ভাল হয়। আমাকে আর ভাবতে হয় না।
গোপাল তখন মাথা চুলকে বললে, টাকা আবার দেবে কে? টাকা দেবে গৌরী সেন।
গৌরী সেনের নাম দোকানি কখনও শোনেনি, সে তাই বললে তিনি আবার কে? দোকানী মনে করল হয়ত গৌরীসেন মহারাজের কোষাগারের কোনও লোক বা কেউ কেটা।
গোপাল বলল, তাজ্জাব ব্যাপার! সবাই যাকে চেনে, তুমি তাকে চেনো না? মালটা দিয়ে দাও। তো বাপু তারপর যাকে জিজ্ঞাস করবে, সেই তোমায় গৌরী সেনের ঠিকানা বাতলে দেবে। তার কাছে দিয়ে আমার নাম বললেই টাকা সঙ্গে সঙ্গেই পাবে।
দোকানী গৌরী সেনের মত লোকের কথা না জানার জন্য লজ্জা পেল ও ঝটপট যা যা মাল বলল সে মাল দিল।
গোপালের পায়ে ফোঁড়া
গোপালের একবার পায়ে ফোঁড়া হয়েছিল। সেজন্য গোপাল খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে রাজসভায় ঢুকতেই মহারাজ বললেন, গোপাল, কখন যে তুমি পরের বাগানে ঢুকে চুরি করতে দিয়ে ঠ্যাঙ ভাঙলে, আমি মোটেই টের পেলুম না।
গোপাল মুচকি হেসে বললে, হুজুর আপনিও আমার সঙ্গে সেই পেয়ারা বাগানে ঢুকেছিলেন। কিন্তু আপনি গাছে ওঠেননি বলে মোটেই টের পাননি। আপনি তখন তলায় পেয়ারা গুনছিলেন। আপনি অগুনতি পেয়ারা দেখে মশগুল ছিলেন গোনায়-এজন্য আমি যে পড়ে দিয়ে ঠ্যাং ভাঙলুম তা দেখতে পাননি, আপনি টের পেলেরন আজ। হুস থাকলে ত দেখবেন।
সুদ ছাড়তে দিয়ে ব্যবসা কখনো মাটি দেব না
গোপাল ভাঁড় একদা খেয়া নৌকা করে পারে আসছিল। তোড়ে জোয়ার আসার সময় গোপাল খেয়া নৌকা থেকে জলে পড়ে গেল মাঝনদীতে। পড়েই নাকানি চোবানি খেতে লাগল। ভীষণ স্রোত, তাই কেউ তাকে তোলবার জন্যে, জলে ঝাঁপ দিতে সাহস করল না। একখানা ডিঙ্গি আসছিল পাল তুলে, তা থেকে মদন মাঝি, দেখতে পেয়ে লাফ দেয় পড়ে গোপালকে টেনে তুলল তার ডিঙ্গিতে।
আগে চিনতে পারেনি, এখন দেখলে, তার মহাজন গোপাল ভাঁড়কে সে বাঁচিয়েছে। গোপালের কাছে মদন মাঝি কিছু টাকা দেনা করেছিল। আশা হলো, তাহলে দলিলখানা হয়তো গোপাল অমনি অমনি ফেরত দিতে পারে। মদন মাঝি এই আশায়ই মনে মনে ফাঁদছিল।
কিন্তু গোপালের প্রথম কথাতেই সে নিরাশ হলো। গোপাল বলল, তুমি আমায় বাঁচিয়েছো মদন। আমিও দরকার হলে তোমার জন্য প্রাণ দেব। কিন্তু তা বলে সুদ ছাড়তে দিয়ে ব্যবসা কখনো মাটি দেব না।
গোপালের প্রাঞ্জল কথা শুনেই মদন সরকারের প্রাণ জল, তার আশার গুড়েবালি। হায়রে! আসল ছাড় তো দুরস্থান সুদের ঠ্যালাতেই মদনের লবেজান। পরে গোপাল তার দলিল ফেরৎ দিয়েছিল।
গোপালের বিয়ে
গোপালের সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। এক বাদলার দিনে স্ত্রীকে দেখবার জন্যে তার মন ছটফট করে উঠলো। নতুন বৌ তখন পিত্রালয়ে, শ্বশুরবাড়িও প্রায় দুক্রোশের উপর। গোপাল ওই বাদলাতেই দুই ক্রোশ পথ ভেঙ্গে সন্ধ্যা নাগাদ শ্বশুরবাড়ীতে পৌছাল।
জামাইকে পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে খুব ধুমধাম। সেকালে রসিকতার ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রী বাছ বিচার বড় একটা ছিল না। শ্বশুর-জামাই, শাশুড়ী-পুত্রবধুতেই মোটা রসিকতার আদান প্রদান অবাধেই চলতো। বাদলার দিনে হঠাৎ গোপালকে দেখে গোপালের শ্বশুর খুব খুশি হল। তাই সে একটা রসিকতার প্রলোভন সংবরণ করতে পারলে না। সকলের সামনেই জিজ্ঞাসা করলে, আজকের মতন বাদলায় কি ভাল লাগে, বলো দিখে কে বলতো পারো? যেবলবে তাকে ৫০ টাকা পুরষ্কার দেবো।
গোপালের শ্বশুরের অবস্থা বেশ ভালই। গোপাল মুখফোঁড় লোক বলে উঠল আজকের মত বাদলায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বৌয়ের সঙ্গে হাসি আর গল্প করতেই ভালো লাগে। এর চেয়ে আর কি ভাল লাগতে পারে।
ঠিক এই কথাটিই শোনবার প্রত্যাশা করছিল শ্বশুর। কিন্তু সে অমনি বলে উঠল, কথাটা ঠিক, কিন্তু তার চাইতেও ভালো লাগে বেয়াই বাড়ি দিয়ে বেয়ানের সঙ্গে গল্প করতে। বল-বাবাজী তোমার চেয়েও এটা আরও বেশ ভাল নয় কি?
গোপাল অমনি দাঁড়িয়ে চাদর কাঁদে তুললে, বললে, তাই না কি? তা জানলে তো আমি না এসে, বাবাকে পাঠিয়ে দিতাম। তা এখনও রাত বেশি হয়নি, আমি গিয়ে বাবাকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি এসে বেয়ানের সঙ্গে গল্প গুজব আমোগ আহ্লাদ করুন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারব ছুটতে ছুটতে বাড়ি যাব।
শ্বশুরের মুখ ভোতা। দেতো হাসি বের করে বলে। তোমার এখন বৃষ্টির রাতে যেতে হবেনা বাবা। ভিতরে গিয়ে বিশ্রাম কর। গোপাল মুচকি মুচকি হাসতে থাকে, বৌ এর দিকে তাকিয়ে মনের মত কথার জন্য মন বেশ খুশী।
গোপালের মেয়ে জামাই
গোপালের স্ত্রী সব সময় বায়না ধরত–মেয়ে জামাইকে আনবার জন্য। একদিন স্ত্রী জিদ ধরল ওদিকে যাচ্ছে যখন, মেয়ে জামাইকে নিয়ে এসো। সবাই কেমন সাধ আহ্লাদ করে। কিন্তু আমরা এসব করতে পারি না।
স্ত্রীর কথা শুনে গোপাল ভাবল, জামাইরা যত বাড়িতে না আসে ততই ভালো। জামাই আনা মানেই হাতির খরচ। আর বাবাজী একবার এলে হঠাৎ বিদায় হয় না। মুখে বলল, এই তো মেয়ে জামাই ছমাস আগে এসে ঘুরে গেল। এর মধ্যে আবার আসবে কি? এলেই দুমাসের ধাক্কা। আমার এখন অবস্থা খুব খারাপ। টাকা রোজগার ভাল যাচ্ছে না। মেয়ে জামাই এলে সংসারের ধাক্কা সামলাব কি করে? এখন থাক, ২/১ মাস পরে আসবে।
গোপালের স্ত্রী রেগে বলল, তুমি কি হাড় কেপ্পন গো। এমন শ্বশুর যেন কারও না হয়। ভগবানের করুনায় আর মহারাজের কৃপায় তোমার কিসের অভাব? গোপালের স্ত্রীর নানা কথা বলে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলে। তাই বাধ্য হয়ে গোপাল লোক পাঠাল মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে আসার জন্য।
মেয়ে জামাই ঠিক সময়ে এলো। কিন্তু জামাই শ্বশুরবাড়িতে রোজ চব্যচোষ্য লেহ্য পেয় আদরে পেয়ে আর যাওয়ার নামটি করে না একেবারেই। জামাই যেতে চাইলেও গোপালের স্ত্রী ছাড়তে চায় না কিছুতেই। এই তো এলে বাবা। এখনই যাই যাই করছ কেন? দুমাসের আগে তোমাদের কিছুতেই ছাড়ব না এবার। তোমার বাড়িতে কী দরকার যে বাড়ি না গেলে চলবে না, এখন যাওয়া চলবে না।
এদিকে খরচের বহর দেখে গোপাল রোজই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগল। অবশেষে গোপাল ভেবে চিন্তে একটা বেশ মনের মত উপায় আবিষ্কার করে ফেলল মনে মনে। গোপাল একদিন বিকেলবেলা জামাইকে একান্তে ডেকে বলল, বাবাজী, এখানে বড় ছিঁচকে চোরের উৎপাত। ছিঁচকে চোরের জ্বালায় গাছে লেবু রাখা দা। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যের সময় ব্যাটা চোর এসে লেবু তুলে নিয়ে যায়। আমি সাবধান হয়েও চোরকে আজ পর্যন্ত ধরতে পারিনি। যদি বা ধরা যেত- আমি আবার সব সময় বাড়িতে থাকি না কি করে চোর ধরব তুমি সব সময় বাড়িতে থাক দেখ যদি চোর ধরতে পার কিনা। তুমি বাবজী, সন্ধ্যের পর বৈঠকখানা ঘরে বসে-লেবুগাছের দিকে একটু নজর রেখো তো। চোরকে ধরলে একেবারে জাটটে ধরবে। লেবু চোর ব্যাটাকে শায়েস্তা না করলে চলছে না। আজকাল লেবুর যা বাজার। বাজারে লেবু পাওয়াই যায় না। এক একটা লেবুর দাম অনেক।
শ্বশুরের কথা শুনে বলে, আপনি কিছু ভাববেন না বাবা। আমার নজর এড়িয়ে চোর কিছুতেই লেবু চুরি করতে পারবে না। চোর তো সামান্য লেবু চুরি করতে আর মাঝ রাতে আসবে না, সন্ধ্যের ঠিক পরেই আসবে। ব্যাটাকে একদিন না একদিন আমি ঠিক ধরে ফেলবো। লেবু-চুরির কথা এর আগে বলেননি কেন আপনি? আমি প্রায় এক মাস এলাম আপনার বাড়ীতে।
সেদিন সন্ধ্যের সময় গোপাল বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে, চুপি চুপি বললে, যাও তো, লেবু গাছ থেকে চট করে একটা লেবু নিয়ে এসো তো। লেবু এনে আমায় সরবৎ করে দাও। আমাকে এখনি একবার রাজবাড়িতে যেতে হবে, যদি কিছু টাকা পয়সা রোজগার করতে পারি। হাত একেবারে খালি।
সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। ছেলেমেয়েরা বেড়াতে গেছে। কোন লোক না থাকায় গোপালের স্ত্রী অন্ধকারে নিজেই লেবু আনতে গেল। ছেলেমেয়েদের গোপাল কায়দা করেই আগে থেকে বেড়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিল যাতে, জামাই ছাড়া বাড়িতে আর কেউ না থাকে। কেউ উপস্থিত থাকলে কাজ হবে না। জামাই শ্বশুরের কথা মত ওঁৎ পেতে বসে ছিল। যেমনি গোপালের বৌ লেবু পাড়তে ঢুকেছে অমনি জামাই অন্ধকারে চোর ভেবে শ্বাশুড়ীকে জাপ্টে ধরল কষে। এমন জাপ্টে ধরল যে শাশুড়ী কোনও মতে পালিয়ে যেতে পারল না। টানা হ্যাঁচড়া করতে করতে জামাই চেঁচাল আজ তোর লেবু-চুরি করা বের করছি। তুমি ভারি ঘুঘু-না। রোজ রোজ লেবু চুরি করার মজা তোমায় দেখাচ্ছি। তুমি মনে করেছ, কেউ বাড়িতে নেই?
গোপাল এই অবস্থার জন্য তৈরিই ছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি ঘরের হ্যারিকেনটা নিয়ে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল জামাই বাবাজী তখনো শাশুড়ীকে কষে জাপ্টে ধরে রয়েছে। শাশুড়ী প্রাণপণে জামাইয়ের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না দু-জনের মধ্যে ঝাপটা ঝাপটি হচ্ছে। তাই দেখে গোপাল বললে, তাইতো বলি- জামাই আনার এত শখ কেন? এবার বুঝতে বাকি নেই।
এই ঘটনায় শাশুড়ীও যেমন লজ্জা পেল, জামাই ও তেমনি লজ্জা পেল। তারপরদিন জামাই লজ্জায় সেই যে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল-তারপর আর শশুরবাড়ি এল না। গোপালের স্ত্রীও মেয়ে জামাইকে আনার কথা আর মুখ ফুটে গোপালের কাছে কোনওদিন উন্থাপন করতে পারল না। গোপাল সকলের মেয়ে জামাই এলে কেবল মুচকি মুচকি হাসে আর তাকে স্ত্রীকে দেখে।
গঙ্গা পার
একদিন গোপাল ও কয়েকজন লোক গঙ্গা পার হচ্ছিল। সকলের কাছে বেশি মাল থাকায় নৌকাটি প্রায় জলসই হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে কত হয়ে নৌকায় জল ঢুকছিল। লোকও বেশি হয়েছিল মাছও ছিল সেই নৌকায় প্রচুর। তাই দেখে একজন যাত্রী তার বড় মোটটা মাথায় তুলে সোজা হয়ে দাড়াল। গোপাল জিজ্ঞাসা করল সে মাথার ওপর মাল তুলে দাঁড়িয়েছে কেন?
সে বলল–তাহলে নৌকাটি ঢুবে যাবে না। সকলে নৌকা থেকে মোট মাথায় তুলে ধরলে নৌকাটার ওজন কমে যাবে আর জলডুবি থেকে নৌকোর সঙ্গে আমাদের জান আর সম্মান বাঁচবে। আমি কি কম বুদ্ধিমান।
গোপাল লোকটির বুদ্ধির বহর দেখে না হেসে পারল না এই আহম্মক লোকটার কথা শুনে।
ডবল চাকরির ঝামেলা
একদিন এক জরুরী কাজের জন্য রাজা গোপালকে ডেকে পাঠালেন। গোপাল বাড়ি ছিল না সে বাজার করতে গিয়েছিল। বাজার থেকে এসে শুনতে পেল রাজবাড়িতে রাজার হুকুম যে ঠিক সময়ে সভায় হাজির হওয়ার জন্য। রাজা ওদিকে গোপালের দেরি দেখে রেগে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।
গোপাল আসা মাত্রই চড়া গলায় বললেন, আমার হুকুম পেয়ও তুমি আসতে দেরি করো, আমায় তুমি অমান্য করতে শুরু করেছো তাহলে? আমার আর তোমাকে প্রয়োজন নাই।
গোপাল করজোড়ে বললে, সে কি সর্বনাশে কথা প্রভু? আপনাকে অমান্য করবো, আপনার দাসানুদাস হয়ে? ব্যাপার কি জানেন আমি চাকুরি করি দুটো। একটা হল রাজার আর একটা বৌয়ের। বৌয়ের বাজার না করলে রেগে ঢোল, আর তাহলেই রাজার বয়স্যগিরিতে গোল হয়ে যায়। যদি বৌকে আপনি মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দেশ থেকে বার করে দিতে পারেন, দিন মহারাজ! তা হলে ডবল চাকরির ঝামেলা আর ধকল থেকে রেহাই পেয়ে আমি একমনে রাজসেবায় আত্ননিয়োগ করতে পারি। এ ছাড়া আমার কোনও উপায় নেই মহারাজ।
গোপালের কথার ঢং দেখে রাজার রাগ উবে গেল। তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। সভায় আর সকলে মহারাজের হাসিতে যোগ দিতে ভুল করল না।
গোপাল ও মিষ্টির দোকান
একদিন গোপাল ও তার বন্ধু রাস্তা দিয়ে ভিন গাঁয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে দেখতে পেল একটা মিষ্টির দোকানে থালায় থালায় থরে থরে মিষ্টি সাজানো আছে। মিষ্টি দেখেই দুজনের জিভে জল এসে গেল। দুজন পকেট হাতড়িয়ে দেখে মিষ্টি খাবার মত পয়সা পকেটে নেই। কিন্তু মিষ্টি না চেখে চলে যেতে তাদের পা উঠছেনা। তার দুজনেই লোভ সামলাতে পারলে না। সঙ্গে পয়সা না থাকলেও গোপাল ও গোপালের বন্ধু পোশাক পরিচ্ছদের দিক থেকে বেশ পরিপাটিই ছিল। দেখে বেশ বনেদী পয়সাওয়ালা ঘরের মনে হচ্ছিল।
তখন ভর দুপুর। দোকানী ছাড়া আর কেউ ছিল না। গোপাল আর গোপালের বন্ধু আগে থেকে মতলব এটে নিয়ে দোকানে ঢুক পড়ল। দু’জনেই বেশ পেটপুরে যা ইচ্ছে সব রকম মিষ্টিই খেয়ে নিল । জাঁদরেল খদ্দের ভেবে দোকানদার একটু একটু করে কৃতার্থের হাসি হাসে।
দোকানদার যখন দাম চাইলে, তখন গোপাল বললে, আমি দিচ্ছি। কত দাম হয়েছে তোমার? গোপালের বন্ধুটি বললে, না, আমি দিচ্ছি, কত দাম বল। দুজনের মধ্যে দাম দেওয়া নিয়ে দস্তরমতো রেষারেষি শুরু হয়ে গেল। গোপাল দাম দিতে যায়, তার বন্ধুটি বাধা দেয়। বন্ধুটি দাম দিতে এগোয়, গোপাল বাধা দেয়। না তুমি দেবে না, আমি দেব-এই বলে দুজনের মধ্যে কে আগে দেবে এই মনোভাব যেন। দোকানী এই সব দেখে হেসে লুটোপুটি।
পরিশেষে গোপাল দোকানীকে বললে মশায়, আপনার কাঁধের গামছাখানা দিয়ে আপনার চোখ বেধেঁ দিচ্ছি। আপানি চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদের দুজনের মধ্যে যাকে প্রথমে এসে ধরবেন- সেই খাবারের দাম দেবে। বলুন রাজী আছেন? দোকানী গোপালের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল।
গোপাল দোকানীর কাধের গামছাখানা দিয়ে তার চোখ দুটোকে কষে বেধে দিল। তারপর গোপাল আর গোপালের বন্ধু দোকান থেকে তাড়াতাড়ি আরও কিছু মিষ্টি তাদেরই জায়গায় বেধে নিয়ে কেটে পড়ল। দোকানী দুহাতে এদিক ওদিক করে যেতে লাগল।
বেশ কিছুদূর চলে আসার পর গোপালের বন্ধুটি গোপালকে বলল, অনেকদিন পরে বেশ কানামাছি খেললে তো। গোপাল বন্ধুর কথা শুনে মুচকি হেসে বললে আমি আর কানামাছি খেললুম কোথায়? দোকানী ব্যাটা এখনও বোধ হয় খেলছে। তারপর দুজনে হাসতে হাসতে জোরে জোরে পা চালিয়ে পগারপার। যদি পেছনে এসে পড়ে।
গোপাল ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
একদিন ঘোর বর্ষার সময় গোপাল জুতো হাতে পথ চলেছে। এমন সময় পাল্কী চড়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ওই পথে যাচ্ছিলেন। তিনি গোপালকে দেখে পাল্কী থেকে নেমে এলেন। আর গোপালের জুতোর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, কি গোপাল! পরকাল যে হাতে করে চলেছো? কী ব্যাপার তোমার?
গোপাল বললে, আমি তবু হাতে রেখেছি, আপনি যে খেয়ে বসে আছেন।
রাজা কৃত্রিম রোষে বললেন, তুমি আমাকে জুতো খোর বলছো? জান এর শাস্তি কি?
গোপাল কিছুমাত্র ভয় না পেয়ে বললে, আজ্ঞে না হুজুর না বললে কি করে জানব। তুব বলি জোয়ান মানুষ আপনি, পাল্কী ছাড়া চলতে পারেন না। এতেও কি আপনি বলতে চান– আপনি নিজের পরকাল খেয়ে বসেননি বা আমি মিথ্যা বলেছি?
মহারাজ এদিকটা চিন্তা করেন নি। যখন ভুল বুঝতে পারলেন তখন না হেসে পারলেন না যে গোপাল ঠিক কথাই বলেছে।
আরো অন্যান্য গোপাল ভাঁড় এর গল্প
পড়ুন আরো ৫০+ গোপাল ভাঁড়ের মজার গল্প বাংলাতে | More Gopal Bhar Stories in Bengali
গোপালের কৃষ্ণপ্রাপ্তি – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
গোপাল ভাঁড় ও খট্টাঙ্গ পুরাণ – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
গোপাল ভাঁড় ও কৃষ্ণচন্দ্রের বিধবা পিসি – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
গোপাল ভাঁড় এর ন্যায়বিচার – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
পুরস্কারের অংশীদার – গোপাল ভাঁড় এর গল্প
গোপাল ভাঁড় ও ইলিশ মাছ – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
গোপালের ঘরে চুরি – গোপাল ভাঁড় এর হাসির গল্প
চালাক মুদি ও গোপাল ভাঁড় এর গল্প
জমিদার এর মোসায়েব মোতায়েন – গোপাল ভাঁড় এর গল্প
আরো কিছু গোপাল ভার এর দারুন গল্প আমরা আপডেট করবো. এই পোস্ট টিকে সেভ করে রাখুন যাতে যখনই নতুন গল্পগুলো আসবে তখনই আপনারা পড়তে পারবেন. ধন্যবাদ, আপনার দিনটি শুভ হোক.