ঝাঁপ চড়ক এবং গাজন সম্পর্কে জানা অজানা কিছু কথা ~ Details about Jhaanp & Charak ( Bengali Festivals )



বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলার নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানানোর আগে, বাংলার শেষ উৎসব ‘গাজন’কে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে ।
গাজন পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে পালিত একটি জনপ্রিয় হিন্দু লোকউৎসব। এই উৎসবটি শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজা কে কেন্দ্র করে পালিত হয়ে।

বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন মালদহে গাজনের নাম ‘গম্ভীরা’ আর জলপাইগুড়িতে ‘গমীরা’। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে সন্ন্যাসী বা ভক্তরা শিবের গাজন উদযাপন করে । চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিতে চড়ক পূজার সাথে সাথেই এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল গাজন মেলা।

jhap charak gajan festival details in bangla

গাজন

গাজনের বিভিন্ন অনুষ্ঠিত সময়

ধর্মের গাজন মূলত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালন করা হয়ে থাকে; আর চৈত্রমাস ছাড়া যদি বছরের অন্যসময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তবে তাকে হুজুগে গাজন ও বলা হয়ে থাকে।

নামকরণ

বাংলা গাজন শব্দটি গর্জন শব্দ থেকে এসেছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা হুঙ্কার দেন এবং প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নামকরণ এই রূপ। অন্য মতানুযায়ী এ ও বলা হয়ে থাকে যে ‘গা ‘শব্দের অর্থ গ্রাম এবং জন শব্দের অর্থ জনসাধারণ; এই উৎসবটি গ্রামীণ জনসাধারণের জন্য নিবেদিত হওয়ায় উৎসবের এ রূপ নামকরণ দেওয়া হয়ে থাকে।

আবার ধর্মমঙ্গল কাব্যে রানি রঞ্জাবতীকে দেখা গেছে যে তিনি নিজের ধর্মকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে গাজন পালন করতেন। লোকমুখে এ কথাটিও শোনা যায় যে গাজন উৎসবের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও রয়েছে। চৈত্রমাসে যদি তিরিশ দিন বেতের লাঠি নিয়ে শিবের ব্রত পালন করে নাচ করা যায় তাহলে নাকি শিবলোকের প্রাপ্তি ঘটে বলে বিশ্বাস অনেকের।

আবার লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনটিতে দেবী হরকালীর সাথে শিবের বিবাহ হয়েছিল আর সেই বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন । অপরদিকে, ধর্মঠাকুরের গাজন হল ধর্মঠাকুর এবং বাঁকুড়া জেলার প্রসিদ্ধ দেবী কামিনী-কামাখ্যার মুক্তির বিবাহ উৎসব।

কার্তিক পূজার সমস্ত তথ্য ~ All details about Kartik Puja in Bangla

gajan festival in west bengal

উদযাপন

শহরের দমবন্ধ করা ভিড় কে এড়িয়ে আজও দূর দূরান্তের কোনও গ্রামে এই উৎসব উদযাপনের চিত্র চোখে পড়ে। গাজন হল মিলনের উৎসব। এই উৎসবে সামিল হতে পারেন যে কোনও ধর্ম ও জাতের মানুষ।

সারা বছর ধরে ব্রাহ্মণেরা যে শিবকে আগলে রাখেন গাজনের সেই দিনগুলিতে ভগবান শিব সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করে থাকেন আর সেখানে নেই কোনও ভেদাভেদ , জাতের বা কুলের । উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা নেই। গাজনের এই কদিন সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী আর এখানেই লক্ষ্য করা হয়েছে শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। তাই বলা হয়ে থাকে যে গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে গাজন উৎসব

পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নবদ্বীপের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে এখানকার শিবলিঙ্গগুলি বেশিরভাগই বৌদ্ধ প্রভাবিত। পাল যুগে জেলাটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান।গাজন উৎসবের পাঁচ দিন নবদ্বীপের সকল জনগণ মেতে ওঠেন এই উৎসব উদযাপনে । এই জেলাতে সাতগাজন, ফুল-ফল, নীল ও চড়ক — এই নিয়ে পালিত হয় গাজন।

গাজন উৎসব সাধারণত শৈব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মানা হলেও বর্ধমানের মন্তেশ্বর গ্রামে প্রায় চারশো বছর ধরে গাজনে মা কালীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। এই এলাকায় আরেকটি ব্যাতিক্রমী দৃষ্টান্ত হোলো যে এখানে মানুষই কালী রূপে পূজিত হয়ে থাকেন।

আবার অন্যদিকে বাঁকুড়া জেলারবেলিয়াতোড়ে ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজনে তিনটি প্রমাণ সাইজের কাঠের ঘোড়ার উপরে মহামানস, স্বরৃূপনারায়ণ ও ধর্মরাজ যা কিনা যথাক্রমেঃ বুদ্ধ, সংঘ ও ধর্মকে চড়ানো হয় এবং তার সাথে অসংখ্য ভক্ত-সন্ন্যাসী ও মাথায় জ্বলন্ত ধুনোর খোলা বহণকরে ও ব্রতচারিণী দলের একটি বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই উৎসবটি পালিত হয় ধুমধাম সহকারে।

চৈত্রসংক্রান্তির দিনে হুগলি জেলার তারকেশ্বরে তারকনাথ শিব, পূর্ব বর্ধমান জেলার কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিব, বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর শিব ও বাংলাদেশে ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার বুনোঠাকুর শিবের গাজন স্বমহিমায় খ্যাতি অর্জন করেছে । এ ছাড়া জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরাতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের অযোধ্যাগ্রামের মনসার গাজন ও আষাঢ়ি পূর্ণিমায় বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজন ও বহুল প্রসিদ্ধ।

রথযাত্রা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য ও ইতিহাস ~ Everything about Ratha Yatra in Bengali

গাজনের পরবর্তী দিন

গাজনের পরের দিনে মায়েরা নিজেদের সন্তানের শুভকামনায় নীল ব্রত পালন করেন। পুজোর রীতি মেনে গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল, সামান্য অর্থও দান করে থাকেন তাঁরা।

jhap charak

চড়ক বা ঝাঁপ চড়ক

চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিন পর্যন্ত চড়ক পূজার উৎসব চলে।বলা হয়ে থাকে যে এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের ই একটি অনন্য অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

চড়কের ইতিহাস

চড়কপূজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বে। এছাড়াও পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌরাণিক যুগে এই উৎসব সুপ্রচলিত ছিল। উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব একটা প্রাচীন নয়। কথিত আছে যে ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা চড়ক পূজা প্রথম প্রচলন করেন।

তবে এই উৎসবের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন রকমের মতবাদ রয়েছে। বান রাজার খ্যাতি ছিল একজন শিবসাধক হিসাবে। শিবকে তুষ্ট করার তপস্যাও করেছিলেন তিনি এবং তাঁর এই শিবভক্তির সূত্র ধরেই, আজও চড়কের সন্ন্যাসীরা বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দিয়ে থাকেন; এই উৎসবে নরমুণ্ড নিয়েও নৃত্যের প্রচলন দেখা যায় কোথাও কোথাও ।

১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫-র মধ্যে ছোটলাট বিডন এই ভয়ংকর প্রথা রোধ করেছিলেন। তাছাড়াও, নারী-পুরুষ ষ সকলেই শিব-পার্বতী সাজে সুসজ্জিত হয়ে হাতে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বের হতেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে তাঁদের অল্পবিস্তর কিছু প্রাপ্তি হত। সন্ধেবেলায় তাঁরা পাক করা অন্ন গ্রহণ করতেন। কোথাও কোথাও এ ও বলা হয়েছে যে সেই সময়ে ঋণে জর্জরিত কৃষকদের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে চৈত্রের শেষ দিনটিতে বড়শিতে বেঁধে চড়কে ঘুরানো হতো যা ১৮৯০ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

Unknown Durga Puja Facts in Bengali

পূজার নিয়ম ও বিধি

চড়ক পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম হল নীলপূজা ।পূজার পূর্ববর্তী দিনটিতে চড়কগাছকে পরিষ্কার করা হয় ধুয়ে এবং মুছে। এতে জলভরা একটি পাত্রের ভিতর শিবের প্রতীক চিহ্ন হিসেবে শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমাখা একটি লম্বা কাঠের তক্তা বা যাকে আমরা ‘শিবের পাটা’ বলে থাকি তা রাখা হয়ে থাকে, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে খ্যাত।

পতিত ব্রাহ্মণ এই পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পূজার বিশেষ বিশেষ রীতির অন্যতম হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটা আর ছুড়ির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা প্রভৃতি ।এই সব পূজার মূলে আছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর আস্থা ।

পূজার উৎসবের বিধি অনুসারে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। চড়কগাছে ভক্তগণ বা সন্ন্যাসীদেরকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে অতি দ্রুত ঘোরানো হয়। তাদের পিঠে, হাতে, পায়ে, জিভে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়ে থাকে এবং কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা ও গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়।

চড়ক প্রথা( বিস্তারিত )

বলা হয়ে থাকে যে চড়ক পূজা গাজনেরই রকমফের।
পূজার উদ্যোক্তা ভক্তগণ ও সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করে থাকেন। একজনকে হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে আর তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। । পুজোর আরেকটি রীতি হল এই যে সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আমগাছ থেকে একাধিক ফলসমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন যার নাম ‘বাবর সন্ন্যাস’ হিসেবে প্রসিদ্ধ ।

চড়কপূজার ঠিক আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয় যা নীলপূজা নামে পরিচিত। এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দল’ও বলে ডাকা হয়। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে সকলের মনোরঞ্জন করে। এর বিনিময়ে তারা দান হিসেবে যা কিছু পায় তা দিয়ে হয় পূজা। পূজার দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ কিছু ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে শিবপ্রণাম করে। এছাড়া, দেবতার প্রতি তাদের অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের করার জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা’দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন।

এগুলি যথাক্রমে ‘বঁটি-ঝাঁপ’, ‘কাঁটা-ঝাপ’ ও ‘ঝুল-ঝাঁপ’ নামে পরিচিত হয়ে আছে । নিজেকে অরো অধিক নির্যাতন দিতে ও শিবের আশীর্বাদ পেতে তারা আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেয় যার নাম ‘বাণ-সন্ন্যাস’। নিজেদের পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেয় তারা – অার তা হল ‘বেত্র-সন্ন্যাস’।

আর সবশেষে চড়ক গাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করে তারা এবং এর একপ্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপরপ্রান্তে কাঠের টুকরোটি চক্রাকারে চরকির মত ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘বড়শি সন্ন্যাস’।

এই সকল স্বনির্বাবিত বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তারা অতিক্রম করে ভগবান শিবের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য।

পরিশিষ্ট

সময় এগিয়েছে অনেকটা আর তারই সাথে সাথে হয়েছে প্রযুক্তির উন্নতি , কিন্তু সময়ের স্রোতে যতই আধুনিক হয়ে যাক না সমাজ…চৈত্র সংক্রান্তি র পুরোনো সেই রীতিনীতি কে এখনো মানুষ ভুলতে পারেনি; পুরনোকে ছুঁড়ে ফেলতে দিতে পারেনি তারা। ..গ্রামবাংলার মানুষেরা সেই ঐতিহ্যকে আজও বহন করে চলেছে বুকে লালন করে । তাই তো আজও গ্রাম বাংলায় গাজন ও চড়ক আছে ঠিক তাদের নিজের মতো করে!

Recent Posts