পশ্চিম বাংলার একজন প্রখ্যাত গায়ক হিসেবে খ্যাত শ্যামল মিত্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট সুরকার তথা সঙ্গীত শিল্পী। তিনি পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের সময়কালের জনপ্রিয় গায়কদের অন্যতম। তাঁর বহু গান আজও বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যে আদৃত। শ্যামল মিত্রের সুরযোজনা করা সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হল ‘আনন্দ আশ্রম’ এবং ‘অমানুষ’।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা, Birth and Upbringing
শ্যামল মিত্রের জন্ম হয়েছিল ১৯২৯ সালের ১৪ ই জানুয়ারি। ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে তাদের পত্রিক নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়াখালার নিকটে অবস্থিত পাতুল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সাধনকুমার মিত্র, যিনি নৈহাটির একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন।
পিতার ইচ্ছে ছিল ছেলেও যেন তাঁর মতো একজন চিকিৎসক হোক। কিন্তু শৈশবকাল থেকেই শ্যামল মিত্রের গানের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। মা প্রতিভাময়ী এবং স্থানীয় গায়ক মৃণালকান্তি ঘোষের অনুপ্রেরণা পেয়ে সঙ্গীতের দিকেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি, তাই অবাধে সঙ্গীত শিক্ষাও চলতে থাকে তাঁর। পিতার কাছে প্রায়ই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্যরা আসতেন, সেই সূত্রে তরুণ শ্যামল মিত্রের পরিচয় ঘটে সলিল চৌধুরীর সাথে। এইভাবেই তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ দ্বারা আয়োজিত এক পথসভায় প্রথমবার গেয়েছিলেন ‘ও আলোর পথযাত্রী’।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী, Best biography of renouned author Sanjib Chattopadhyay in Bengali
শিক্ষাজীবন, Education
শ্যামল মিত্র প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন স্থানীয় একটি স্কুল থেকে। পরবর্তীতে হুগলি মহসিন কলেজ থেকে আই.এ পড়াশুনা করেন, অতঃপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
সঙ্গীত শিক্ষা, Music education
শ্যামল মিত্রের সঙ্গীত শিক্ষা গুরু ছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। পরে তিনি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছেও তালিম নিয়েছিলেন। তবে সঙ্গীত শিক্ষাগুরু হিসেবে সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রভাব তাঁর জীবনে অনেক বেশি ছিল। তিনি গুরুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং শ্যামল মিত্রের মনে গুরুর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল। গুরুর মৃত্যুর পর তিনি মানসিক ভাবে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন, ফলস্বরূপ সুধীরলাল চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটি গানও রচনা করেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali
সঙ্গীত জীবনের শুরু, Starting of Singing career
শ্যামল মিত্রের পিতা খুব রাশভারী ডাক্তার ছিলেন, চেয়েছিলেন ছেলেকেও ডাক্তার বানাবেন, কিন্তু ছেলের চোখে গায়ক হওয়ার স্বপ্ন প্রজ্বলিত। একদিন রেগে গিয়ে পিতা শ্যামল মিত্রকে বলেছিলেন ‘‘গান গাইতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।’’
তাই শ্যামল মিত্রও বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানকার এক মেসে থেকে বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশুনা করেন, পাশাপাশি সুধীরলাল চক্রবর্তী’র কাছে সঙ্গীত শিক্ষাও চালিয়ে যান। তাঁর জীবনের এই অংশটাকে তুলে ধরা হয়েছিল ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে শ্যামল মিত্র সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে প্রথম গান রেকর্ড করেন।
১৯৪৮ সালে প্রথম প্লে ব্যাক গায়ক হিসেবে ‘সুনন্দার বিয়ে’ সিনেমাতে সাড়া ফেলেন তিনি। এরপর বেশ কিছু ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছিলেন, এমনকি হিন্দি চলচ্চিত্রেও বেশ কয়েকটি গানের সুরও তাঁর দেওয়া। ১৯৫২ সালে সুধীরলাল চক্রবর্তীর মৃত্যু হওয়ার পর শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ গানটি তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, Best biography of Manik Bandopadhyay in Bengali
সঙ্গীতকার তথা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সুখ্যাতি, Fame as a musician
শ্যামল মিত্র সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আনুমানিক শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হল :
● যমালয়ে জীবন্ত মানুষ,
● লাস,
● দেয়া-নেয়া,
● ভানু গােয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট,
● বনপলাশীর পদাবলী,
● অমানুষ,
● আনন্দ আশ্রম,
● ধনরাজ তামাং,
● কলঙ্কিনী,
● কেনারাম-বেচারাম প্রভৃতি ।
তিনি হিন্দি, বাংলা, অসমীয়া এবং ওড়িয়া ছবিতেও গান গেয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া
● ‘ভুবন ভরিয়ে দেবে’,
● ‘আমি তােমার কাছেই ফিরে আসব’,
● ‘তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন,
● ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’
ইত্যাদি গানগুলো বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে আছে।
সলিল চৌধুরীর জীবনী, Best Biography of Salil Chowdhury in Bengali
উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটি, Shyamal Mitra and Uttam Kumar pairing
তখনকার সময়ে উত্তম কুমারের খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। সেই সুবাদে ‘উত্তম কুমারের লিপে’ গান না গাইতে পারলে চলচ্চিত্র জগতের কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছানো যাবেনা বলে মনে করা হত। কিন্তু উত্তম কুমারের নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তখন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জয়জয়কার ছিল। কিন্তু ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমাটি নিয়ে উত্তম-হেমন্ত জুটিতে ফাটল ধরে।
সেই ছবির প্রযোজনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমার কে রাখার কথা থাকলেও নায়ক সঠিকভাবে ডেট দিতে পারছেন না বলে বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর জায়গায় নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই উত্তমকুমার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জুটির মধ্যে ফাটল তৈরি হয়। এর ফল স্বরূপ উত্তম কুমারের নেপথ্যে চলে আসে শ্যামল মিত্রের কন্ঠ।
সেই থেকে উত্তম এবং শ্যামল মিত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সিনেমায় দুই বন্ধুর আকর্ষণীয় যুগলবন্দী দেখা যেতে লাগলো। ১৯৬২ সাল থেকে আনুমানিক ১৯৭২ সাল অবধি সিনেমায় উত্তম কুমারের জন্য বহু গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র।
শিল্পীর উল্লেখযোগ্য গান সমূহ, Notable songs of the artist
শ্যামল মিত্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত সুরকার সুবল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, রবিন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সুরকারদের সুরে বহু গান গেয়েছেন। তাঁর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার হবে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গান হল :
● আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে
● ওই আঁকা বাঁকা যে পথ
● কেন তুমি ফিরে এলে
● দূর নয় বেশি দূর ওই
● ধরো কোন এক শ্বেত পাথরের প্রাসাদে
● নাম রেখেছি বনলতা
● রাজার পঙ্খী উইড়্যা গেলে
● কি নামে ডেকে
● শুভ্র শঙ্খ রবে (মহালয়া)
প্ৰখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মান্না দে -র জীবনী, Best Biography of Manna Dey in Bengali
সঙ্গীতশিল্পীর দাম্পত্য জীবন, Married life
শ্যামল মিত্র বিবাহ করেছিলেন প্রতিমা মিত্রকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে বিয়ের আগে স্ত্রী নাকি তাঁকে মামা বলে সম্বোধন করতেন, কারণ শ্যামল মিত্র ছিলেন স্ত্রী প্রতিমার মামার বন্ধু। কলকাতার যে মেসে তিনি থাকতেন এর উল্টোদিকে ছিল স্ত্রীর পিসির বাড়ি, যেখানে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে এই দম্পতির ঘরে এক সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয় সৈকত মিত্র।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এর সঙ্গে শ্যামল মিত্রের সখ্যতা, Shyamal Mitra’s relationship with Gouriprasanna Majumdar
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও শ্যামল মিত্রের সম্পর্ক যেন ছিল সোনায় বাঁধানো। গান তৈরি করতে বসে দু’জনে মিলে কত যে ম্যাজিক করতেন! ‘‘ঝিরি ঝিরি বাতাস কাঁদে’’ এবং ‘‘তোমার ওই ধূপছায়া রং শাড়ির পাড়ে’’ – গান দু’টো তৈরি করতে দুজনের একসাথে মাত্র কুড়ি মিনিট লেগেছিল।
কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, Best Biography of Bibhutibhushan Bandyopadhyay in Bengali
ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন এই শিল্পী, Shyamal Mitra met with an accident
১৯৬৯ সালের একদিন গাড়ি করে বাইরে বেরিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। তখনই ঘটে যায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। গুরুতরভাবে জখম হন তিনি, এই অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে, একটু সুস্থ হলে বাড়িতেই কাটতে লাগল শিল্পীর জীবন। ভক্তদের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে, আর কি গান গাইতে পারবেন না শ্যামল মিত্র!
কিন্তু সেই সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরলেন গায়ক। ফিরে এসেই ভক্তদের উদ্দেশ্যে গাইলেন একটি বিশেষ গান, যা শুনে উদ্বেলিত হলেন তাঁর ভক্তরা। সুখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘তোমাদের ভালোবাসা ফিরায়ে এনেছে মোরে মরণের পার থেকে’ গানটিও এইভাবেই হিট হয়ে গেল।
সংগীতশিল্পীর জীবনাবসান, Shyamal Mitra’s Death
বিশিষ্ট এই সুরের জাদুকরের মৃত্যু হয় ১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর।
- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী সমূহ | Swami Vivekananda biography and Quotes in Bangla
- হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী ~ Biography of Humayun Ahmed in Bengali
- বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay
উপসংহার, Conclusion
আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী ছিলেন শ্যামল মিত্র, সুরকার এবং প্রযােজক হিসেবেও তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শ্রোতাদের বহু শ্রুতি মধুর গান উপহার দেওয়ার পাশাপাশি অভিনয়ের দক্ষতার ঝলকও প্রকাশ করেছেন দর্শকদের সম্মুখে। তার বহু গান আজও আমরা শুনতে পছন্দ করি। সুর হোক কিংবা কণ্ঠ, প্রেমের গানের ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নিজের রোমান্টিক কণ্ঠে গাওয়া গানগুলোর মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের মধ্যে অমর হয়ে আছেন।
FAQ
আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সংগীতশিল্পী, সুরকার এবং প্রযােজক।
১৯২৯ সালের ১৪ ই জানুয়ারি।
প্রতিমা মিত্র।
১৯৮৭ সালে ১৫ নভেম্বর।