শরৎকাল ও তার প্রকৃতি, Best write-up on Autumn and its nature in Bengali


“শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেলো ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।”

উক্ত কথাগুলোর মতই যেন আমাদের বন্দনায় রয়েছে শরতের অবস্থান। বাঙালির প্রাণের ঋতু হল শরৎ। বর্ষাকালের অবসান ঘটিয়ে আগমন হয় শরৎ ঋতুর। শরৎ কাল প্রকৃতির বুকে এনে দেয় সৌন্দর্যের মাধুরী। প্রকৃতি এই সময় যেন আগের থেকে আরো স্নিগ্ধ ও মনোরম হয়ে ওঠে। বর্ষার ধারায় সিক্ত পৃথিবী এ সময় থাকে তাপমুক্ত।

এই ঋতুতে সবুজ প্রাণে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে বন ও প্রকৃতি। শ্বেতশুভ্র কাশ ফুলের নৃত্যভঙ্গিমা, দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা,শিশির সিক্ত দূর্বা ঘাস, সকলের মনে সৃষ্টি করে আনন্দের হিল্লোল। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস মিলে শরতের জীবনকাল।  শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ, উদার। ক্ষণিকের জন্য মাঝে মধ্যে বৃষ্টিপাত হয়। এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরপুর থাকে শরৎ ঋতু। কালের পরিক্রমায় তৃতীয় ঋতু শরৎ।

শরৎকাল ও তার প্রকৃতি

শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! এই ঋতুর নিজস্ব একটা আনন্দময় গন্ধ রয়েছে। শরৎ হিন্দুধর্মাবলম্বীর সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়। তাই শরতের প্রতিষ্ঠা হয়েছে উৎসব প্রিয় বাঙালির হৃদয়ের তথা অন্তরের মণিকোঠায়।

শরতের সকালের বিশেষত্ব, Specialty of autumn mornings

সকলের মনে এক অভূতপূর্ব আনন্দ-অনুভূতির সৃষ্টি করে শরতের সকালগুলো। শরতের সকালে প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের আলোক রশ্মি শিশির ভেজা ঘাসে ও পাতায় পাতায় যেন এক ভিন্ন মাধুর্যের সৃষ্টি করে। ঘাসের ওপর সঞ্চিত থাকা শিশির বিন্দুগুলো যেন রূপোলি মুক্তার বিন্দুর মতো বলে মনে হয়।

এ সময় সর্বত্র যেন এক নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা বিরাজ করে। বর্ষাকালের নিবিড় ঘনঘটা সরে গিয়ে আকাশ নির্মল হয়ে ওঠে। নীল আকাশের বুকে থোকা থোকা মেঘ ঘুরে বেড়ায়, সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যাওয়া শালিক, ময়না, টিয়ের ঝাঁক দেখে যেন মনটা ভরে ওঠে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ কবিতায় এই বিশেষ ঋতুকে রূপায়ণ করে লিখেছেন : 

শরতের সকালের বিশেষত্ব

     ” আজ কি তোমার মধুর মুরতি, হেরিনু শারদ প্রভাতে! হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ, ঝরিছে অনল শোভাতে। পারে না বহিতে নদী জলধার, মাঠে মাঠে ধার নাকো আর-ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল, তোমার কাননসভাতে! মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী, শরৎকালের প্রভাতে। “

প্রাকৃতিক শোভা নিয়ে উক্তি, বানী, ক্যাপশন, স্ট্যাটাস, কবিতা ও ছন্দ, Best quotes on beauty of nature in Bengali 

শরতের আকাশ,  Sky in Autumn 

শরৎ মানেই নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। শরৎ মানে আকাশের গায়ে যেন মেঘ–তুলোর ওড়াউড়ি! কখনো সাদা, কখনো কালচে রূপ ধারণ করে শরতের আকাশে ভাসা–ভাসা মেঘের দল। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় শরতের আকাশ। আমাদের মন রবিঠাকুরের সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠতে চায়-

 “নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই-লুকোচুরি খেলা।”

শরতের আকাশ

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

শরতের সবুজ মাঠ কৃষকের আনন্দের উৎস, Green fields in autumn

বর্ষার পরে শরতের আগমনে যেন  প্রকৃতির বুকে নতুন রঙের ছোঁয়া লাগে। ঋতুবৈচিত্র্যের পরিক্রমায় শরতের নানা লাবণ্যময়তা ও নান্দনিকতা থাকলেও শরৎ অনেকটা ক্ষণস্থায়ী। শহর জীবনে শরতের উপস্থিতি খুব একটা টের না পাওয়া গেলেও শরৎ ঠিকই তার সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে যায় প্রকৃতি জুড়ে।

শরৎকালের এক অসাধারণ আকর্ষণ হল অবারিত সবুজ মাঠ, যা কৃষকদের মনেও আনন্দের সঞ্চার করে। বর্ষা চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে মাঠ থেকে জলও সরে যায়, ফলে জলসিক্ত মাঠে কৃষকেরা আবার চাষ করতে যান। ক্ষেতে তারা হৈমন্তী ধানের বীজ বোনেন, নতুন সব চারা রোপণ করেন। বুকে আবারও বাঁধেন সম্ভাবনার নতুন স্বপ্ন। কিছু দিনের মধ্যেই সবুজ ফসলের আনন্দে ভরে ওঠে কৃষকেরও মন। আয়োজিত হয় নবান্ন উৎসব।

শরতের সবুজ মাঠ কৃষকের আনন্দের উৎস

শরৎকালে নদীর প্রবাহ, River flow in autumn

বর্ষা ঋতুর পরই শরতের আগমন, তাই বর্ষার স্রোতস্বিনী শরতেও পূর্ণ হয়ে থাকে। শরতের নির্মল জলরাশি অবিরাম ভাবে বয়ে চলে যায় সাগরের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে। নদীর বুকে পালতোলা নৌকা ভাসিয়ে মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে চলে মনের আনন্দে। নদীর দুই কূলে সবুজ বনরাজি যেন তখন সবুজের স্বর্গপুরির রূপ ধারণ করে, পাশাপাশি কাশবনের শুভ্রতা যেন মনকে আরো আনন্দিত করে তোলে। 

শরৎকালে নদীর প্রবাহ

রঙিন বসন্তের বর্ণময় উক্তি | Beautiful Bengali Quotes, Posts about Spring Season

শরৎকালীন ফুল, Autumn flowers

শরতের সৌন্দর্য্য বর্ধক হলো নদীর কিনারে বালির চরে বাতাসের সাথে দোলা খেতে থাকা কাশবন। তবে শুধু কাশফুলই নয়, শরতকালে ভিন্ন ভিন্ন ফুলের সমারোহে সেজে ওঠে গোটা প্রকৃতি। দলে দলে সেজে থাকে জুঁই, কেয়া, শিউলি, জবা, মালতি, কামিনি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম ফুল, দোলনচাঁপা, বেলি, নয়নতারা, ধুতরা, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঞ্চন, রাধাচূড়া, স্থলপদ্ম ইত্যাদি ফুল, যাদের শোভায় হেসে ওঠে প্রকৃতির রূপ।

তাছাড়াও জলাশয়গুলো ভরে ওঠে শাপলা, শালুক, পদ্ম প্রভৃতি ফুল দিয়ে। সত্যি বলতে, শরতের প্রকৃতি বড়ই বৈচিত্র্যময় তথা লাবণ্যময়ীও। শরৎরানির মনোগ্রাহী প্রকৃতির প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে কবি নজরুল ইসলাম নিজের কাব্যে লিখেছেন, 

শরৎকালীন ফুল

” শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা, শেফালি পুলকে ঝরেপড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা। “

শরৎ কালের উৎসবের আমেজ, autumn festival

শরৎ কালে পরিবেশ নব রূপে সেজে ওঠে, প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও মনোরম ও সুন্দর। চারিদিকে তৈরী হয় উৎসবের আমেজ। শরৎ কাল আমাদের সকলের সারা বছরের দুঃখ, বেদনা তথা ক্লান্তির গ্লানি ভুলিয়ে দেয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গা পুজোয় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ একসাথে আনন্দে মেতে ওঠে।

দীর্ঘ চারদিন ব্যাপী আরাধনা চলে দেবী দুর্গার। জীবনের সুখ-দুঃখের দোলাচলের  গভীর সত্যটা শরতের মধ্যে সহজেই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। আগমনীর আনন্দ আর বিজয়ার বিষাদ জীবনের এই স্বরূপকে উপলব্ধি করতে শেখায়। এই ঋতু যেন আমাদের বুঝিয়ে দেয় সুখ-দুঃখের দোলাচালে উত্থান-পতনের নামই হলো জীবন।

শরৎ কালের উৎসবের আমেজ

গ্রীষ্মের দুপুর সেরা রচনা, Best essay on summer afternoon in Bengali

শরতের রাত কেমন হয়, Autumn nights

শরতের রাত স্নিগ্ধতা ও কোমলতা মিশ্রিত এক অপূর্ব রূপ যেন নিয়ে আসে প্রতিদিনের শেষে। রাত গভীর হওয়ার সাথে চারপাশ ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে, মাঝে মাঝে বইতে থাকে স্নিগ্ধ বাতাস। সন্ধ্যা হতে না হতেই ভেসে আসে শিউলির মিষ্টি সুবাস। ভোর বেলায় শিশিরসিক্ত শিউলি ফুল ঝরে পড়ে নিচের সবুজ ঘাসে। ফুলগুলোর কমলা বোঁটায় টলমল করে শিশিরের কণা। গাছের পাতায় পাতায় শোনা যায় শিশির ফোঁটা ঝড় পড়ার শব্দ, এসব দেখে যেন কবি-হৃদয় চঞ্চল হয়ে উঠে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম শরতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন,

শরতের রাত কেমন হয়

“শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ, এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই।”

কালবৈশাখী রচনা, The best essay on Northwester or Kalbaisakhi in Bengali

শরৎ কালের প্রকৃতি নিয়ে কবিদের মুগ্ধতা, the nature of autumn and Poets’ fascination

শরতের অপূর্ব দৃশ্য তথা শরতের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত কবিতা। নিজের কলমের ভাষায় ফুটিয়ে তুলেতে চেষ্টা করেছেন শরতের বৈশিষ্ট্যগুলোকে। শরতের অনুপম মাধুর্যের প্রতি মোহিত হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 

“আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা, নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা, এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে, এসো নির্মল নীলপথে।”

        শরতের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আনমনে সুর তুলেছিলেন

শরৎ কালের প্রকৃতি নিয়ে কবিদের মুগ্ধতা

 “এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে, এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।”

শেষ কথা, Conclusion 

শরৎ কালে বর্ণের স্নিগ্ধতা আর উদারতা পরিলক্ষিত হয়। সবুজ, নীল ও সাদার এমন অপূর্ব সমন্বয় আর হয়তো কোনো ঋতুতেই দেখা যায় না। প্রকৃতি যেন নিজের হৃদয় উজাড় করে মেলে ধরে এই ঋতুতে। শরৎ বাংলার হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের এক ঋতু। এক কথায়, আনন্দের পুরোধা। শিউলি ঝরার আনন্দ, কাশ ফুলের দুলুনি, মেঘ মুক্ত আকাশে নীলের সমারোহ হেমন্তের শুরুতে বিদায় নেয়। আর তখন সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আনন্দের সমারোহ স্মৃতিতে পরিণত হয়। আর থাকে শুধু আগামী শরতের প্রতীক্ষা।

Recent Posts