আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali


সাদা-কালো চলচ্চিত্রের সময়কালের এক অনন্য অভিনেতা ছিলেন রহমান। বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক আবদুর রহমান, রহমান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৮২ সাল অবধি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রে নয়, বরং ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন। রহমান ঢাকা, করাচি ও লাহোর মিলে তিনটি ভাষা, যথা বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা

জন্ম ও শৈশবকাল, Birth and Childhood

রহমানের জন্ম হয় ১৯৩৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রহমানের শৈশব কেটেছে নিজ গ্রামের বাড়িতে।

বিক্রম সারাভাইয়ের জীবনী, Best Biography of Vikram Sarabhai in Bengali

শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন দিক, Education

 আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামের একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেনী অবধি পড়াশুনা করার পর ১৯৪৮ সালে রহমান সেখানকার এক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করা, রোজ বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়া, নয়তো ক্রিকেট খেলার মধ্য দিয়েই বিকেল পার করতেন তিনি।

১৯৫৩ সালে  উক্ত বিদ্যালয় থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন রহমান। এরপর ১৯৫৩ সালে তিনি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। রাজশাহীতে ‘কল্পনা’ ও ‘অলোকা’ ছবিঘর ছিল, সন্ধ্যা হলে তিনি বন্ধুদের সাথে প্রায়ই ছবি দেখার উদ্দেশ্যে ছবিঘরে চলে যেতেন। কিন্তু রহমানের মন টিকলো না রাজশাহীতে । সেখানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়েই তিনি ফিরে চলে এলেন ঢাকায়। এরপর ভর্তি হলেন জগন্নাথ কলেজে এবং সেখান থেকে আই এ পাস করেন। 

শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবনী, Best Biography of Srinivas Ramanujan in Bengali

অভিনয় জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Experiences in Acting

সম্ভ্রান্ত পরিবারের কোনো সদস্য সেই সময়কালে চলচ্চিত্র অভিনয় করবে—এমনত ভাবা একপ্রকার অবান্তর ছিল। বিশেষ করে অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেরা এত দূর অবধি ভাবতেই পারে না। ১৯৫৭ সালে একদিন বাবাকে না বলে রহমান বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং পাড়ি দেন ঢাকায়। অভিনয়ের নেশায় ঢাকায় খুঁজে পেয়ে যান আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু নুর মোহাম্মাদ এহতেশামুল হক ওরফে ক্যাপ্টেন এহতেশামকে।

রহমানের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ১৯৫৮ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তখন তিনি খল চরিত্রে এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তারপর তাঁকে আর থেমে থাকতে হয়নি। তিনি একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে গেছেন। পরবর্তী সময়ে প্রধান চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে উত্তরণ, দর্শন, চান্দা, তালাশ, জোয়ার ভাটা এবং হারানো দিন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

অভিনয় জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা

তিনি চলচ্চিত্রে সর্বাধিক অভিনেত্রী শবনমের বিপরীতে অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে ‘দরশন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের মাধ্যমে ১৯৬৭ সালে পরিচালনায় আসেন তিনি। রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানে কয়েকটি উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চাহাত, দোরাহা ও লগান। এরপরে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন এবং সেখানে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অশোক ঘোষ এর দ্বারা পরিচালিত ‘আমার সংসার’ ছিল রহমানের অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র।

শ্যামল মিত্রের জীবনী, Best biography of eminent singer Shyamal Mitra in Bengali

মালা আর কামালের চরিত্রে অভিনয়, Acting as Mala and Kamal

‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রের মালা আর কামালের চরিত্র সকলের মনেই গেঁথে আছে। তাঁরাই একসময়ের সেরা রোমান্টিক জুটি ছিলেন, যার চর্চা মানুষের মুখে মুখে ছিল। ‘মালা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শবনম আর ‘কামাল’ চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন রহমান। তাঁরা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের তথা উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে একসময়ের শ্রেষ্ঠ জুটি। তখনকার সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল তাদের এই জুটি ।

বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ, Opportunity to act in different language films

১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল রহমানের অভিনীত ‘বাহানা’ ছবি মুক্তি পায়। জহির রায়হান ছবিটি নির্মাণ করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। উক্ত চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে নায়ক রহমান ব্যাপক জয়প্রিয়তা লাভ করেন। এছাড়া তাঁর আগের চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জয়প্রিয় ছিল তৎকালীন সময়ের বিভাজিত দুই পাকিস্তানেই।

রহমান বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নায়ক ছিলেন, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ‘দরশন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে পরিচালনায় আসেন তিনি, যা মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চাহাত’, ‘দোরাহা’ ও ‘লগান’-এ অভিনয় করেন তিনি।

বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ

এরপরে তিনি ঢাকায় ফিরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। নায়ক রহমান সেখানে চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর অভিনয় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘অংশীদার’ চলচ্চিত্রে ১৯৮১ সালে তিনি নিজের দুর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। 

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী, Best biography of renouned author Sanjib Chattopadhyay in Bengali  

দুর্ঘটনার শিকার, Accident victim

সিলেটে যখন মাসুদ চৌধুরীর পরিচালিত ‘প্রীত না জানে রীত’ চলচ্চিত্রের শুটিং চলছিল তখন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় রহমান নিজের একটি পা হারান। উক্ত দুর্ঘটনার পর ছবির পরিচালক রহমানের বদলে নায়ক হিসেবে প্রখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খলিল উল্লাহ খান কে নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নিয়োজিত করেন। এই দুর্ঘটনায় পা হারানোর ফলে রহমানের পেশাগত জীবন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life

অভিনেতা তথা পরিচালক রহমান ১৯৫৯ সালে ইডেন গার্লস কলেজের এক ছাত্রীকে বিয়ে করেন, মেয়েটি ছিল দিনাজপুরের বাসিন্দা, যার নাম কুমকুম। তাদের দাম্পত্য জীবনে রহমান ছিলেন ৫ কন্যার জনক। এর মধ্যে তিনকন্যা ছিলেন আমেরিকা প্রবাসী, এক কন্যা থাকতেন লন্ডনে এবং সর্ব কনিষ্ঠা কন্যা থাকেন ঢাকায়। 

রহমান অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র, Notable feature films

অভিনেতা রহমান বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো :

 উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘দর্শন’, ‘জাহাঁ বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘কঙ্গন, ‘দোস্তি’, ‘নাদান’; 

বাংলায় ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এই তো জীবন’, ‘হারানো দিন’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘দেবদাস’।

রহমান অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনাবসান, Death

নায়ক রহমান মৃত্যুর পূর্বের কয়েক বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যার কারণে চলৎহীন হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি হুইল চেয়ারে নিজের বাড়িতে চলাফেরা করতেন। মাঝে মধ্যে কেউ দেখা করতে এলে অথবা বাড়ির মানুষের কাছে নতুন কোন ছবি নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন।

নিজ দেশ এবং পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল, তবুও কেউ রহমানের দুর্দিনে তাঁর সুচিকিৎসার কথা ভেবে কখনো এগিয়ে আসেনি, এমনকি তাঁর খোঁজ খবরও তেমন কেউ রাখতো না। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই কিংবদন্তি অভিনেতা রহমানের জীবনাবসান ঘটে। তিনি ঢাকায় নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মানুষের মনে চিরকাল তাঁর অভিনীত ও পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো গেঁথে থাকবে, আর এই নির্মাণগুলোর মধ্যে দিয়েই তিনি আমাদের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন।

বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali 

কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনাবসান

পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and Recognition

রহমানের অভিনয় যাত্রা যথেষ্ট সফল ছিল। তিনি বহু চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভালো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বেশ কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার সহ আরো অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :

নিগার পুরস্কার

শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার – দেবদাস (১৯৮২)

উপসংহার, To conclude

সাদা-কালো চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা রহমান পৃথিবী থেকে হয়তো অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কালজয়ী সিনেমাগুলি আজও আমাদের মনে অমর হয়ে আছে। আজও দর্শকরা ওই ছবিগুলো অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখেন। বলতে গেলে রহমান অভিনীত সিনেমাগুলোর আবেদন এখনও আছে। বাংলা সিনেমার চর্চা যতদিন থাকবে ততোদিন রহমানের নামটিও থাকবে উজ্জ্বল হয়ে। তিনি একজন সফল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে সর্বদাই আমাদের মননে থেকে যাবেন।  

বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা রহমান

Frequently Asked Questions:

রহমান কে ছিলেন?

সাদা-কালো চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা ছিলেন রহমান।

রহমানের পুরো নাম কি ?

আবদুর রহমান

রহমানের অভিনীত প্রথম ছবি কোনটি?

‘এ দেশ তোমার আমার’ 

রহমানের অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র কোনটি?

‘আমার সংসার’

রহমানের মৃত্যু কবে হয়?

২০০৫ সালের ১৮ জুলাই

Recent Posts