ভূমিকা, Introduction
আমাদের বাসস্থান পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই বিষয়টাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন হিসেবে পরিচিত। সূর্যের থেকে আসা তাপশক্তি এই পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলে এবং সূর্যের দ্বারা বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশটাই পুনরায় বায়ুমন্ডলে ফিরে চলে যায়।
তবে মানুষের সৃষ্ট দূষণ এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বনভূমি উজাড় করে দেওয়ার ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির পরিমাণও আশঙ্খাজনিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বিকিরিত তাপশক্তি আবার বায়ুমন্ডলে ফেরার পথে বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং এইভাবেই বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হয়, যা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা Global warming হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে গ্রীনহাউসের প্রভাব এবং ওজোন স্তর হ্রাস, Greenhouse effect and ozone layer depletion in global warming
মানবজাতি বিভিন্ন কারণে অরণ্য ধ্বংস করার ফলস্বরূপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যদিও বিগত ৮০০০ বছর যাবত এই তাপমাত্রা প্রায় স্থিরই ছিল । তবে গত ১০০ বছরের হিসেবে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, গত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ০.৫°C এর মত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ভাপমাত্রা ১.৫ থেকে ২.০° C পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এবং এই তাপ ২১০০ সালের মধ্যে ১.৮°C থেকে ৬.৩° C -র মতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীপৃষ্ঠে উষ্ণতার এরূপ ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকেই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলে অভিহিত করেছেন।
সৌর তারতম্য তত্ত্বের সাথে উষ্ণায়নের সম্পর্ক, Relation of global warming to solar variation theory
সূর্য হল পৃথিবীর প্রাথমিক শক্তির উৎস, সেই হিসাবে ভূপৃষ্ঠে আগত সূর্যালোকের পরিবর্তন ঘটলে তা সরাসরি জলবায়ুর উপর প্রভাব ফেলে। সৌরশক্তি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোনো রশ্মিতেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকে না, সেজন্যই একে বর্তমান উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করা যায় না।
বিশ্ব উষ্ণায়ন-এর কারণ কি কি? Cause of global warming
বিশ্বউষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর নানা কারণ রয়েছে, এর মধ্যে বেশিরভাগটাই মানবসৃষ্ট।
মানব জাতির বিভিন্ন ধরনের অবিবেচনা প্রসূত ক্রিয়াকলাপ সমূহ, যেমন অত্যধিক পরিমাণ জ্বালানির দহন, নির্বিচারে অধিক পরিমাণ বৃক্ষচ্ছেদন এবং অরণ্যবিনাশ, ক্ষেত খামারে কৃষিকাজ করতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণ নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার, বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন তথা নগরায়ন প্রভৃতি নানা কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে চলেছে। এর ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali
গ্লোবাল ওয়ার্মিং- এর কারণগুলি নিম্নরুপ, The causes of global warming are as follows:
জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি : যানবাহন, কলকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রেই জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে, যায় ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড(CO 2) নির্গমণের পরিমাণও ক্রমে লাফিয়ে বাড়ছে।
CFC-এর ব্যবহার হ্রাস: ক্লোরোফ্লোরােকার্বন বা ফ্রেয়ন হল একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এয়ার কন্ডিশনার, রং, প্লাস্টিক শিল্প, সুগন্ধি শিল্প, কম্পিউটার এবং অন্যান্য আরো বেশ কিছু যন্ত্রের থেকে ক্লোরোফ্লোরােকার্বন নির্গত হয়।
অরণ্যচ্ছেদন : পৃথিবীর বুক থেকে গাছপালা উজাড় হওয়ার কারণে বায়ুমন্ডলের মধ্যে থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা দিন দিন কম হয়ে যাচ্ছে।
নাইট্রোজেন অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফারের কণা উৎপাদন বৃদ্ধি : বিভিন্ন জায়গায় কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজন হিসেবে নানা রকম রাসায়নিক সারের ব্যবহার করা হয়, তাছাড়াও যানবাহনের ধোঁয়া, নাইলন শিল্প, প্রায় প্রতিটি কলকারখানার বিষাক্ত কালাে ধোঁয়া, বর্জ্য পদার্থ, আকাশে জেট বিমান চলাচল, বিভিন্ন সময়ে রকেট উৎক্ষেপণ ইত্যাদি ছাড়াও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফারের কালো ধোঁয়া নির্গত হয়; এইগুলিই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।
মিথেনের পরিমাণ বৃদ্ধি : মরে যাওয়া বা কেটে ফেলে দেওয়া গাছপালাগুলোর পচন, সকল প্রকার কৃষিজ বর্জ্যগুলো এবং জীবজন্তুদের বর্জ্য হতে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে বিশ্বউষ্ণায়নেরও বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়।
ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
বিশ্বউষ্ণায়নের ক্ষেত্রে গ্রীনহাউজ গ্যাসসমূহের প্রভাব, Effects of Greenhouse Gases on Global Warming
গ্রীন হাউস গ্যাসগুলি, যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড(CO2), কার্বন মনোক্সাইড(CO3), নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড ও সালফারের অন্যান্য সব অক্সাইড সমূহ, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন ইত্যাদি পৃথিবী থেকে তাপ বিকিরণ করে। এই তাপই, ইনফ্রারেড বিকিরণ হিসেবে আমাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে পূর্বে উল্লেখিত গ্যাসগুলির দ্বারা শোষিত তথা নির্গত হয়, এর ফলে বায়ুমন্ডলের নিম্নস্তর এবং ভুপৃষ্ঠে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।
বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
পৃথিবীতে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব, Effects of global warming on Earth
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব কিন্তু অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব যে কেবলমাত্র বায়ুমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে বা সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উচ্চতার পরিবর্তন আনছে তাই নয়, বরং এর সাথে যুক্ত আছে আবহাওয়ার পরিবর্তনও। আবহাওয়ার গতি প্রকৃতির আগাম পূর্বাভাস দেওয়া এখন অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ছে, তাছাড়াও জলবায়ুগত দূর্যোগ যেমন বন্যা, খরা এবং ঝড় বৃষ্টি প্রভৃতির পরিমাণও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ, Consequences :
মেরু অঞ্চলে বরফ গলন এবং পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ গলন : পৃথিবীর ভূ-মণ্ডলের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে মেরু অঞ্চলের বরফ স্তর এবং পার্বত্য অঞ্চল সমূহের হিমবাহেরও গলন শুরু হবে, আবার এর প্রভাবে সমুদ্র উপকূলভাগের নীচু অংশগুলো জলমগ্ন হয়ে উঠবে, ফলস্বরূপ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর মাটি লবণাক্ত এবং অনুর্বর হয়ে যাবে ও তাতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। তখন সমগ্র সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হয়ে যাবে ।
সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : বিশ্বউষ্ণায়নের প্রভাবে মেরু অঞ্চলের বরফগুলো গলতে শুরু করবে এবং সেই জল গিয়ে সমুদ্রে আরো জলের যোগান বৃদ্ধি করবে এবং এইভাবেই সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী বর্তমান সময়ে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা প্রায় ১° সে. বৃদ্ধি হওয়ার কারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার. বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ পৃথিবীর নিম্ন উপকূলবর্তি অঞ্চলসমূহ তথা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতা সম্পন্ন যে দ্বীপগুলি আছে সেগুলো সমুদ্রজলে নিমজ্জিত হয়ে যাবে।
পৃথিবীতে আগত ও বিকিরিত সূর্যতাপের বৈষম্য : পৃথিবীতে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ভূপৃষ্ঠে আগত সূর্যরশ্মি এবং পৃথিবী থেকে পুনরায় বিকিরিত হওয়া সৌরতাপ শক্তির পরিমাণের মধ্যেও বৈষম্য ঘটতে দেখা যায়। ফলস্বরূপ পৃথিবীর উষ্ণতার ভারসাম্যও বিঘ্নিত হয়, যার ফলে বন্যা, খরা, ভয়ঙ্কর রকম ঘূর্ণিঝড় এবং দাবানলের প্রকোপও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
শস্য উৎপাদনের বৈষম্য : বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে, এর ফলে বৃষ্টিপাতের প্রকৃতিরও পরিবর্তন ঘটবে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের বন্টন দেখা দিলেও চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হবে, আর এর ফলে কৃষিজমির পরিমাণও ক্রমে হ্রাস পাবে। যদি অতিবৃষ্টি অথবা অনাবৃষ্টি দীর্ঘায়িত হয় তবে কৃষিজ ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
প্রকৃতির পরিবর্তন : পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যদি বৃদ্ধি পায়, তবে এর ফলে আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে উঠবে। তখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণও হ্রাস পাবে এবং টান পড়বে ভৌমজলের ভাণ্ডারেও। এইভাবে প্রকৃতির চিরাচরিত ধারায় পরিবর্তন ঘটবে এবং সমগ্র বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হবে।
- গুপ্তমুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি, Best details on Cryptocurrency in Bengali
- আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং, Best write-up on Outsourcing and freelancing in Bengali
- মোবাইল ব্যাংকিং, Know in detail about Mobile banking in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- ই-লার্নিং ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, Know what is e-learning in Bengali
উপসংহার, Conclusion
শিল্পায়ন তথা অরণ্য ধ্বংস হল বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ, তবে এগুলো ছাড়াও আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রাও এর জন্য দায়ী। এইতো যেমন এয়ার কন্ডিশনার বা রেফ্রিজারেটর হতে নির্গত মিথেন গ্যাস, যানবাহন হতে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদিও এই উষ্ণায়নের বড় কারণ। সেজন্যই এইসব ব্যবহারের বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।
তাছাড়া আমাদের সকলকেই বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় যথা সম্ভব কম করার দিকে নজর দিতে হবে, কারণ আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের হাতেই।