জাতীয় সংহতি, Best composition on National Integration in Bengali



ভূমিকা, Introduction

ভারতীয় ভূ-খণ্ডে ভিন্ন জাতির মানুষের বসবাস হলেও, ভারতীয় জাতি হল এক ঐক্যবদ্ধ বৈচিত্র্যময় জাতি, কারণ ভারতীয় জাতির মূলমন্ত্র হল বিভেদ দূরে করা এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধন করা, এর মাধ্যমেই একটি সংঘবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা। তাদের এই ঐক্য এবং অখণ্ডতাই হল জাতীয় সংহতির প্রধান বুনিয়াদ। জাতীয় সংহতি হল যেকোনো জাতির উন্নতির মূলকথা।

কোনো দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতাদর্শ নির্বিশেষে নির্দিষ্ট একটি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, একটিমাত্র সূত্রে যদি গ্রথিত হয়ে পড়ে সহস্র কোটি মন, তবেই আসবে জাতীয় সংহতি। জাতীয় সংহতির প্রভাবে তখন হৃদয় মেলে সকল বিভেদ ভুলে সবাই হাতেহাত ধরে চলবে। রচিত হবে এক মহামিলনের মানব শৃঙ্খল। এক ভারতের চিন্তায় আন্তরিক কবি নিজের অকৃত্রিম আবেগ এবং আশায় গেয়েছিলেন –

জাতীয় সংহতি

” আমরা যে যেখানেই থাকিনা কেন, আমরা যা-ই মত পোষণ করিনা কেন, যে ভাষাতেই কথা বলিনা কেন, আমাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত বাঁধনে আমরা এক হয়ে আছি। এই বাঁধনের নাম জাতীয় সংহতি। “

জাতীয় সংহতি বলতে কি বোঝায়? What is meant by National Integration?

জাতীয় সংহতি কি? ছাত্রজীবন থেকেই এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়েছেন এখনও অনেক সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। 

” নানা ভাষা নানা মত ও নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান। “

এই ভাষা, মত এবং পরিধানের মধ্যে ভিন্নতা সংক্রান্ত বাধা থাকা সত্ত্বেও দেশের সকল অধিবাসীদের মধ্যে মিলনের এবং ঐক্যবোধের চেতনার যদি বিকাশ ঘটে তবেই জাতীয় সংহতিরও বিকাশ ঘটবে। দেশের অর্থাৎ জাতির জনগণের মধ্যে থাকা আন্তরিক ঐক্যচেতনা বা ঐক্যানুভূতিই হল জাতীয় সংহতি। 

জাতীয় সংহতি বলতে কি বোঝায়?

কোনোও জাতির জনগন যখন জাতিভেদ সম্পর্কিত সীমারেখা, ভৌগোলিক সীমানা, সাম্প্রদায়িকতার সীমানা, অর্থ সংহতি সংক্রান্ত সীমা, ভিন্ন বিশ্বাস এবং সংস্কারের সীমানাকে উপেক্ষা করে যায় এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধের চেতনা জাগিয়ে তোলে, তখন সহস্র জীবন এক সূত্রে গ্রথিত হয়, এইভাবেই জাতীয় সংহতির ছবি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

জাতীয় সংহতিকে সুদৃঢ় এবং সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাবিদরা শিক্ষাকেই প্রধান হাতিয়ার রূপে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali

সংহতির মুখে বাধা, Obstacles in the face of Integration

 জাতীয় সংহতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মূল বিষয় হল : 

●  জনগণের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ এবং সাম্প্রদায়িকতা।

● অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা এবং বর্ণ-বৈষম্য। 

● দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু ভাষা ব্যবহৃত হয়, সকল ভাষাগুলির যথার্থ মর্যাদা দেওয়া জরুরী। জনসাধারণের মধ্যে সঠিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য একটি বিশেষ সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন রয়েছে। 

● প্রাদেশিকতার সংকীর্ণতা এবং উপদলীয় কোন্দল।

● রাজনীতিতে বহুদল প্রথার গণতন্ত্র 

● দেশবিভাগজনিত কারণে হওয়া উদ্বাস্তু সমস্যা এবং জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

● অর্থনীতির অসাম্যতা।

● দেশের অধিক সংখ্যক জনগণের মধ্যে নিরক্ষরতা।

● আমাদের দেশের হতাশাগ্রস্ত জনসমাজ, বেকারি, উদ্দেশ্যহীন শিক্ষার প্রসার, বিভিন্ন অংশে সমাজবিরোধীদের প্রাদুর্ভাব প্রভৃতি জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

সংহতির মুখে বাধা

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

জাতীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, need for National education

নিজের দেশে জাতীয় সংহতিকে মূর্ত করে তুলতে হলে সর্বাগ্রেই একটি আদর্শ জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা জরুরী, পাশাপাশি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন এবং এক উদার জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংহতির ধারণা সঞ্চার করতে পারলে দেশে জাতীয় সংহতি স্থাপনের পথ আরও প্রশস্ত হবে।

শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমে জাতীয় সংহতি সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মনে এক উদার জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এই শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতে জাতীয় সংহতির ধারণাকে সমাজে বিস্তার করতে পারে।

সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali

সমাজ সেবা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণ, Social service and eradication of illiteracy

দেশের সংহতির পথে বাধা হিসেবে বহু সমস্যা রয়েছে। তবে মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল নিরক্ষরতা। এই নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে বহু নিরক্ষর জনসাধারণ আছেন, যারা অজ্ঞতার শিকার এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবাপন্ন, এছাড়াও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় ধর্মান্ধতা এবং প্রাদেশিকতা, যা জাতীয় সংহতির পথের প্রধান বাধা হিসেবে গণ্য।

এই সব সমস্যাগুলো দূর করতে হলে বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সমাজের জন্য সেবামূলক কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, এতে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকা সংকীর্ণতাকে দূর করে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। নিরক্ষরদের সাক্ষর করতে হলে শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে কিংবা মাসে একদিন করে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকাতে নিরক্ষর জনগণের মধ্যে শিক্ষাদান করার নানা কর্মসূচি শুরু করে, তবে নিরক্ষরতা অবসান হতে পারে, আর এইভাবেই জাতীয় সংহতিমূলক কাজগুলোর পথও প্রশস্ত হবে।

সমাজ সেবা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণ

তাই জাতির আপামর জনগণকে হীন তথা সংকীর্ণ স্বার্থ, অসৎ বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে উদারতা এবং সংস্কারমুক্ত মানসিকতার মধ্য দিয়ে আন্তরিকভাবে একটি বিষয় উপলব্ধি করতে হবে, তা হল—

” সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। “

বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত, Best detailed information about Global Warming in Bengali 

দেশের সংহতি বজায় রাখার কাজে ছাত্রসমাজের ভূমিকা, Role of student society in maintaining the unity of the country

যেকোনো দেশের ছাত্রসমাজই সেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য রেখে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে মহান ঐক্য এবং সংহতির মন্ত্রবাণী পক্ষপাতহীনভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই ছাত্রজীবনই হল সমাজসেবা তথা দেশের সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পটভূমি।

ছাত্রছাত্রীরা চিরকাল ধরেই প্রভাতের সূর্যের ন্যায় চিরনবীন হয়, বর্ষা কালের নব কিশলয়ের ন্যায় চিরসবুজ, এক কথায় নবীনত্বের শুচিতা ছাত্রদের দেহমনে বিরাজমান। সেবাধর্মের ক্ষেত্রেও যে মহত্ত্ব, উদারতা, আত্মত্যাগ পরায়ণতা প্রভৃতি সর্বাগ্র সন্ধান ছাত্রসমাজই পেয়ে থাকে। ছাত্রসমাজ অনেক সময় জনসেবার মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মৃত্যুর মহিমাও বরণ করতে রাজি। মানবজাতির দুঃসহ লাঞ্ছনা ছাত্রসমাজ কখনই নীরব দর্শকের মত সহ্য করে থাকতে পারে না।

দেশের সংহতি বজায় রাখার কাজে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

বিশেষ করে সমাজ থেকে নিরক্ষরতার অন্ধকার দূর করার কাজে ছাত্রসমাজ সঠিক ভূমিকা নিতে পারে, তারাই পারবে সমাজের মনে শিক্ষার আলো জ্বেলে দিয়ে জনগণকে জাতীয় সংহতি সম্পর্কে সচেতন করতে। সমাজের তথা জাতির বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণের ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতে পারে।

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, Unity in diversity 

‘এক জাতি এক প্রাণ’ – এই মন্ত্রটি দেশের অর্থাৎ জাতির সকলের মনের মধ্যে থাকা জরুরী। দেশের জনগণকে ঐতিহ্যের জাগরণ ঘটানোর জন্য বিবিধের মাঝে মহান মিলনের আদর্শ গ্রহণ এবং একতার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ হল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বহু ভাষাভাষী এবং বিচিত্র জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত জনগণের বসবাসের উপযুক্ত দেশ।

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য

এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য যেমন অপর্যাপ্ত, তেমনি জনগণের মধ্যে বৈচিত্র্যও অফুরন্ত। তাই দেশবাসীর উদ্দেশ্য হতে হবে, “Unity in Diversity’ – অর্থাৎ আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হল বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য তৈরি করা। ভিন্ন মানুষের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখার মাধ্যমেই তৈরি করে তুলতে হবে জাতীয় সংহতি। তা না হলে জাতীয় সংহতির উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারবে না।

আমাদের দেশ ভারতের ভূখণ্ডে বাস করে ভিন্ন জাতির ভিন্ন মানুষজন। কিন্তু দেখতে গেলে ভারতীয় জাতি হল এক ঐক্যবদ্ধ বিচিত্র ধরনের জাতি। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য বজায় রাখাই হল ভারতীয় জাতির জনগণের মূলমন্ত্র। ভারতীয়দের মধ্যে থাকা ঐক্য তথা অখণ্ডতার ভাবনাই হল দেশের জাতীয় সংহতির মেরুদন্ড।

উপসংহার, Conclusion

আমাদের দেশ এক বহুজাতির মিলন তীর্থ হিসেবে পরিচিত । তাই এদেশের বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী জনগণের ভাষা, পরিধেয় পোশাক, চিন্তাভাবনার ধরণ, লোকসংস্কৃতি, ধর্মীয় চেতনা সবকিছুই ভিন্ন রকমের।

আমাদের দেশ এক বহুজাতির মিলন তীর্থ হিসেবে পরিচিত

দেশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা সম্ভব না, এই বৈচিত্র্যকে নিয়েই হয় সমগ্র দেশের একতা ও সংহতি। দেশ, জাতি ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলো দূর করার মাঝেই নিহিত আছে দেশের সংহতি গঠনের সুমহান কার্যক্রম। তবে এর জন্যে প্রথমেই জরুরী সকলের মনে দেশপ্রেমের ভাবনা জাগ্রত করা।

Recent Posts