ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি, যিনি প্রধানত আঙ্কেল ওয়াল্ট নামেই সুপরিচিত, তিনি আমাদের প্রায় সকলের শৈশবকে বিভিন্ন অ্যানিমেটেড সিনেমা দিয়ে রঙিন করে তুলেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার এই বাসিন্দা মূলত পরিচিত ছিলেন নিজের ডিজনি অ্যানিমেটেড সিনেমা এবং থিম পার্ক সৃষ্টির জন্য, যেগুলো দেখে আমরা আমাদের শিশু বয়স কাটিয়ে এসেছি।
ওয়াল্ট ডিজনির প্রাথমিক জীবনকাল, Early life
ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি জন্মগ্রহণ ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর। শিকাগোর ইলিনয়েতে জন্ম হয় তাঁর। ওয়াল্টের বয়স যখন চার বছর ছিল তখন তাঁর বাবা ইলিয়াস এবং মা ফ্লোরা, মিসৌরির মার্সেলিনে অবস্থিত এক খামার বাড়িতে পরিবার সহ স্থানান্তরিত করেন। ওয়াল্ট নিজের তিনজন বড় ভাই, অর্থাৎ হারবার্ট, রেমন্ড এবং রয় এবং ছোট বোন রুথের সাথে ঐ খামারে বসবাস খুব উপভোগ করতেন। সেখানে থাকাকালীন সময় থেকেই ওয়াল্টের মনে অঙ্কন এবং শিল্পের প্রতি ভালবাসা জন্মায়।
দীর্ঘ চার বছর ধরে মার্সেলিনে থাকার পর, তিনি কানসাস শহরে চলে যান। ওয়াল্ট রোজ অঙ্কন অনুশীলন করতে থাকেন এবং সপ্তাহান্তে আর্ট ক্লাসে যেতেন। অন্যদিকে তিনি স্থানীয় নাপিতের কাছে বিনামূল্যে চুল কাটার জন্য তার কাছে নিজের আঁকা ছবিগুলো বিক্রির ব্যবসা করতেন। একসময় ওয়াল্ট একটি ট্রেনে হকারের কাজও করেন। তিনি ট্রেনে লোকজনের পেছনে হেঁটে খাবার ও খবরের কাগজ বিক্রি করতেন। তবে ওয়াল্ট ট্রেনে এসব কাজ করা খুব উপভোগ করতেন এবং একসময় মনে করেছিলেন যে সারা জীবন ট্রেনে এসব করেই মুগ্ধ হয়ে থাকবেন।
মোহাম্মদ রফির সেরা জীবনী, The Best biography of Mohammad Rafi in Bengali
শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা, Education
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ওয়াল্ট যখন হাই স্কুলে ভর্তি হন, তখন তাদের পরিবার আবার শিকাগো শহরে ফিরে আসে। ওয়াল্ট তখন শিকাগোর এক আর্ট ইনস্টিটিউটে ক্লাস করতে শুরু করেন এবং নিজের স্কুলের সংবাদপত্রের জন্য ছবি আঁকতেন। পরবর্তীতে ওয়াল্টের বয়স যখন ষোল বছর হয়, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার, কিন্তু যেহেতু তখনও তাঁর বয়স সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য খুব ছোট ছিল, তাই তিনি স্কুল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং রেড ক্রসে যোগদান করেন৷ পরের বছরটা তিনি ফ্রান্সে গিয়ে রেড ক্রসের জন্য অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে কাটিয়েছিলেন।
শিল্পী হিসাবে কাজ, Work as an artist
ওয়াল্ট ডিজনি বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে শিল্পী হিসাবে নিজের কর্মজীবন শুরু করার জন্য প্রস্তুত হন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি নিজের এক আর্ট স্টুডিও শুরু করেন এবং পরে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার সাথে যুক্ত হন এবং সেখানে কাজ করেছিলেন। শিল্পী হিসাবে নিজের জ্ঞানের পরিধি বড় করার জন্য তিনি শিল্পী Ubbe Iwerks নামক আমেরিকার একজন আয়নিমেটরের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে অ্যানিমেশন সম্পর্কে বিভিন্ন কিছু জানার চেষ্টা করেন।
বিক্রম সারাভাইয়ের জীবনী, Best Biography of Vikram Sarabhai in Bengali
অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করার প্রারম্ভিক দিক, Getting started with animation
ওয়াল্ট একসময় তাঁর নিজস্ব অ্যানিমেশন কার্টুন তৈরি করার কথা চিন্তা করেন। তাই তিনি লাফ-ও-গ্রাম নামে নিজের এক কোম্পানি শুরু করে দেন। এক্ষেত্রে তিনি Ubbe Iwerks সহ নিজের আরো কয়েকজন বন্ধুকে এইসব কাজের জন্য নিয়োগ করেন। সকলে মিলে ছোট অ্যানিমেটেড কার্টুন তৈরি করেন। যদিও পরবর্তীতে কার্টুনগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তাও এই ব্যবসাটি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয় নি এবং ওয়াল্টকে এরজন্য দেউলিয়া হতে হয়।
তবে এই একটি ব্যর্থতা তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে, তিনি হলিউডের উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসেন। সেখানে নিজের ভাই রায়ের সাথে একটি নতুন স্টুডিও শুরু করেন যার নাম দেন ডিজনি ব্রাদার্স স্টুডিও। সেখানে তিনি আবারও বন্ধু Ubbe Iwerks কে এবং অন্যান্য কিছু অ্যানিমেটর নিয়োগ করেন। সকলে মিলে এক জনপ্রিয় চরিত্র অসওয়াল্ড দ্য লাকি রেবিট তৈরি করেন। এই ব্যবসা যথেষ্ট সফল হয়েছিল। কিন্তু ইউনিভার্সাল স্টুডিওস তখন অসওয়াল্ড ট্রেডমার্কের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে নেওয়ায় আইওয়ার্কস বাদে ডিজনির সকল অ্যানিমেটরকে দখল করে নেয়।
তাই ওয়াল্টকে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল। তখন তিনি একটি নতুন চরিত্র তৈরি করেন যার নাম রাখা হয় মিকি মাউস। তখনকার সময়ে তিনিই প্রথম শব্দযুক্ত অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরি করেছিলেন, যার নাম স্টিমবোট উইলি এবং এর মধ্যে অভিনয় করেছিল মিকি এবং মিনি মাউস। এই ফিল্মে অর্থাৎ স্টিমবোট উইলির জন্য ওয়াল্ট নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন। উক্ত ছবিটি দারুণভাবে সফল হয়েছিল এবং প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে।
এরপর ওয়াল্ট ডোনাল্ড ডাক, গুফি এবং প্লুটোর মতো নতুন চরিত্র তৈরি করে নিজের কাজ চালিয়ে যান। এছাড়াও কার্টুন সিলি সিম্ফোনি এবং ফ্লাওয়ারস অ্যান্ড ট্রিস নামক প্রথম রঙিন অ্যানিমেটেড ফিল্ম প্রকাশের মাধ্যমে তিনি অনেক সাফল্য অর্জন করেন।
শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবনী, Best Biography of Srinivas Ramanujan in Bengali
‘স্নো হোয়াইট’ এর সৃষ্টি, The creation of ‘Snow White’
ওয়াল্ট ডিজনি ১৯৩২ সালে, সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি স্নো হোয়াইট নামে এক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র তৈরি করবেন, তবে এত লম্বা সময়ের কার্টুন ছবি বানানোর সিদ্ধান্তের জন্য মানুষ ভেবেছিল যে সে হয়তো পাগল হয়ে গেছে। অনেকে এই ছবিটিকে “ডিজনির মূর্খতা” বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে, ওয়াল্ট নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর এই ছবিটি অবশ্যই সফল হবে।
ছবিটির কাজ সম্পূর্ণ করতে তাদের পাঁচ বছর সময় লেগে গিয়েছিল যা ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটিকে দর্শকেরা খুব পছন্দ করেছিলেন এবং বক্স অফিসে এটি ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছিল, পরে ১৯৮৩ সালের দিকে এটি ওই সালের শীর্ষ চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।
মুভি স্টুডিও এবং টেলিভিশনে অংশগ্রহণ, Participation in movie studios and television
স্নো হোয়াইট এর সাফল্য থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করে ওয়াল্ট ডিজনি একটি মুভি স্টুডিও তৈরি করেন। এরপর তিনি পিনোকিও, ফ্যান্টাসিয়া, বাম্বি, ডাম্বো অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এবং পিটার প্যান সহ অন্যান্য আরও বেশ কয়েকটি অ্যানিমেটেড ছবি তৈরি করেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে ওয়াল্ট ডিজনির চলচ্চিত্র নির্মাণ ধীর হয়ে যায়, এর মূল কারণ হল এই যে তিনি মার্কিন সরকারের জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রচারমূলক চলচ্চিত্রগুলোতে কাজ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে তিনি অ্যানিমেটেড ফিল্ম ছাড়াও লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম তৈরি করেন। ট্রেজার আইল্যান্ড ছিল তাঁর তৈরি প্রথম লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম।
বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali
সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and Recognition
ওয়াল্টের তৈরি ‘ফুল এবং গাছ’ শ্রোতাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং ১৯৩২ সালে এটি সেরা সংক্ষিপ্ত বিষয়ের কার্টুন হিসেবে উদ্বোধনী একাডেমি পুরস্কার জয় করেছিল। এছাড়াও তিনি সেই বিভাগে অন্য আরেকটি চলচ্চিত্রের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন, যার নাম মিকি’স অরফানস, তাছাড়া মিকি মাউস তৈরির জন্যও তিনি সম্মানসূচক পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
ওয়াল্ট ১৯৩৩ সালে, দ্য থ্রি লিটল পিগস নামের একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন, যাকে “সর্বকালের সবচেয়ে সফল সংক্ষিপ্ত অ্যানিমেশন” হিসাবে বর্ণনা করেছেন মিডিয়া ইতিহাসবিদ অ্যাড্রিয়ান ড্যাঙ্কস। তাছাড়া উক্ত চলচ্চিত্রটি সংক্ষিপ্ত বিষয়ক কার্টুন বিভাগে আরেকটি একাডেমি পুরস্কার জয় করে।
ডিজনিল্যান্ড, Disneyland
ওয়াল্ট ডিজনির ধারণা ছিল যে তাঁর চলচ্চিত্রের উপর ভিত্তি করে বিনোদন সহ একটি থিম পার্ক তৈরি করা উচিত। এই ধারণা বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৫৫ সালে ডিজনিল্যান্ড খোলা হয়েছিল, যা তৈরি করতে গিয়ে $17 মিলিয়ন ব্যয় হয়ে যায়। তবে এই পার্কটি ছিল এক বিশাল সাফল্য স্বরূপ এবং এটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অবকাশ স্থলের মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য হয়। ওয়াল্ট পরবর্তী সময়ে ‘ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড’ নামে ফ্লোরিডায় আরো একটি বড় পার্ক তৈরি করার চিন্তা করেন এবং তিনি এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও করে নিয়েছিলেন, তবে তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭১ সালে পার্কটি চালু করা হয়।
মৃত্যু, Death
ওয়াল্ট ডিজনি ১৯৬৬ সালের ১৫ই ডিসেম্বর, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুসফুসের ক্যান্সার ছিল তাঁর, দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যান তিনি।
- ওপেনহেইমার এর জীবনী ও বিখ্যাত উক্তি সমূহ, Best Biography and quotes of Robert J Oppenheimer in Bengali
- ওয়াল্ট ডিজনির জীবনী, The Best Biography of Walt Disney in Bengali
- আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali
- মৃণাল সেনের জীবনী, Best Biography of Mrinal Sen in Bengali
- টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী, Best Biography of Thomas Alva Edison in Bengali
উপসংহার, To conclude
ওয়াল্ট ডিজনি বহু শিশু তথা কিশোর কিশোরীদের মনোরঞ্জনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। বলতে গেলে তাঁর তৈরি অ্যানিমেশন দেখার জন্য শিশুগণ উৎসুক হয়ে থাকতো, আজও এমন ঔৎসুক্য কিছুটা হলেও দেখা যায়। আজও তাঁর সিনেমা এবং থিম পার্ক প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ উপভোগ করছেন। অন্যদিকে তাঁর কোম্পানি প্রত্যেক বছর বেশ কিছু বিস্ময়কর সিনেমা এবং বিনোদনমূলক চরিত্র তৈরি করে চলেছে।
Frequently Asked Questions:
ওয়াল্ট ডিজনি কে?
ডিজনি অ্যানিমেটেড সিনেমা এবং থিম পার্কের উদ্যোক্তা।
ওয়াল্ট ডিজনির জন্ম কবে হয়?
১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর।
ওয়াল্ট ডিজনির মৃত্যু কবে হয়?
১৯৬৬ সালের ১৫ই ডিসেম্বর।
ওয়াল্ট ডিজনির সৃষ্ট জনপ্রিয় অ্যানিমেশন কোনগুলো?
মিকি মাউস, স্নো হোয়াইট ইত্যাদি।