মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি তথা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং সুদক্ষ কূটনীতিক ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। কর্মদক্ষতার দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে আজও সবার শীর্ষে স্থান করে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট, সংক্ষেপে এফডিআর নামেই জনসাধারণের মধ্যে পরিচিত ছিলেন। আমেরিকা তথা বিশ্বের দীর্ঘতম সময়ব্যাপী ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েছিলেন ফ্রাংকলিন ডিলান্ডো রুজভেল্ট।
ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট এর শৈশব ও শিক্ষা, Childhood and Education of Franklin Roosevelt
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৮২ সালের ৩০ জানুয়ারী জন্ম গ্রহণ করেন। নিউইর্য়কের হাইড পার্কের হাডসন ভ্যালি শহরে জন্ম হয় তাঁর। ফ্রাঙ্কলিনের পিতা, জেমস রুজভেল্ট ছিলেন একজন বিশিষ্ট ডেমক্রাট সদস্য। ছোটবেলা থেকেই তিনি ফ্রাঙ্কলিন কে White House এর প্রেসিডেন্টদের সাথে দেখা করিয়েছিলেন।
ফ্রাঙ্কলিনের জীবনের প্রাথমিক সময় থেকেই মা সারার প্রভাব তাঁর উপরে অনেক বেশি ছিল। তাঁর মায়ের পদবী ছিল ডিলান এবং বাবার পদবী ছিল রুসভেল্ট, এর সমন্বয়ে ফ্রাঙ্কলিন এর নাম হয় “ফ্রাঙ্কলিন ডিলান রুসভেল্ট ”। যদিও পরবর্তীতে সংক্ষেপে এটি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট হিসেবে পরিচিতি পায়। ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট একজন ধনী পরিবারে বেড়ে উঠে ছিলেন। তিনি নিজের বাবা-মার সঙ্গে প্রায়ই বিদেশে ভ্রমণ করতেন। শৈশবেই অনেক বিদেশ ভ্রমণ করার প্রভাবে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি জার্মান, ফরাসি, সহ বেশ কিছু ভাষা শিখে যান।
জন এফ. কেনেডির জীবনী, Best Biography of John F. Kennedy in Bengali
ফ্রাঙ্কলিনের শিক্ষাজীবন, Franklin’s educational career
ফ্রাঙ্কলিন নয় বছর বয়সকালে জার্মানির পাবলিক স্কুলে কিছু সময়ের জন্য ভর্তি হন। পরে ১৪ বছর বয়স অবধি তিনি বাড়িতে নিজের গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর তাঁকে ম্যাসাচুসেটসের গ্রোটনে অবস্থিত বিশপের অধিকারভুক্ত বোর্ডিং স্কুল গ্রোটন-এ ভর্তি করা হয়েছিল। যদিও তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের খুব জনপ্রিয় ছাত্র ছিলেন না।
খেলাধুলা করতেন, তবে তাতেও খুব ভাল ছিলেন না তিনি। এরপর অন্য বেশ কিছু স্কুল সহপাঠীর মত তিনিও উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য হার্ভার্ড কলেজে ভর্তি হন। সেখানে থাকাকালীন তিনি আলফা ডেল্টা ফি ও ফ্লাই ক্লাবের সদস্য ছিলেন। হার্ভার্ড কলেজে পড়াকালীন সময়েও তিনি সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি কলেজে চার বছরের জন্য অর্থনীতি পাঠ্যক্রম নিয়েছি এবং আমায় যা কিছু শেখানো হয়েছিল তা ভুল ছিল।”
হার্ভার্ড কলেজ থেকে ১৯০৩ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ১৯০৪ সালে কলম্বিয়া ল স্কুলে ভর্তি হন। যদিও আইন অধ্যয়নের জন্য খুব বেশি আগ্রহ ছিল না তাঁর। পড়ে ১৯০৭ সালে নিউইয়র্ক বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলম্বিয়া ল স্কুল পরিত্যাগ করেন ফ্রাঙ্কলিন। এর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯০৮ সালে কার্টার লেডইয়ার্ড অ্যান্ড মিলবার্নের মর্যাদাপূর্ণ এক আইন সংস্থায় যোগ দেন তিনি। সেই ফার্মের অ্যাডমিরালটি আইন বিভাগে কাজ করতেন তিনি।
রোনাল্ড উইলসন রেগনের জীবনী, Best Biography of President Ronald Reagan in Bengali
রুজভেল্ট এর রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেকার কর্মজীবন, Career before becoming President
ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট ১৯০৭ সালে বারে ভর্তি হন। নিউ ইয়র্ক স্টেট সিনেটের কাজে যোগ দেওয়ার পূর্বে তিনি বেশ কিছুদিন আইন অনুশীলন করেছিলেন। এরপর ১৯১৩ সালে তিনি নৌবাহিনীর সহকারী সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সালের নিউ ইয়র্কের গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন।
তিনি আফ্রিকান, আমেরিকান, ক্যাথলিক এবং ইহুদিদের নতুন ভোটার জোটের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি চীনা-আমেরিকান এবং ফিলিপিনো-আমেরিকানদের থেকেও শক্তিশালী সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলেন।
রুজভেল্ট এর রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদমর্যাদা, Designation as President
আইনের অনুশীলন করতে রুজভেল্টের একেবারেই ভাল লাগত না। তখন রাজনীতি তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো। অবশেষে রুজভেল্টও নিজের বাবার মতই ডেমোক্রেটিক দলে যোগদান করেছিলেন। এরপর এই দলের প্রতিনিধি হিসেবে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল।
ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা পরবর্তীতে আমেরিকা এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপের জন্য চিহ্নিত হয়েছিল। তাঁর আক্রমনাত্মক এবং অভূতপূর্ব নিউ ডিএল প্রোগ্রামের প্রভাবে ফেডারেল সরকার শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং রাজ্যের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে সংরক্ষিত করে রাখা প্রোগ্রামগুলির সাথে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯২০ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে হেরে যান তিনি।
পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর প্রথম প্রবেশ ঘটেছিল ১৯৩৩ সালের ৪ মার্চ। আমেরিকার ৩২ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন তিনি। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন। তবে ১৯৪৫ সালে উক্ত দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পরও দেশের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। এমনকি জাতিসংঘ সৃষ্টিতেও তাঁর বিশেষ অবদান রেখে গেছেন।
বিল গেটস এর জীবনী, Best ever biography of Bill Gates in Bengali
রুজভেল্ট এর বৈবাহিক সম্পর্ক, Marital relationship
মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কলিন নিজের পছন্দের মেয়ে এলিনূরকে বিয়ে করেন। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে মানবাধিকার বিষয়ে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন এলিনূর। এরূপ কর্মের সম্মানার্থে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান তাঁকে বিশ্বের ফার্স্ট লেডিরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪৫ সালে স্বামীর মৃত্যু হওয়ার পর এলিনূর একজন লেখকরূপে আবির্ভূত হন, অন্যদিকে তিনি মানবাধিকার বিষয়ে মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
রুজভেল্ট এর শারীরিক অসুস্থতা, physical illness
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট সব ক্ষেত্রেই সচেতন ছিলেন। তিনি সবাইকে তাঁর হুইলচেয়ার জনসমক্ষে ব্যবহার না করার জন্য বলতেন। তিনি কখনোই প্রেসের সামনে এমন কোনও চিত্র যেন তুলে ধরতে চান নি যাতে তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ পায়। ১৯২১ সালের আগস্ট মাসে রুজভেল্ট ক্যাম্পোবেলো দ্বীপে অবকাশ জ্ঞাপনের জন্য যান।
কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হঠাৎ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর দেহের বিভিন্ন অর্গানগুলো অকেজ হয়ে পড়েছিল। রুজভেল্ট এর কোমর থেকে নিচের দিকের অংশ স্থায়ীভাবে অচল হয়ে পড়ে। এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে জনসাধারণের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন, তবে সহায়ক হিসেবে ছেলেকে সবসময় পাশে রাখতেন। এসব থেকে বোঝা যায় যে তিনি এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন, যার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কখনই তিনি নিজের কাজে বা নীতিতে কোনও রকমের দুর্বলতা প্রকাশ করেননি।
রুজভেল্ট এর জীবনাবসান, Death
১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল, বিকেলের দিকে রুজভেল্ট বলেন, “আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে।” এর পরের মুহূর্তেই তিনি বসার জন্য চেয়ারের দিকে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সেই দিন বিকাল ৩:৩৫ মিনিটে , ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট মৃত্যু বরণ করেন। প্রয়ানকালে তার বয়স ছিল মাত্র ৬৩ বছর। রুজভেল্টের মৃত্যুর পর জাতীয় শোক পালন করার উদ্দেশ্যে ৩০ দিন ধরে আমেরিকার পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় রাখা হয়। তাঁকে স্প্রিং উড এস্টেটের রোজ গার্ডেনে সমাহিত করা হয়েছিল।
রুজভেল্ট এর জীবনী রচয়িতা, Roosevelt biographer
২০০৭ সালে জন এডওয়ার্ড স্মিথ ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এর জীবনী লিখেছিলেন। যেখানে স্মিথ বলেছিলেন যে, “তিনি জাতিকে উন্নতির শিখরে উঠানোর জন্য হুইলচেয়ার থেকে নিজেকে তুলেছিলেন।” উক্ত জীবনীর মাধ্যমে এই মহান ব্যক্তির জীবনাবসানের পাশাপাশি জনসম্মুখে তাঁর সকল প্রকার অর্জন সম্পর্কে আরও বেশি প্রকাশ পায়, যার প্রভাবে আমেরিকার ইতিহাসে একজন প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি আজও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন।
- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী সমূহ | Swami Vivekananda biography and Quotes in Bangla
- হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী ~ Biography of Humayun Ahmed in Bengali
- বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay
উপসংহার, Conclusion
অনেক আফ্রিকান, আমেরিকান, ক্যাথলিক এবং ইহুদিরা রুজভেল্টকে তাদের নায়ক হিসাবে গণ্য করতেন। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে ধরা হয়। এর পাশাপাশি তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
FAQ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি তথা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং সুদক্ষ কূটনীতিক হলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট।
১৯৮২ সালের ৩০ জানুয়ারী।
১৯৩৩ সালে।
১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল।