ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম শহর তথা রাজধানী কলকাতা হুগলি নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। সুচেতনা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন,“কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;” -সত্যিই বর্তমান শতকে পৌঁছে কল্লোলিনী তিলোত্তমাই হয়ে উঠেছে পরাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতা।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ প্রিয়; দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল দেখার জন্য ছুটে বেড়াই। কিন্তু নিজের দেশেরই কোনও ঐতিহাসিক শহরে যদি এক সঙ্গে এই সবকিছুর স্বাদ পাওয়া যায়! তাহলে তো দারুন হয়, তাইনা? এমনই একটি শহর হল কলকাতা। আবেগের ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’। এই শহরের সাথে যেমন ইতিহাসের ছোঁয়া লেগে আছে তেমনি আধুনিকতার দিক থেকেও বড় বড় শহরগুলো থেকে কম নয় কলকাতা।
কলকাতার কিছু ঐতিহাসিক বিশেষত্ব, Historical significance of Kolkata
দেশের স্বাধীনতার পর কলকাতা শহরটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসন আমলে এই কলকাতাই আধুনিক ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান চর্চা তথা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
কলকাতার অপার সৌন্দর্য সম্পর্কে বলে হয়তো শেষ করা যাবেনা, যারা এই শহরে থাকেন বা শহরটি একবার হলেও ঘুরে এসেছেন তারা এ বিষয়ে অবগত থাকবেন। আবার এমনটাও হয় যে সামাজিক মাধ্যমে বা অনলাইনে কলকাতার বিভিন্ন ছবি দেখলে অনেকেরই ইচ্ছে হয় এই শহর পরিদর্শন করার।
তিলোত্তমা কলকাতার সৌন্দর্যের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মন কেমন করা ভাস্কর্য, বলতে গেলে স্থাপত্যের নমুনা যেন চারিপাশে ছড়িয়ে রয়েছে, আর এসবের পাশাপাশি আছে বাংলার সংস্কৃতি এবং বন্ধুবৎসল অচেনা লোককেও আপন করে নেওয়া মানুষজন। আমাদের সকলের প্রিয় তিলোত্তমা কলকাতার কয়েকটি জানা অজানা বিশেষত্ব সম্পর্কে কিছু কথা:
আজব সব তথ্য বাংলা তে ~ 100 Mind-Blowing Facts in Bengali | সেরা বাংলা ফ্যাক্ট গুলি
● কলকাতায় ভারতের প্রথম মেট্রো রেল : ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ ভারত স্বাধীন হয়, এরপর ভারতের প্রথম মেট্রো রেল ১৯৮৪ সালে চলাচল শুরু করেছিল কলকাতা শহরেই।
● কলকাতা স্টেশন : কলকাতার বুকে ২০০৬ সাল অবধি স্থায়ী কোনোও স্টেশন ছিলনা। সব কাজ হত হাওড়া এবং সিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে। কলকাতার বুকে একটি নতুন স্টেশন গড়া হয়েছে। নাম হল, কলকাতা স্টেশন।
● নদী বন্দর : কলকাতার হুগলী নদীর বন্দরটি হল দেশের প্রাচীনতম বন্দর, তথা ভারতের প্রধান নদী বন্দর।
● ট্রাম লাইন : এশিয়া মহাদেশের প্রাচীনতম ট্রাম চলাচল ব্যবস্থাটি এই তিলোত্তমা কলকাতায় অবস্থিত।
● হাতে টানা রিক্সা : কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য হল এই হাতে টানা রিক্সা। কলকাতায় যাতায়াতের সুবিধার্থে মেট্রো, ট্রাম, ট্যাক্সি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার যানবাহন থাকা সত্বেও শহরের কিছু কিছু অংশে এখনও ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত ক্লান্তীকর হাতে টানা রিক্সাগুলো দেখা যায়, যা আপনি হয়তো দেশের অন্য আর কোনো স্থানেই দেখতে পাবেন না।
● নদীর জলের নিচে মেট্রো চলাচল : কলকাতার হুগলী নদীর জলের নিচে মেট্রো চলাচলের জন্য সুড়ঙ্গ করা হয়েছে, অর্থাৎ সারা দেশের মধ্যে কলকাতাই হল ভারতের প্রথম শহর, যেখানে কোনো নদীর জলের নীচে মেট্রো রেল চলাচল করবে; শহর কলকাতার এই বিশেষত্ব পরবর্তীতে নতুন ইতিহাস গড়ে তুলবে। হাওড়া নদী থেকে হুগলী নদীর ৩০ মিটার নীচে কলকাতার সাথে যুক্ত করা হবে মেট্রো রেলের লাইন। এই লাইনের সাথে শেষ পর্যন্ত হাওড়া স্টেশন এবং শিয়ালদা স্টেশনকে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জেনে নিন দুর্গাপূজা নিয়ে অজানা সব তথ্য – Unknown Facts About Durga Puja in Bengali
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানসমূহ, important places to visit in Kolkata
কারও যদি তিলোত্তমা কলকাতা ভালভাবে ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকে তবে তাকে কম করেও তিন থেকে চার দিন হাতে রাখতে হবে। এই শহর থেকে কয়েক ঘন্টার দূরত্বের দীঘা সমুদ্র সৈকত রয়েছে। একটা মজার দিন কাটাতে হলে খুব সহজেই সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
দীঘা থেকে ফেরার পথে গোসাবা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন করে আসতে পারেন; অথবা, চলে যেতে পারেন গঙ্গাসাগরের দিকে, সেখানে দেখার জন্য আছে কপিলমুনির আশ্রম। এসব ঘুরে মন না ভরলে এক ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন বকখালির সৈকতেও। এভাবেই শহরটির বুকে ডানা মেলে দিয়ে কলকাতার সৌন্দর্য্যকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারেন।
শহরটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বহু মন্দির, বিনোদন পার্ক সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান; যেমন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, বিড়লা মন্দির, আদ্যপীঠ মন্দির, তারাপীঠ, ঢাকুরিয়া লেক, নাখোদা মসজিদ, শোভাবাজার রাজবাড়ী, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, সাবর্ণ সংগ্রহশালা, বিনোদন পার্ক হিসেবে রয়েছে সাইন্স সিটি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নিকো পার্ক, ইকোপার্ক, প্রিন্সেপ ঘাট, মিলেনিয়াম পার্ক, টাউন হল ইত্যাদি।
এসব ছাড়াও ঘুরে আসুন হাওড়া জেলার “বোটানিক্যাল গার্ডেন”-এ। এই গার্ডেনটি রবার্ট কিড ১৭৮৭ সালে তৈরী করেছিলেন। ভ্রমণের সুবিধার্থে কলকাতাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিতে পারেন; যেমন- উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ ও শহরতলী।
IMPS এবং NEFT সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, Detailed information about IMPS and NEFT in Bengali
● উত্তর কলকাতা – এই দিকে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে শ্যামবাজার, শোভাবাজার, কাশীপুর, সিঁথি, চিৎপুর, বরানগর এবং দমদম; এই জায়গাগুলো সাধারনত উত্তর কলকাতার মধ্যেই পড়ে।
● মধ্য কলকাতা – শহরের এই দিকটায় পার্ক স্ট্রীট, বিবাদী বাগ, চাঁদনী চৌক, এসপ্ল্যানেড, ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট বা মির্জা-গালিব স্ট্রীট, ডালহৌসি স্কোয়্যার, বড় বাজার এবং সদর স্ট্রীট ঘুরে দেখা যায়। তবে এই মধ্য কলকাতা অংশটি মূলত শহরের কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক জেলা হিসাবে সুপরিচিত।
● দক্ষিণ কলকাতা – শহরের এই দিকে রয়েছে আলিপুর, টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ, নিউ আলিপুর, ল্যান্সডাউন, ভবানীপুর, যোধপুর পার্ক, লেক গার্ডেন্স, যাদবপুর, গল্ফগ্রীন ও কসবা ইত্যাদি।
● শহরতলীয় অঞ্চল – তিলোত্তমা কলকাতার শহরতলীয় অঞ্চলের মধ্যে আছে- বেহালা, গড়িয়া, কূদঘাট, গার্ডেন রীচ, ঠাকুরপুকুর, রাণীকুঠি, বাঁশদ্রোণী এবং বাঘাযতীন।
কলকাতার সৃষ্টি ও নামকরণের ইতিহাস, History of creation and naming of Kolkata
সপ্তদশ শতকের ইংরেজ ব্যবসায়ী জব চার্নক, ১৬৮৬-৯০ সালের ইঙ্গ-মুগল যুদ্ধের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি বসতির প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জব চার্নককে ঔপনিবেশিক ইতিহাসকারগণ তাঁকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৬৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
এরপর তাঁকে সেন্ট জন দিসিসন্স চার্চে সমাধীস্থ করা হয়েছিল। তবে কলকাতার নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে। কয়েকটি সূত্র অনুযায়ী “কলিকাতা” বা “কলকাতা” নামটির উৎপত্তির উৎস নিম্নরূপ-
1. সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা এবং গোবিন্দপুর নামক তিন গ্রাম সংযুক্ত করে কলকাতা শহরটি গড়ে উঠেছিল। এই নামগুলোর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নাম থেকেই কলকাতা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
2. কারও মতে, “কালীক্ষেত্র” নামটি থেকেই “কলিকাতা” বা “কলকাতা” নামটির উৎপত্তি হয়েছে।
3. অনেকে ভাবেন যে বাংলা “কিলকিলা” কথাটি থেকে “কলিকাতা” নামটির উৎপত্তি হয়, যায় অর্থ চ্যাপ্টা এলাকা।
4. অন্য একজনের মতে বাংলা খাল এবং কাটা এই শব্দ দু’টির বিকৃতি ঘটার ফলে কলকাতা নামের উৎপত্তি হয়েছে।
5. অনেকে আবার মনে করেন যে, এই অঞ্চলটিতে কলিচুন এবং কাতা অর্থাৎ নারকেলের ছোবড়ার আঁশ ভালো উৎপাদন করা হতো। সেই সুবাদে কলিকাতা নামটির উদ্ভব হয়।
কলকাতার সংস্কৃতি, Culture of Kolkata
কলকাতার সাথে বহু প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। বিশেষত বাঙালিয়ানা কলকাতার আনাচে কানাচে ভরে আছে। কলকাতা হল বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। এই শহরে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব জীবনযাপন করেছেন। এই শহরের মাধুর্যে থেকেই সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র সহ শিল্পকলা তথা বিজ্ঞান এবং অন্যান্য আরো বহু ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হতে পেরেছেন কলকাতা বাসীরা।
এই শহরেরই কয়েকজন নোবেল পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন, যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল বিজয়ী, সত্যজিৎ রায় ৭ম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন, প্রমুখ। অন্যদিকে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই শহরের বুকে বেশ কয়েকটি জাতীয় গ্রন্থাগার তথা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
প্যারিসকে যেমন শিল্প ও শিল্পীর শহর বলে অভিহিত করা হয়, তেমনই কলকাতা হল কবিতার শহর, সঙ্গীতের শহর তথা সংস্কৃতি ও নাটকের শহর। এই শহর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শহর, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালির শহর। কল্লোলিনী কলকাতা তাই তো নিজের ঐশ্বর্যের রং ছড়িয়ে দিতে সকলকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। কলকাতার ব্যাপারে যত বলা যায় ততই কম মনে হয়, তাই কবি বলেছেন –
“কলকাতার সৌন্দর্য বলতে আরকি অবশিষ্ট রইল, সেটা ভাবতে বসলেই খুব হতাশ হতে হয়।”
- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী সমূহ | Swami Vivekananda biography and Quotes in Bangla
- হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী ~ Biography of Humayun Ahmed in Bengali
- বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay
উপসংহার, Conclusion
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরটি ছিল পূর্ব ভারতের শিক্ষা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র।
আজকের কলকাতা উন্নতির দিক থেকে ভারতের অন্যতম উন্নতমানের একটি শহর। রাজনীতি হোক কিংবা অর্থনীতি, এমনকি শিক্ষার দিক থেকেও অনেকটা এগিয়ে আছে এই অঞ্চলের জনগন।