মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার, Evils of Drug addiction and its Remedy in Bengali


ভূমিকা, Introduction 

“বাবা, গাঁজা, আফিম নিয়ে সবাই থাকে ব্যস্ত,

সিগারেটের টানে তারা সর্বদা অভ্যস্ত।

মদকে খাচ্ছে তারা মনে করে জল

আদর্শ সমাজ নষ্ট করতে, বাঁধছে তারা দল।”

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার

মাদকাসক্তি আজকের সময়ে আমাদের সমাজের ভয়াবহ এক সমস্যা। অবশ্য একে সমস্যা না বলে বরং একে সংকট বলাই শ্রেয় হবে; কারণ নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি মানুষ নিজেকে মাদকের সঙ্গে ক্রমশ জড়িয়ে ফেলে। মাদক গ্রহণ করার প্রবণতা আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায়।

একটি জাতির উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল করার কাজে তরুণ সমাজের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আজ ভয়ংকরী মাদক সমাজের তরুণদের মন থেকে সেই অদম্য কর্মপ্রেরণাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এর ফলে সে কখন যে নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তার হয়তো নিজেরও ধারণা নেই, পাশাপাশি নিজ দেশকেও মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। এসব কারণেই আজকের তরুণরা হয়ে উঠছে দেশের সবচেয়ে বিপথগামী সম্প্রদায়।

মাদক নেশার প্রাচীনকাল, Antiquity of drug addiction

মাদক ও এর নেশার ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও তার একটা সীমারেখা ছিল । মদ, গাঁজা, আফিম, চরস বা তামাকের কথা বহু আগে থেকেই মানবসমাজে প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে মাদকের ব্যবহার শুরু হয় যাকে ইংরেজিতে ড্রাগ বলা হয়েছে।

মাদক নেশার প্রাচীনকাল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈনিকদের ব্যথার উপশম হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার হলেও হতাশা কাটাতেও তারা ড্রাগ ব্যবহার করত। এরপর থেকেই কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি দেশে নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ড্রাগের ব্যবহার শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার, Best article on Environmental pollution and its remedies

মাদকাসক্তি বলতে কি বোঝায়?  What does drug addiction mean?

আসক্তি বিশেষত দুই প্রকারের হয়। একটি হল কার্যমূলক আসক্তি, অন্যটি দ্রব্যমূলক আসক্তি। মাদকাসক্তিকে দ্রব্যমূলক আসক্তি হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন বহু ভেষজ তথা রাসায়নিক দ্রব্য যা শরীরের উপর প্রয়োগ করলে মস্তিষ্ক থেকে বিভিন্ন হরমোন ক্ষরণের মধ্য দিয়ে আনন্দের অনুভূতি লাভ করা যায়, একেই বলে হয় মাদকাসক্তি।

মাদকাসক্তি বলতে কি বোঝায়?

বিভিন্ন দ্রব্য যা শরীরে ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রবেশ করানোর ফলে এক অতিপ্রাকৃতিক আনন্দ বোধ হয় তথা শরীরে এর আসক্তি জন্মায় সেই সব দ্রব্যগুলিকেই বলে মাদকদ্রব্য। এইসকল মাদকদ্রব্য গ্রহণ করার ফলে আমাদের অজান্তেই শরীর এবং মনের মধ্যে এক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এরূপ পরিবর্তন ওই বিশেষ দ্রব্যটির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা এবং দ্রব্যটি গ্রহণের চাহিদা ক্রমাগত বাড়িতে তোলে, এভাবেই মানুষ ক্রমশ মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ে।

বিরাট কোহলি, ভারতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-এর নক্ষত্র, Biography of famous Indian cricketer, Virat Kohli in Bengali

মাদকের প্রকারভেদ, Types of drugs

আমাদের আজকের বিশ্বের প্রায় সকল দেশের মধ্যেই মাদকদ্রব্য অনায়াসে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন- হেরােইন, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মারিজুয়ানা, হাসিস, ইত্যাদি হল আধুনিককালীন মাদকদ্রব্য; কিন্তু এগুলোর মধ্যে হেরােইন এবং কোকেন খুব বেশ দামি হয়। দেশের তরুণসমাজ সাধারণত যে সব মাদকদ্রব্যগুলাে ব্যবহার করে থাকে, সেগুলাে হল— গাঁজা, ইনােকটিন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল, সিডাকসিন, ডেক্সপােটেন ইত্যাদি। তবে বর্তমান সময়ে এই সবকিছুর ব্যবহারকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ চাহিদায় রয়েছে অত্যাধুনিক এক মাদক, যায় নাম হল ইয়াবা’। তাই কবি লিখেছেন –

মাদকের প্রকারভেদ

” ছাত্র যুবক মাদক জালে

দিচ্ছে টাকা হাতে তুলে

ইয়াবার নেশাই মত্ত হলে

দেশ চালাবে কোন সে ছেলে।

একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]  

মাদকদ্রব্যের বিচরণ, Drug trafficking

মাদকদ্রব্য ব্যবহার মানুষকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলে। মাদক ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ব্যক্তি যেন কিছুসময়ের জন্য এক কল্পনার জগতে বিচরণ করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে এই মাদক ব্যবহারকারীরা ভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে, যেমন— ইনহেল বা শ্বাসের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, ধূমপান, জিহ্বার নিচে মাদক দিয়ে তৈরি বড়ি রাখার মাধ্যমে, সরাসরি মাদক সেবনের মাধ্যমে, আবার কখনও স্কিন পপিং এবং ভেইন-এর সাহায্যে।

মাদকদ্রব্যের বিচরণ

কিন্তু এই মাদক যেভাবেই গ্রহণ করা হোক না কেন এর পেছনে উদ্দেশ্য একটাই থাকে, তা হল— নেশায় উন্মত্ত হয়ে পড়া। প্রথম দিকে কৌতূহলের বশে অনেক ব্যক্তিই নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতে উৎসুক হন, তবে ধীরে ধীরে তা নিয়ে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্রমে ভয়াবহ এক সর্বনাশের পথে এগিয়ে যান।

মাদকাসক্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণ, Various causes of drug addiction

সাধারণত মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যক্তিজীবনের হতাশাকেই ধরা হয়। কোনো ব্যক্তি যখন নিজের জীবনে বিভিন্ন কারণবশত হতাশ হয়ে পড়ে, তখন মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নেয় সে।

মাদকাসক্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণ

এরূপ হতাশা সাধারণত তরুণদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তাই তাদের মধ্যেই মাদকাশক্তির হার বেশি থাকে। তবে অনেক সময় অসৎসঙ্গে পরেও অনেকে মাদক গ্রহণের দিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু পরিবারে অনেক বেশি পরিমাণে পারিবারিক অশান্তি দেখা যায়, সেই পরিবারগুলোতে থাকা ছেলেমেয়েদের জীবনই বিশৃঙ্খল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। তারা ক্রমে এইরূপ বিশৃঙ্খলা থেকে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং এর পরিণাম হিসেবে বহু ঘটনা ঘটায়, যা আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই।

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

সমাজে মাদকের ছোবল, Drug addiction in society

সমাজের যেকোনো ব্যক্তি যদি মাদক দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে সেই সমাজও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে সমানভাবেই প্রভাবিত হয়। এক্ষেত্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তিটির পরিবারের লোকজন সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কারণ মাদকের প্রভাবে সেই মাদকাসক্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয়, এর দরুন পরিবারে নেমে আসে অশান্তির মেঘ।

অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে, মাদকের দ্বারা আসক্ত ব্যক্তি মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করার উদ্দেশ্যে চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতির মতো বিভিন্ন অসাধু কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। 

সমাজে মাদকের ছোবল

মাদকাসক্তির ভয়ংকর প্রভাব, Terrible effects of drug addiction

মাদকের প্রভাব নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং আগ্রাসী। ইয়াবা এবং হেরােইনের মতাে মাদকদ্রব্যগুলো মানব দেহের সমস্ত রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতাকে ধীর গতিতে বিনষ্ট করে দেয়। নেশার আসক্তিতে মানুষ যেন এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করে। কোনো ব্যক্তি একবার নেশায় আক্রান্ত হয়ে গেলে তার সুস্থজীবনে ফিরে আসা তেমন সহজ হয় না।

হঠাৎ মাদক বন্ধ করে দেওয়ার পরই ‘উইথড্রয়াল সিমটম’ শুরু হয়ে যায়, তখন যদি সেই ব্যক্তি মাদক না পায় তবে শুরু হয় ‘টার্কি পিরিয়ড’; এসময় সেই ব্যক্তির হাত-পা অনবরত কাঁপতে থাকে পাশাপাশি অসম্ভবভাবে শারীরিক যন্ত্রণা বোধ হয় এবং একপর্যায়ে গিয়ে এসবকিছু তার হৃদপিণ্ডে আঘাত করে। এরূপ সময়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিটি যদি সুচিকিৎসা না পায় তবে খুব অল্প সময়ে তার মৃত্যুও হতে পারে।

মাদকাসক্তির ভয়ংকর প্রভাব

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

মাদকাসক্তির প্রতিকার, Drug addiction cure

“জাগো আজ ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী

 যুব সমাজও হও যুক্ত,

রুখে দাও মাদকের অবাধ বিচরণ

 দেশ করিতে মাদক মুক্ত।” 

মাদকাসক্তির প্রতিকার

পারিবারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় সচেতনার অবশ্য দিয়েই মানুষকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলো নানাভাবে মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে পারে। অন্যদিকে সরকারিভাবে মাদকদ্রব্য বিক্রি এবং এর সাথে নিয়ােজিত সকল চোরাকারবারীদের উদ্দেশ্যে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা এই সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করা উচিত। সকলে মিলে একজোট হয়ে বিরোধিতা করলে খুব সহজেই মাদকাসক্তির প্রতিকার করা সম্ভব হবে।

উপসংহার, Conclusion 

কোনো দেশের উন্নয়নের গতিশীলতাকে অব্যাহত রাখার চাবিকাঠি থাকে তরুণসমাজের হাতেই। সেক্ষেত্রে তারাই যদি মাদকের কবলে আটকা পড়ে যায় এবং নিজের অস্তিত্বকে নিজেই যদি হুমকির মুখে ঠেলে দেয় তবে দেশের অগ্রগতি বিনষ্ট হবে। এজন্যই তরুণ সমাজকে মাদক আসক্তির ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং নেশা সামগ্রিক বয়কট করতে হবে। এই সচেতনতা সৃষ্টির দিকে ঐক্য এবং সুস্থজীবনের শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমেই যেকোনো দেশ মাদকমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

Recent Posts