চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা, Best write up on contribution of films in Bengali


দীর্ঘ সময় ধরে আকর্ষণীয় এবং অন্যতম বিনোদন মাধ্যম হিসেবে মানব জীবনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা বর্তমান। মানুষের ধ্যান- ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। জনগণের রুচিশীল সুস্থ জীবন সৃষ্টি, সৎ ও সুশীল চরিত্র গঠন এবং মানুষের সমাজ জীবনে ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা

সমাজ জীবনে চলচ্চিত্র মানুষের মন থেকে অশিক্ষা, পশ্চাৎপদতা এবং কুসংস্কার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলে, এক কথায় এটি সমাজ-শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া জাতীয় চেতনার সম্প্রসারণে, জাতীয় সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে এবং জাতির মনে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান জাগরণ করার দিক থেকে এক বলিষ্ঠ মাধ্যম এই চলচ্চিত্র। এভাবেই চলচ্চিত্র জাতীয় উন্নয়নেও অবদান রাখে। 

চলচ্চিত্র বলতে কি বোঝায়, What does film mean?

আমরা প্রায়ই সময় কাটানোর জন্য বা নিজের মনোরঞ্জনের জন্য সিনেমা বা চলচ্চিত্র দেখি। আলোছায়ার খেলায়, ধ্বনিময় বর্ণিল কারুকার্য সহকারে জীবনের ভাব তথা ভাবনার চলমান অভিব্যক্তি প্রকাশ করার মাধ্যম হল চলচ্চিত্র, যা প্রেক্ষাগৃহের রূপালি পর্দা ছাড়াও টিভি ও কম্পিউটারের রূপালি পর্দায় পরিদর্শন করার জন্য মানুষের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি মাধ্যম।

পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের জনগণের কাছে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ক্রমে বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে এটি গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেও স্বীকৃত। বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের অসামান্য ক্ষমতা রয়েছে, যার ফলে আধুনিক কালের সমাজ জীবনে চলচ্চিত্র ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করছে।

চলচ্চিত্র বলতে কি বোঝায়

সমাজ জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা, Role of newspaper in social life in Bengali

গণশিক্ষার মাধ্যম স্বরূপ চলচ্চিত্র, Film as a medium of mass education

আমাদের আধুনিক বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় গণমাধ্যম হল চলচ্চিত্র। এর বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভূমিকাও রয়েছে, কারণ বেশ কিছু ছবি এমন হয় যেখানে মনোরঞ্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে তুলে ধরা হয় এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়।

মানুষের মনে সামাজিক দায়িত্ববােধ, কর্তব্যবােধ জাগানো এবং চরিত্রগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ ঘটানােও হল চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযােগ্য কাজ। বিশেষ করে জীবনী এবং বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে যে কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্য চিত্র, তথ্যচিত্র ইত্যাদি তৈরি করা হয়, তার মাধ্যমে ছাত্রদের তথা সমাজের জনগনকে পরিপূরক শিক্ষা দেওয়া হয়।

গণশিক্ষার মাধ্যম স্বরূপ চলচ্চিত্র

ফলস্বরূপ সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন শাখায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার ঘটে। যেকোনো শিক্ষার্থীর মানবিক, নৈতিক তথা বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার কাজে সেগুলো খুবই সহায়ক।

(১) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবধর্মী তথ্য পরিবেশন:

শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রগুলি বাস্তব সমস্যার ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন স্থানের শিক্ষার্থীরা এই সকল চলচ্চিত্র থেকে বেশ কিছু বাস্তব ঘটনা তথা নানা রকম সমস্যা সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং বেশ কিছু অজানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

(২) জ্ঞানবৃদ্ধির সহায়তায় চলচ্চিত্রের ভূমিকা :

 আধুনিক যুগে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক ছবি তৈরি করা হয়, তাছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় যা থেকে ছোটো থেকে বড় সকলেই নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করে। এসব চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদেরকে আরো অনুসন্ধিৎসু করে তােলে।

(৩) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সামাজিক চেতনা বিকাশে সহায়তা : 

বিভিন্ন রকম সামাজিক সমস্যা ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যা সমাজে শিক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে, এইসব ছবি থেকে জনগণ তথা শিক্ষার্থীরা নিজের সমাজের সমস্যা ও সেগুলোর সমাধান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

(৪) চলচ্চিত্রের সহায়তায় মানবিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব প্রদান :

বেশ কিছু চলচ্চিত্র এমন হয় যেগুলোতে মানবিক সম্পর্ককে ফুটিয়ে তোলা হয়, এসব থেকে শিক্ষার্থীরা মানবিকতার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে, যা তাদের সঠিক চরিত্র গঠন করে তুলতেও বিশেষভাবে সাহায্য করে।

(৫) জনমত গঠনে চলচ্চিত্রের সহায়তা :

বিভিন্ন চলচ্চিত্র গল্পের মাধ্যমে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, যার মধ্য দিয়ে সমাজে আলোচনা সমালোচনা হতে দেখা যায়, এতে জনগণের মনোভাব প্রকাশিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিও দূর হয়।

(৬) মানসিক বিকাশের সহায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রের ভূমিকা :

মানুষের মনে চলচ্চিত্রের প্রভাবকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বিশেষ করে বাস্তবধর্মী এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন থাকতে সহায়তা করে। এমনকি অনেক সময়  পরিস্থিতির মোকাবেলার ক্ষেত্রেও মানুষ চলচ্চিত্র থেকে শেখা পন্থা ব্যবহার করে থাকে।

(৭) মানুষের চিত্তবিনোদনে চলচ্চিত্র :

চলচ্চিত্র মূলত মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্যই তৈরি করা হয়। তবে বেশিরভাগ প্রযোজক ও পরিচালক চেষ্টা করেন বিনোদনের আড়ালে মানুষের মনে জ্ঞানের প্রভাবও যাতে সঞ্চার করা যায়। তবে অবসর সময় কাটানাের পক্ষে চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

মানুষের চিত্তবিনোদনে চলচ্চিত্র

শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali

চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতা, Limitations of films

সবকিছুর ভালো দিক থাকার পাশাপাশি কিছু না কিছু খারাপ দিকও থাকে। একইভাবে চলচ্চিত্র সমাজে যেমন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে তেমনি এর বেশ কিছু অসুবিধা অথবা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

চলচ্চিত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা 一

(১) চলচ্চিত্রের কুপ্রভাব-

  অনেক সময় কিছু চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকটি কুরুচিকর দৃশ্য থাকে যার প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মনের মধ্যে বিকৃত রুচি গড়ে ওঠে। একটা বয়স থাকে যখন তারা ভালো খারাপের ভেদাভেদ বুঝতে পারে না, তাই অনেক সময় ছেলেমেয়েরা ভালো দিক থেকে খারাপ দিক টা আয়ত্ত করে নেয়। 

(২) চলচ্চিত্রে কুঅভ্যাস এবং কুসংস্কার প্রদর্শন :

চলচ্চিত্রে সাধারণত খারাপ বিষয় নিয়ে আগে দেখানো হয় এবং পরে এর প্রতিকার এবং গণসচেতনতা সম্পর্কে প্রদর্শন করা হয়। সেক্ষেত্রে জনপ্রিয় চিত্রশিল্পীদের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয় ধূমপান, মদ্যপান প্রভৃতি কিছু কু-অভ্যাস যা অনেক সময় অল্পবয়সি তথা বয়ঃসন্ধিক্ষণের শিক্ষার্থীদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে, তারা এগুলো নকল করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে পড়ে। তাছাড়াও কিছু কুসংস্কার সম্পর্কেও দেখানো হয় যার সঠিক-ভুল বিচার না করে অনেকে নিজের চালচলনের মধ্যে তা আয়ত্ত করে নেয়।

চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতা

(৩) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভ্রান্ত ধারণা গঠিত হয়:

 আজকাল বেশ কিছু চলচ্চিত্রে দেখা যায় যে নির্মাতা ছবির বিভিন্ন অংশকে জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কিছু অপ্রয়ােজনীয় তথ্য, অসত্য বা অবাস্তব বিষয় সমূহকে তুলে ধরেন। এইসব বিষয়গুলি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মনে সঠিক বাস্তব সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল ধারণা তৈরি করে দেয়, আর চলচ্চিত্র একমুখী সংযোগ হওয়ার ফলে সেখানে দেখানো ভুল ত্রুটি সংশােধনেরও কোনাে সুযােগ থাকে না। 

) সংস্কৃতি ধ্বংস হয় :

(৪) চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে সময়ের অপচয় :

 চলচ্চিত্র যেহেতু চিত্তবিনােদনের জন্য নির্মিত হয় তাই এর জনপ্রিয়তাও সময় কাটানোর নিমিত্ত হিসেবেই বেশি থাকে। এভাবেই অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা বা অন্য দর্শকরা চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে নিজের অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলে। সাময়িক স্থূল আনন্দ পেতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু শিক্ষামূলক কিছু পাওয়া যায় না, তাই এটি সময়ের অপচয় করে।

(৫) সংস্কৃতি ধ্বংস হয় :

বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ চলচ্চিত্র নির্মাতা ছবিতে শিক্ষামূলক দিক বা সমাজের উন্নয়নের দিকের বিষয়গুলো অবহেলিত করে দেয়, যার ফলে ধ্বংস হয় সমাজের সংস্কৃতি এবং এসবের প্রভাব স্বরূপ সামাজিক মূল্যবােধও বিপর্যস্ত হয়। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে যে মারাত্মক সামাজিক অবক্ষয় প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে তা রুচিহীন চলচ্চিত্রগুলোর ব্যাপক প্রভাবের কারণেই হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।

উপসংহার, Conclusion 

আমাদের দেশ সহ বিশ্বের সকল দেশে চলচ্চিত্রকে জনস্বার্থ, জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং জাতির সকল প্রত্যাশার পরিপূরক হিসেবে বিকশিত করা জরুরি। চলচ্চিত্রের গুণগত মান উত্তরণ করার মাধ্যমেই তা সম্ভব।

অনাবিল আনন্দ দান করার পাশাপাশি শিক্ষামূলক এবং জাতিগঠনমূলক উপাদান যোজনা এবং মানসম্মত শিল্পকর্মের পর্যায়ে নির্মাণ করেই চলচ্চিত্রের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করা দরকার

অনাবিল আনন্দ দান করার পাশাপাশি শিক্ষামূলক এবং জাতিগঠনমূলক উপাদান যোজনা এবং মানসম্মত শিল্পকর্মের পর্যায়ে নির্মাণ করেই চলচ্চিত্রের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করা দরকার। তবেই সমাজের কুসংস্কার, মধ্যযুগীয় সকল চিন্তা- চেতনা এবং বিজ্ঞান-বিমুখ মনোজড়তা নিয়ে অনড় হয়ে থাকা সমাজের জনগণের মনে পরিবর্তন আনা সম্ভব। বর্তমান সময়ে সমাজে বিরাজমান নৈরাজ্য, অস্থিরতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে জাতির উত্তরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে পথনির্দেশক হিসেবে চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

Recent Posts