ভূমিকা, Introduction
“বর্ষণমুখর সন্ধ্যা.. খোলা বারান্দা…দুটো চেয়ার ….দুটো ধূমায়িত কফিমাগ…নিকষ অন্ধকার…চারিদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু বৃষ্টির শব্দ“
কথাগুলো পড়তে পড়তেই চোখের পাতায় যেন ভেসে ওঠে বর্ষণমুখর সন্ধ্যার বিশেষত্ব। গ্রীষ্মের অসহ্য দাবদাহের অবসান ঘটিয়ে ধরাধামে আগমন ঘটে মোহময়ী বর্ষার। বর্ষার করুণাধারায় ভিজে শীতল হয় ভূমি, প্রকৃতি ফিরে পায় নতুন প্রাণ।
বাংলা মাস জৈষ্ঠ্যের শেষে অর্থাৎ শ্রাবণের সূচনালগ্নে নীল আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়, এরপর ধরণীর শুষ্কতা দূর করতে বৃষ্টির ফোঁটা যখন ভূমিতে নেমে আসে, তখন তৃষ্ণার্ত পৃথিবী যেন বুভুক্ষুর মতো মেঘেদের দেওয়া প্রানসুধা পান করে। বাংলা ভাষায় বহু কবিতা ও সংগীত বর্ষাকালের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। বর্ষাকাল জগতকে নিজের এই অনন্য মোহময়তায় মাতিয়ে রাখে দীর্ঘসময়ের জন্য।
বর্ষাকালীন সন্ধ্যার সৌন্দর্য্য, Borshonmukhor sondhyar soundorjyo
গোধূলির পর আসা সন্ধ্যার শুরুর সময়টি সকলের কাছেই যেন পরম মায়া জড়ানো একটা অনুভুতি। সন্ধ্যাকাল সকলের কাছেই ভীষণ পছন্দের একটি সময়। এরসঙ্গে বর্ষার পবিত্র শান্তির আবেশ যদি মিশে যায়, তবে যেরূপ পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাকে এককথায় অনন্য তথা অনবদ্য বলা চলে।
একদিকে থাকে সন্ধ্যার পূর্ণতা, অন্যদিকে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত বর্ষণের পরম প্রশান্তি, দুইয়ে মিলে মন যেন এক অবর্ণনীয় অনুভূতিতে উদ্বেলিত হয়। গোধূলি লগ্নে যখন আকাশ জুড়ে মেঘ করে, সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে বিদায়ী সূর্যের শেষ ছটা দেখা যায়। যখন সন্ধ্যা নামতে থাকে বর্ষণ শুরু হয় টিপটিপ করে। বর্ষাকালীন সন্ধ্যায় সময়ের সাথে বর্ষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে ধীর গতিতে।
বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে মিশে যায় গৃহস্থের ঘরের শঙ্খ ধ্বনি; আর আকণ্ঠ আধ্যাত্মিকতায় ভরা ধূপধুনোর গন্ধের সাথে মিশ্রিত হয় মাটির ভিজে সোঁদা গন্ধ। বাসায় ফিরতে থাকা পাখিরা তখন বৃক্ষের সবুজ ঘন পাতার তলায় আশ্রয় নেয়। এরূপ সন্ধ্যায় মন চায় গরম চা আর সাথে ভাজাভুজি জাতীয় খাবার, পাশাপাশি গল্পের আসর বসলে তো কোনো কথাই নেই। এমনই এক মোহময়ী বাড়ি বর্ষণের সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও রয়েছে।
বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
স্মরণীয় এক বর্ষণমুখরিত সন্ধ্যা, A memorable rainy evening
দিন টি ছিল শনিবার, শ্রাবণ মাসের শুরুর দিকের এক মনোরম সন্ধ্যা। সেই দিন বাড়ির সকলেরই যখন নিত্যদিনের প্রায় সব কাজ শেষ হতে চলেছে তখন দুপুরের সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে বাঁক নিতে শুরু করলো।
সেই দুপুর পের হতে না হতেই বারিধারা আমাদের চারপাশ মুখরিত করে তুলেছিল। কখনও টিপটিপ বৃষ্টি, কখনও বা ঝিরঝির, আবার এক সময় ঝমঝম করে অবিরাম বর্ষণে সিক্ত হয়ে যায় প্রকৃতির সবকিছুই। সকাল থেকে দুপুরের শুরু অবধি বেশ কিছুক্ষণের জন্য সূর্যের দেখা পাওয়া গেলেও, দুপুরটা বিকেলের দিয়ে গড়িয়ে যেতেই সূর্যদেবের মুখ ঢেকে দিয়ে চারপাশ কালো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে গেল।
বিকেল থেকেই সেই কালো মেঘ থেকে গুরু গুরু গর্জন হতে শুরু করে, সেইসঙ্গে আকাশের বুকে ঝিলিক দিতে থাকে বিদ্যুতের নীল শিখা। ওই গোধূলিলগ্নের আকাশে ছেয়ে থাকা কালো মেঘের আগল যেন ভেঙে চুরে নেমে পড়লো মুষলধারায় বৃষ্টি রূপে। প্রকৃতির এই মোহময়ী রূপ দেখে এক কবিতার কয়েকটি ছন্দ মনে আসছিল বার বার-
“সূর্য নামলো পাটে আঁধার হলো,
শ্রাবন সন্ধ্যা বুঝি ঘনিয়ে এলো
আলো আঁধারীর শেষ যুদ্ধটা চলছে,
পরাজিত হলো আলো আধারের কাছে।
আকাশ ঢেকেছে মেঘে কোথাও নেই তারা,
ঝরে আধারের মাঝে শ্রাবনের ধারা।”
বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali
মাটির ওপর ফোঁটাগুলো ঝরে পড়তেই চারপাশ ভরে উঠলো ভিজে মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধে। সেই বৃষ্টি যেন সন্ধ্যার সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে তুলেছিল, কিন্তু এই যে শুরু হল তা আর থামবার কোনো অবকাশ নেই।
যারা বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন, সকলেই কাকভেজা হয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। সকলে মিলে চা আর পেঁয়াজের পকোড়া নিয়ে একসাথে বসলাম, গল্পে গল্পে জমে উঠেছিল আসর, কিন্তু এরই কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক অন্ধকার করে নিভে গেলো বিদ্যুতের আলো, হলো লোডশেডিং। সবাই সব কাজ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো, বাড়ির কচিকাঁচাদেরও আজ পড়তে বসার মন নেই, তাই বড়দের কাছে বায়না ধরে সেই দিনের মত লেখাপড়া থেকে ছুটি সবার।
একটি হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে জানলা বন্ধ করে সবাই একসাথে বসলাম, বসে বসে কি করবো ভাবতে ভাবতে শেষ অবধি গান করতে শুরু করলাম-
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।
যূথী বনে ঐ হাওয়া– করে শুধু আসা যাওয়া,
হায় হায়রে দিন যায়রে ভরে আঁধারে ভুবন।
শুধু ঝরে ঝরঝর আজ বারি সারাদিন,
আজ যেন মেঘে মেঘে হল মন যে উদাসীন।”
গান শেষে বড়দের মুখ থেকে ছোটবেলার গল্প শুনতে শুনতে মগ্ন হয়ে পড়লাম। মাঝেমধ্যে জানলায় বাতাস এর প্রভাবে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছিল; আর এরসাথে ঘরে থাকা সকলের মনই যেন একসাথে এক অপরূপ সুন্দর অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে উঠছিল।
বিশেষ করে বাড়ির সকলে একসাথে এতটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আরো বেশি আনন্দ বোধ হয়েছিল সেই সন্ধ্যায়, অন্যসময় তো সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই এমন গল্পের আসর জমানোর সুযোগও হয় না। এমন অবস্থাটা কবির কথার মত বলতে গেলে-
“মানুষের আজ নেই কোন কাজ, ঘর কোণে আছে বন্দী,
কাজ করে যারা অস্থির তারা, বের করে নানা ফন্দী।”
তবে একটা কথা বলতেই হয় যে সেই বিশেষ সন্ধ্যাটি আঁধারে মোড়া থাকলেও এক আনুষ্ঠানিক সমাবেশের সৃষ্টি করেছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে কখন যে রাত হলো তার হদিশই যেন পেলাম না।
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার, Best article on Environmental pollution and its remedies
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শেষে, At the end of the incessant rain
সন্ধ্যার বৃষ্টি রাতে যখন থামল, তখন সারা বাড়ি সহ আশে পাশের কোথাও ইলেকট্রিকের আলো নেই, বারান্দায় বের হয়ে দাঁড়ালাম, যতদূর অবধি দেখা যায় প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে, আর চারপাশে করছে থৈ থৈ জল; ঘরে ফিরে এসে অনুভব করলাম খোলা জানালা দিয়ে আসছে ব্যাঙের অবিরাম ডাক, তার সাথে আছে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ যেন ছন্দ মিলিয়ে চলছে, তাছাড়াও ছিল মাটির ভেজা ভেজা গন্ধ, অর্থাৎ সব মিলিয়ে সমগ্র পরিবেশকে যেন মাতাল করে রেখেছে।
জ্বালিয়ে রাখা হারিকেনের তেল হয়তো শেষের পথে, তাই তার আলোও যেন তখন প্রায় নিভু নিভু, মোমবাতি জ্বেলেই খেতে হবে রাতের খাবার: এরূপ বর্ষণের উৎসবে বাঙালিদের সার্বজনীন জাতীয় খাবার হল: খিচুড়ি আর আলু বা মাছ ভাজা। খাওয়ার পর হালকা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তার আন্দাজ নেই। সন্ধ্যা হতে রাত অবধি চলতে থাকা অবিশ্রান্ত বর্ষণের মায়ায় জড়ানো এমন একটি মায়াবী সন্ধ্যা এইভাবেই এক পরম মাধুর্যের মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হল।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
“মেঘের উপর মেঘ জমেছে..
মুখ ঢেকেছে অন্ধকারে..
বৃষ্টি তখন ফন্দি আঁটে
চোখের নজর ঝাপসা করে।”
বৃষ্টি দেখলে মনে কত না আদন্দ বোধ হয়। কথায় আছে প্রকৃত দুঃখ অনুভূত না হলে সুখের অনুভূতি কখনোই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তবে একথা সত্য যে অতিবর্ষণ সমাজের বহু মানুষের কাছে অভিশাপস্বরূপ, তাও বর্ষণবিহীন পৃথিবী মরুভূমির মতো শুষ্ক এবং কঠোর হয়ে যাবে। বর্ষাকালই ধরিত্রীকে শস্য-শ্যামলা করে রাখে।
বর্ষার ছোঁয়াতেই সকলের প্রিয় সন্ধ্যেবেলাগুলি পরম পূর্ণতায় ভরে ওঠে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা মনোরম বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা আশা করি পাঠকদের মধ্যে অনেকেই আছে। এই লেখা পড়ে হয়তো সেই পুরোনো স্মৃতি মনের কোণ থেকে উঁকি দিচ্ছে।