ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার এবং তাঁর ফরাসি মিত্ররা মিলে ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশী নামের এক স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উক্ত যুদ্ধের রাজনৈতিক ফল সুদূরপ্রসারী তথা ধ্বংসাত্মক ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং সেই থেকেই ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। পলাশীতে সংঘটিত হয়েছিল বলে যুদ্ধটি পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
পলাশীর যুদ্ধ কোথায় হয়? Where was the Battle of Plassey held?
ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই পলাশীর যুদ্ধটি কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তর দিকে তথা মুর্শিদাবাদের দক্ষিণ দিকে, হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন বাংলার রাজধানী পলাশিতে সংঘটিত হয়েছিল, যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলায় অবস্থিত। যুদ্ধকারীদের মধ্যে ছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
সিরাজ-উদ-দৌলা যুদ্ধের আগের বছরে বাংলার নবাব হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং তিনি ইংরেজদেরকে কলকাতায় তাদের দুর্গের সম্প্রসারণ -এর কাজ বন্ধ করার জন্য আদেশ দেন। অন্যদিকে ইংরেজ সেনাবাহিনীর নেতা রবার্ট ক্লাইভ নবাবের সেনাবাহিনীর প্রধান মীর জাফরকে ঘুষ দিয়ে তাকে বাংলার নবাব পদে অভিষিক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে সিরাজ-উদ-দৌলাহকে যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলা দখল করে নেন।
পলাশীর যুদ্ধের কারণগুলো কি ছিল ? Causes behind the Battle of Plassey
দেখতে গেলে পলাশী যুদ্ধের একটি সুদীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। ১৬৫০ এর দশকের প্রথম দিকে যখন “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” বাংলায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিল তখন থেকেই এই যুদ্ধের পটভূমির সূচনা হয়ে যায়। পলাশীর যুদ্ধের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, সেগুলো হল :
● বাংলার সিংহাসনে সিরাজুদ্দৌলা নবাব হিসেবে বসার পর তৎকালীন প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা বাংলার নতুন নবাবকে কোনোও ধরনের উপটৌকন প্রেরণ করেনি এবং তাঁর সাথে কোনোদিন সৌজন্যমূলক সাক্ষ্যৎ পর্যন্ত করেনি, যা ছিল অপমানজনক। ব্রিটিশদের এইরূপ অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য নবাব তাদের উপর ক্ষুব্ধ হন।
● নবাব সিরাজুদ্দৌলার নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখে।
● নবাব দস্তকের অপব্যবহার করার জন্য নিষেধ করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ কোম্পানি তৎকালীন নবাবের আদেশ অগ্রাহ্য করেছিল।
● ব্রিটিশ কোম্পানির নবাবের সাথে করা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করা এবং বাংলার জনগণের প্রতি ইংরেজদের নির্যাতন।
● ইংরেজদের প্রতি পদে একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং অবাধ্যতা নবাবকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ৩০ টি অজানা তথ্য ~ Bangladesh Facts and History in Bengali
যুদ্ধের বিবরণ, Description of the battle
কলকাতায় থাকা ইংরেজ সৈন্যরা ১৭৫৭ সালের ১২ জুন চন্দননগরে থাকা সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু সৈন্য মোতায়েন করে অবশিষ্ট ১৩ জন সৈন্যকে নিয়ে তাদের যুদ্ধযাত্রা শুরু করেছিল। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথে কাটোয়ার দুর্গ, হুগলী, অগ্রদ্বীপ এবং পলাশীতে নবাবের বেশ কিছু সৈন্য ছিল, কিন্তু তাদের কেউই ইংরেজদের পথে বাধাদান করে নি। নবাব তখনই বুঝতে পারেন যে, তার সেনাপতিরা হয়তো এই ষড়যন্ত্রে শামিল আছে।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি না করে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন না হতে দেওয়ার শপথ নিতে বলেন। সেইমতো মীর জাফরও পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করে। এই গৃহবিবাদের মীমাংসা করার পর নবাব রায় দুর্লভ, মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান, মীর মদন, মোহন লাল এবং ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যুদ্ধযাত্রা শুরু হয়।
এরপর ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তারা মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। রবার্ট ক্লাইভ ২২ জুন মধ্যরাতে কলকাতা থেকে নিজের সেনা বাহিনী নিয়ে পলাশীর দিকে আসার পথে মীর মদন হঠাৎ করেই ইংরেজ বাহিনীর উপর আক্রমণ চালান। প্রবল আক্রমণের জন্য অপ্রস্তুত থাকায় ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামে এক আম্রকাননে এসে আশ্রয় নেয়। বাগানটির উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। তখন ক্লাইভ বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।
এদিকে মীর মদন তাদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু সেনাপ্রধান মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান এবং রায় দুর্লভ সৈন্য সমাবেশ যেখানে করা হয় সেই খানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা বিশ্বাসঘাতকতা না করে সহায়তা করলে হয়তো মীর মদন ইংরেজদেরকে পরাজিত করতে পারতেন।
কৃপনের ধন – ঈশপ এর গল্প | Miser and His Gold Story In Bengali
পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব, Importance of the Battle of Plassey
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসারের মতে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যুদ্ধ হল এই পলাশীর যুদ্ধ। এক পর্যায়ে নবাবকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজরা। কিন্তু যুদ্ধে নবাবের বাহিনীর আকার ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় বড় হলেও নবাব সেনা প্রধান মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভের অধীনে থাকা প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সৈন্যই নিষ্ক্রিয় ভাবে যোগদান করেছিল। সবচেয়ে সমস্যা হয় তখন, যখন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টি শুরু হয়।
বৃষ্টিতে নবাব ও ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহার করার জন্য রাখা গানপাউডার ভিজে গিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইংরেজরা তাদের ব্যবহারের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গিয়ে ইংরেজদের কামানের গোলার আঘাতে মীরমদন নিহত হন, এতে নবাবও ভেঙে পড়ে সেনা প্রধান মীর জাফরের কাছে কি করবেন সে সম্পর্কে পরামর্শ চান। এদিকে মীরজাফর আপাতত যুদ্ধ বন্ধ রাখার এবং পরবর্তী দিনে এক নতুন উদ্যম নিয়ে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন নবাবকে।
তখন মোহনলাল প্রবল আপত্তি করেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও নবাব যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। সৈন্যরা পিছু সরে আসলে ইংরেজরা মীরজাফরের বার্তা পেয়ে নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হামলা চালায়।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। এই জয়ের ফলস্বরূপ ২০০ বছরের জন্য বাংলা ইংরেজদের হাতে নিজের স্বাধীনতা হারায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চক্র পলাশী প্রান্তরে একটি কালো দিবসের জন্ম দেয়।
আন্তর্জাতিক মে দিবস, Best details on International May Day in Bengali
পলাশির যুদ্ধের ফলাফল স্বরূপ কি ঘটে ? Outcome of the Battle of Plassey
● বাংলায় ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিষ্ঠা:
পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশের জয়লাভের ফলস্বরূপ বাংলায় ইংরেজদের প্রাধান্যের সূচনা ঘটেছিল। ব্রিটিশ কোম্পানির সার্বভৌমত্ব বাংলার নবাবকে যেন এক পুতুল নবাবে পরিণত করে দিয়েছিল এবং কোম্পানিই রাজনীতির প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
● দেশীয় রাজনীতিতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তার:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে বাংলায় রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, এরপর সেই সূত্র ধরে সারা ভারতে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার উদ্যোগ নেয়। বাংলার বিভিন্ন সম্পদকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতের অন্য সব অঞ্চলগুলিকেও নিজেদের অধিকারের আওতায় আনার চেষ্টা শুরু করে দেয়।
● প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি :
পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে বাংলার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ ভাবে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। সিংহাসনে থাকা নবাবদের থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিচালনায় এইরূপ জটিলতার সৃষ্টি হতে থাকে।
● ব্যাবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানির কর্তৃত্ব : পলাশির যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি নির্দ্বিধায় বিনা শুল্কে নিজেদের বাণিজ্যিক অধিকারের প্রয়ােগ ঘটাতে শুরু করে দিয়েছিল। এর ফলে বাংলার ব্যাবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থাপিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব। এইভাবেই বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে দেশীয় ব্যাবসা বাণিজ্যের সর্বনাশ হয়।
সম্পদের বহির্গমন, Drain of wealth
পলাশির যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক এবং আর্থিক কারণে বাংলা থেকে সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহ অন্যান্য সম্পদ ইংরেজদের হাত ধরে জলস্রোতের মতো ইংল্যাণ্ডে চলে যায়, কিন্তু ভারত বা বাংলা এর বিনিময়ে উপযুক্ত কোনও সুযোগ-সুবিধা লাভ করে নি। ঐতিহাসিকগণ তথা পণ্ডিতরা উক্ত ঘটনাকে ‘আর্থিক নিষ্ক্রমণ’, ‘আর্থিক নির্গমন’ বা ‘সম্পদের বহির্গমন’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সমালােচকদের মতে এই ঘটনাটিই ছিল দেশের সম্পদের নির্গমন বা অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণের সূত্রপাত।
পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দশা কি হয়েছিল? Fate of the conspirators in the Battle of Plassey
নবাবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আশ্রিত ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কেউই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সুখে ছিলেন না। ক্লাইভ তো রানীর দ্বারা করা অপমানকে সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, উমিচাঁদের মানসিক বিকৃতি ঘটে , দীর্ঘসময় ধরে নিদারুণ কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা ভোগ করে শেষ মেষ কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পান করে একজনের প্রাণ বিয়োগ ঘটে, একজনের মৃত্যু হয় বজ্রাঘাতে।
অন্যদিকে মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে শেঠ-ভ্রাতৃদ্বয়ের বুকে পাষাণ চাপা দিয়ে তাদের গঙ্গায় ফেলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। পর্দার আড়ালে থাকা ষড়যন্ত্রকারী সিরাজের খালা অর্থাৎ ঘষেটি বেগমকে নৌকা ভ্রমণের অজুহাতে ইংরাজরাই ডুবিয়ে মেরেছিল।
- কলকাতা ও ট্রাম: এক ঐতিহ্যের কাহিনী
- পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত, Details about Gayatri mantra in Bengali language
- জামাই ষষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, Detailed information about Jamai Shasthi in Bengali
- স্বদেশপ্রেম নিয়ে লেখা সেরা প্রবন্ধ, Best essay on Patriotism in Bengali
- আন্তর্জাতিক নারী দিবস, Know in details about International Women’s Day in Bengali
উপসংহার, Conclusion
যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ে বোঝাই যায় যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধ জয় করার মাধ্যমে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রাথমিক ধাপটি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। বহু বিশেষজ্ঞদের মতে, পলাশির যুদ্ধে পরাজয় ভারতের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। তবে যুদ্ধ হওয়ার পর ইংরেজ শাসকরা
এদেশে তাদের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ভাবধারার স্পর্শের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ তথা সভ্যতার নবজাগরণ ঘটায়। এর ফলস্বরূপ মধ্যযুগের অবসান ঘটার সাথে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে।