করুণাময়ী রাণী রাসমণির জীবনী, Biography of Rani Rashmoni in bengali


 ভূমিকা : রাণী রাসমণি বা রাণীমা(২৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৯৩ – ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১) ছিলেন প্রথম মহিলা রত্ন যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে  কলকাতা শহরে একটি অবিস্মরণীয় চিহ্ন রেখে গেছেন  । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল এই মহীয়সী রমণীর আবির্ভাব কাল যদিও অনেকে ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন ।  কলকাতার জানবাজারের বাসিন্দা প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার ছিলেন তিনি ,যিনি  একাধারে ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাত্রী এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের অন্যতমা পৃষ্ঠপোষক।

করুণাময়ী রাণী রাসমণির জীবনী

জন্ম , বংশ পরিচয় ও বিবাহ , Birth, Parentage and Marriage

১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর  উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার  হালিশহরের, কোণা নামক  একটি  ছোট গ্রামে এক দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারে  জন্মগ্রহণ  করেন  রাণী রাসমণি। রাসমণির পিতা ছিলেন হরেকৃষ্ণ দাশ ও মাতা, রাম প্রিয়া দাশি।  পিতা হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন পেশায় একজন সাধারন দরিদ্র কৃষক ও গৃহনির্মাণকারী । শৈশবে   রাসমণির নাম তাঁর মা রামপ্রিয়া দাসীই প্রথম ভালোবেসে “রানী” রেখেছিলেন | পরে তাদের প্রতিবেশীদের সুবাদে তাঁর নাম হয়ে যায় রানী রাসমণি ।

সাত বছর বয়সে তিনি হয়েছিলেন মাতৃহারা। অসামান্যা সৌন্দর্যের অধিকারিণী রাণী রাসমণি মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার জানবাজারের  এক ধনী জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাস-এর সঙ্গে  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।বিবাহ পূর্বে  জমিদারবাবু  রাসমণির রূপ ও লাবন্য ছাড়াও তেজস্বীনী এবং দুয়ালু রূপের সাথেও পরিচিত হয়েছিলেন যার ফলে তিনি রানীকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহ পরবর্তী কালে  রাণী রাসমণি এক পুত্রসন্তান, (যে জন্মের কিছু পরেই মারা যায় )  এবং চার কন্যার জন্মদত্রী হন। তাঁর কন্যারা হলেন যথাক্রমে পদ্মমনি,কুমারী,করুণাময়ী ও জগদম্বা।এদের মধ্যে কন্যা করুণার বিয়ে হয় মথুরবাবুর সাথে। কিন্তু বিবাহের কয়েক মাস অতিক্রম হওয়ার পরই  করুণার মৃত্যু হয়।

জন্ম , বংশ পরিচয়

মথুরামোহন বিশ্বাস তখন জগদম্বা কে বিবাহ করেন।১৮৩৬ সালে রাণি রাসমণির স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি স্বহস্তে তাঁর স্বামীর জমিদারির সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সহকারে তা পরিচালনা করতে থাকেন।  স্বামীর মৃত্যুতে গভীরভাবে ভেঙে পড়লেও রাণী রাসমণি  দমে থাকেন নি।  তাঁর  নম্র স্বভাবের কারণে তিনি দরিদ্রদের প্রতি প্রচন্ড মমত্ববোধ দেখিয়েছিলেনএবং  পরবর্তীকালে তিনি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রচুর পরিমাণে অনুদান ও দিয়েছিলেন। এক সাধারণ ধার্মিক বাঙালি হিন্দু বিধবার ন্যায়ের সরল সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন রাণী  রাসমণি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। তৎকালীন গোঁড়া বাঙালি সমাজে বাবু রাজচন্দ্র দাশের স্ত্রী ছিলেন বলে , রাণী রাসমণি-কে রাসমণি দাশী বলেও সম্বোধন করে থাকত। 

বিবাহ

বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, Biography of Zainul Abedin in bengali

রাণী রাসমণির জনহিতকর কাজ, Benevolent works of Rani Rashmoni in bengali

রাসমণির এই বিশাল জনহিতকর কার্যাবলীর   পিছনে তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের অবদান ছিলো বিশাল। রাজচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে জনহিতকর কাজ করার ক্ষেত্রে সর্বদাই  উৎসাহ দিতেন এবং  পাশাপাশি, নিজের স্ত্রীর পাশেও থেকেছেন একজন বন্ধুর মতন করে।

একদা গঙ্গায় অসহায় জেলেদের মাছ ধরার উপর জলকর আরোপ করেছিলেন দুর্বৃত্ত  ইংরেজ সরকার । নিরুপায় হয়ে জেলেরা রাণীমার কাছে আবেদন করলে রাণীমা ইংরেজ সরকারকে ১০ হাজার টাকা কর প্রদান করেন এবং  ঘুসুড়ি থেকে মোটিয়াবুরুজ অঞ্চলের সমস্ত গঙ্গা জমা  হিসেবে নেন এবং জেলেদের সুবিধার্থে  রশি টানিয়ে জাহাজ ও নৌকো চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন।  ইংরেজ সরকার  রানি রাসমণির এই কার্যকলাপে আপত্তি জানায়।তবে রাসমণির বক্তব্য ছিল যে জাহাজ চলাচল করলে মাছ অন্য জায়গায় চলে যাবে আর যার ফলে জেলেদের ক্ষতি হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে  ইংরেজ সরকার রাণী রাসমণির ১০ হাজার টাকা তাঁকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং  জলকর  ও তুলে নেন।

রাণী রাসমণির জনহিতকর কাজ

এছাড়া এক নীলকর সাহেব সাধারণ প্রজাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিল মকিমপুর পরগণায়।রাণী রাসমণি এই নিপীড়ন বন্ধ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে স্টোনার খাল খনন করিয়েছিলেন যাতে মধুমতী নদীর সাথে নবগঙ্গার সংযোগ ঘটে।  তদুপরি রাণী রাসমণি সোনাই, বেলিয়াঘাটা ও ভবানীপুরে সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে  বাজার স্থাপন করেছিলেন এবং কালীঘাটের নির্মাণ করেন ।

রাণী  রাসমণির মহৎ কাজের মধ্যে অন্যতম এবং সর্বোৎকৃষ্ট ছিল ধর্মচর্চার উদ্দেশ্যে দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির নির্মাণ করা। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের নির্মান কাজ শেষ হলে সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিযুক্ত করেন রাণী রাসমণি।কথিত আছে যে, ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দে  রাণী রাসমণি মনস্থির করেছিলেন যে তিনি কাশীতে গিয়ে মা অন্নপূর্ণা ও বিশ্বনাথের পূজা দেবেন। যাত্রার জন্য ২৪টি নৌকো সমেত দাস-দাসী,  আত্মীয়-স্বজন সবকিছুই প্রস্তুত ছিল কিন্তু  যাত্রার পূর্ববর্তী রজনীর শেষ প্রহরে স্বয়ং মা ভবতারিণী রাণী রাসমণিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে  কাশী যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, রাণীমা যেন দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার তীরে ই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে  ভক্তিভরে পূজা করেন ।

জগজ্জননী ভবতারিণী মা সেই পুজোই গ্রহণ করবেন বলে রাণীমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।  মা ভবতারিণীর এই  স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দের ৩১ মে বৃহস্পতিবারে স্নান যাত্রার পুণ্য লগ্নে ।  এক লক্ষেরও বেশি টাকা ব্যয় করে রাণী রাসমণি রুপোর রথ বানিয়েছিলেন এবং তাঁর গৃহদেবতা রঘুবীরকে সাথে নিয়ে কলকাতার পথে শোভাযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন ।

 দক্ষিণেশ্বর

রাণী রাসমণি কর্তৃক প্রচলিত সেই রথযাত্রা আজও রথের দিনে দক্ষিণেশ্বরে মহা ধুমধাম সহকারে  পালিত হয়ে আসছে । মনে করা হয় যে  রথে আরোহণ করে জগন্নাথদেব পুরো দক্ষিণেশ্বর প্রদক্ষিণ করেন।

১৮২০ সালে বাংলায় ভয়াবহ বন্যা হয়। সেইসময় বহু সাধারণ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে নিজের বাড়ি-ঘর সহ সকল সম্পদ হারিয়ে ফেলেছিল।   দয়াময়ী রানী রাসমণি  জনসাধারণের এই অসহায়তার দিনে তাদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন।জানা যায় সেই বছরেই রানী রাসমণির বাবা হরেকৃষ্ণ দাসের ও মৃত্যু হয়। হরেকৃষ্ণের দাসের কোনো পুত্র সন্তান না থাকার কারণে রাণী রাসমণিই, মেয়ের কর্তব্যানুসারে বাবার পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন করেছিলেন গঙ্গার ঘাটে গিয়ে।

বাংলাদেশী উপাচার্য অধ্যাপক ড. অমিত চাকমা, Biography of Dr. Amit Chakma in bengali

রাণী রাসমণির অবদান, Contribution of Rani Rashmoni

মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ রাণী রাসমণি তাঁর   বিবিধ জনহিতৈষীকর কীর্তির  জন্য প্রভূত খ্যাতি  অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে  সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী অবধি একটি সুদূর প্রসারিত  সড়ক পথ নির্মাণ করেছিলেন। কলকাতাবাসীদের  গঙ্গাস্নানের সুবিধার্থে  তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাটের নির্মাণে তাঁর অবদান রেখে গেছেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি যা অধুনা ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার ও হিন্দু কলেজ যা অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠার সময়কালেও  তিনি যথাসাধ্য অর্থসাহায্য করেছিলেন।

রাণী রাসমণির অবদান

মহাপ্রয়াণ, Last days and death

১৮৬১ খ্রীস্টাব্দে র ১৯-শে ফেব্রুয়ারি,  রাণী রাসমণি  কালীঘাটে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর পার্থিব   দেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, চন্দনকাঠে দাহ করা হয়ে থাকে।  মাত্র ৬৮ বছর বয়সে এই মহীয়সী রমণীর জীবনাবসান হয়েছিল । রাণীমার অসীম মমত্ববোধ এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দয়াসুলভ ব্যবহারের জন্য  তিনি ‘লোকমাতা’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।শোনা যায় যে  ভারতসরকার রাণী  রাসমণির  স্মৃতি রক্ষার্থে এক স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিলেন তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে।

মহাপ্রয়াণ

জওহরলাল নেহেরু – স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ~ Jawaharlal Nehru Biography in Bengali

উপসংহার , Conclusion

 একজন দৃঢ় স্বভাবের নারী ছিলেন রানী রাসমণি যাঁর  দৃষ্টিভঙ্গি, সমসাময়িক বাকি মহিলাদের  থেকে অনেক বেশি উন্নত এবং পরিনত ছিলো। তাঁর সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ গুণ এই ছিল যে তিনি যেই কাজকে সঠিক বলে বিবেচনা করতেন, সেই কাজকে তিনি সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পেতেন না  যতই বাঁধা বিপত্তি  তাঁর সম্মুখে আসুক না কেন । তাঁর থেকে আমরা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে  মানুষের সেবা কীভাবে ভক্তিপূর্বক করা যেতে পারে।

রাণী রাসমণি  কখন ও তাঁর সেবার বিনিময়ে জনসাধারণের কাছ থেকে  লাভের প্রত্যাশা  করেননি উপরন্তু  তাদেরই সর্বদা উপহার স্বরূপ প্রদান করে গেছেন বিভিন্ন সামগ্রী।এই মহীয়সী রমণীর মহান কর্মই তাঁকে করে তুলেছে আপামর জনসাধারণের কাছে  চিরস্মরনীয়।অর্থের সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায় তিনিই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে।  অসহায় মানুষদের সাহায্যের কথা ভাবে আত্মনিয়োগ করে রাণী রাসমণি বাংলার ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অধিকাংশ   মানুষর যদি আজ রানী রাসমণির পথ অনুসরণ করে  অসহায় দুর্গতদের সেবার ব্রতে নিজেদের দীক্ষিত করে তুলতে পারে, তাহলে ভারত আবার এই জগৎসভায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করবে ।

রাণী রাসমণি বাংলার ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন

Frequently asked questions

রাণী রাসমণি কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল এই মহীয়সী রমণীর আবির্ভাব কাল।

রাণী রাসমণি পিতামাতার নাম কি?

 রাসমণির পিতা ছিলেন হরেকৃষ্ণ দাশ ও মাতা, রাম প্রিয়া দাশি। 

রাণী রাসমণির কয় সন্তান?

রাণী রাসমনির এক পুত্র এবং চার কন্যা।  

রাণী রাসমণি তাঁর জনহিতকর কার্য সম্পাদনে কার সাহায্য পেয়েছিলেন?

রাসমণির এই বিশাল জনহিতকর কার্যাবলীর পিছনে তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের অবদান ছিলো বিশাল।

রানি রাসমণির অন্যতম মহৎ কার্য কি ছিল ?

 রাণী  রাসমণির মহৎ কাজের মধ্যে অন্যতম এবং সর্বোৎকৃষ্ট ছিল ধর্মচর্চার উদ্দেশ্যে    দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির নির্মাণ করা।

Recent Posts