তুলসী চক্রবর্তীর জীবনী, Best Biography of Tulsi Chakraborty in Bengali



বাংলা সিনেমার ১৯৪০ এবং ১৯৫০ দশকের এক স্বনামধন্য অভিনেতা ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। সিনেমা জগতে প্রধানত কমিক ভূমিকায় তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর অভিনীত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “পরশপাথর” চলচ্চিত্রের মুখ্য অভিনেতা হিসাবে। নিজের অভিনয়ের জোরে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত ১১টি সিনেমা মুক্তি পায় এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ১৩টি। মাত্র ২ বছরের মধ্যে ২৪ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি!

তুলসী চক্রবর্তীর জীবনী

অভিনেতার বাল্যকাল ও পরিবার পরিচয়, Childhood and family identity

তুলসী চক্রবর্তী ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ অবিভক্ত বাংলায় গোয়ারি নামক এক ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আশুতোষ চক্রবর্তী, যিনি পেশায় ভারতীয় রেল-এর কর্মী ছিলেন। পিতার চাকরির সুবাদে বাল্যকাল থেকে অবিভক্ত বাংলায় বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। তবে ছোটবেলাতেই তিনি পিতৃহারা হয়ে যান, এরপর মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কাকা প্ৰসাদ চক্রবর্তীর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে পড়েন তুলসী চক্রবর্তী।

চরম অর্থকষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কম বয়সেই কলকাতা শহরে বিভিন্ন কাজ খোঁজা শুরু করেন তুলসী চক্রবর্তী, তাই আর পুঁথিগত শিক্ষালাভ তাঁর খুব বেশী হয়ে ওঠে নি। তরুণ বয়স থেকেই তিনি কলকাতায় নিজের কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছেও থেকেছেন। কাকা প্রসাদ চক্রবর্তী পেশাগত দিক থেকে প্রখ্যাত স্টার থিয়েটার-এর একজন বিশিষ্ট তবলা ও হারমোনিয়াম বাদক ছিলেন। এই কাকার যোগাযোগেই তুলসী চক্রবর্তী নিজের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন। সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি অভিনয় ও সঙ্গীতে যোগদান করার অনুপ্রেরণা পান।

অভিনেতার বাল্যকাল ও পরিবার পরিচয়

তিনি সর্বদাই কাঁধে একটি উপবীত ও একটি সাদা ধুতি পরিধান করতেন, এছাড়াও তিনি চিরকাল ট্রামে-বাসে যাতায়াত করে স্টুডিওতে পৌঁছতেন। গরমকালেও পরনের জামা বা ফতুয়া নিজের কাঁধে ফেলে ট্রামের জানালার ধারে বসে শহর কলকাতায় সফর করেছেন তিনি। এককথায় খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করতেন তুলসী চক্রবর্তী।

বুদ্ধদেব বসুর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম, Best biography of Buddhadeb Basu in Bengali 

অভিনেতার কর্মজীবন, Actor’s Career

কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে থাকাকালীন তুলসী চক্রবর্তী থিয়েটারে কাজ করেছিলেন। দুর্গেশনন্দিনী নাটকে ১৯২০ সালে প্রথম মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। এরপর থেকে টানা দীর্ঘ সাত বছর তিনি স্টার থিয়েটারের সাথে যুক্ত থাকেন। পরে ১৯২৭ সালে যোগ দেন মনমোহন থিয়েটারে। এরপর তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম সিনেমা “পুনর্জন্ম” মুক্তি পায় ১৯৩২ সালে।

পরবর্তীতে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামক চলচ্চিত্রে একটি লজিং-এর ম্যানেজার হিসাবে তুলসী চক্রবর্তী  অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখেন। এই চরিত্র থেকে বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। তাছাড়াও পথের পাঁচালীতে এক পাঠশালার গুরুমশাই হিসাবে ছোট্ট একটি ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তুলসী চক্রবর্তী-কে। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে, তুলসী চক্রবর্তী যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করতেন তবে তাঁকে অভিনয় দক্ষতার জন্য হয়তো অস্কার পুরস্কারও প্রদান করা হত।

অভিনয়ের দিক থেকে বলতে গেলে বাংলা সিনেমার ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদি বিশিষ্ট ৫ জন অভিনেতার নাম বাছাই করতে হয়, তবে তুলসি চক্রবর্তী অনায়াসে সে তালিকায় জায়গা পেয়ে যাবেন। তাঁর অভিনয়ের যেন সবটাই ছিল প্রাকৃতিক, কোনও খাদ ছিল না। কখনো উচ্চকিত স্বরে গলা কাঁপিয়ে ডায়ালগ বলেন নি, কোনরকম ভাঁড়ামো নেই, না আছে ন্যাকামো, কোনও ছদ্ম গাম্ভীর্য নেই, আছে শুধু চোখ দু’টি। তাঁর চোখগুলো যেন সর্বক্ষণ কথা বলে যেত।

অভিনেতার কর্মজীবন

তিনি নিজের বড় বড় বিষ্ময়ভরা ধারালো চোখ দিয়ে যেন এক নিখুঁত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি কাউকে কখনও ফিরিয়ে দেন নি, যে যা চরিত্র নিয়ে তাঁর কাছে অভিনয় করার প্রস্তাব নিয়ে যেতেন তিনি সবেতেই সম্মতি দিতেন। তাছাড়া কখনও পারিশ্রমিক নিয়ে কোনো কথা মুখ ফুটে বলতেন না। কখনো পারিশ্রমিক দেওয়া না হলে তিনি খুঁজতেও যেতেন না। অনেকেই এমন ছিলেন যারা টাকা না দিয়েই তুলসী চক্রবর্তীকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতেন। তিনি কখনো অভিনয় জীবনে নিজের পারিশ্রমিক বাড়াননি। তিনি ভাবতেন, হয়তো যদি পারিশ্রমিক বাড়ালে তাঁর আর ডাক না আসে।

পরশপাথর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে সত্যজিৎ রায় যখন তুলসি চক্রবর্তীরর বাড়িতে যান। নায়ক হিসেবে যা পারিশ্রমিক হওয়া উচিত তা তিনি দেন নি তাও তুলসী বাবু সেই পারিশ্রমিকে রাজি হয়ে যান। অন্যদিকে শুটিং চলাকালীন বাড়ি থেকে স্টুডিও যাতায়াত করার সুবিধার জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু তিনি তখন সত্যজিৎ রায়কে বলেন, “না রে বাবা, আমার ট্রাই ভালো। গাড়িতে চেপে স্টুডিও এলে প্রযোজকরা ভাববে তুলসি বুঝি রেট বাড়িয়ে দিল। ওরা আর কাজে ডাকবে না আমায়।” 

পরশপাথর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে সত্যজিৎ রায় যখন তুলসি চক্রবর্তীরর বাড়িতে যান

বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, Best biography of Manik Bandopadhyay in Bengali 

তুলসী চক্রবর্তির অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা, List of films starring Tulsi Chakraborty

মায়ামৃগ (১৯৬০)

শুনো বরনারী (১৯৬০)

গলি থেকে রাজপথ (১৯৫৯)

পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট (১৯৫৯)

অযান্ত্রিক (১৯৫৮)

যৌতুক (১৯৫৮)

পরশপাথর (১৯৫৮)

রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮)

সোনার কাঠি (১৯৫৮)

চন্দ্রনাথ (১৯৫৭)

হরিশচন্দ্র (১৯৫৭)

পৃথিবী আমারে চায় (১৯৫৭)

একটি রাত (১৯৫৬)

শ্যামলী (১৯৫৬)

পথের পাঁচালী (চলচ্চিত্র) (১৯৫৫)

অপরাধী (১৯৫৫)

ভালোবাসা (১৯৫৫)

দুজনে (১৯৫৫)

কালিন্দি (১৯৫৫)

নিষিদ্ধ ফল (১৯৫৫)

উপহার (১৯৫৫)

চাঁপডাঙার বৌ (১৯৫৪)

যদুভট্ট (১৯৫৪)

জয়দেব (১৯৫৪)

নবীন যাত্রা (১৯৫৩)

সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)

দর্পচূর্ণ (১৯৫২)

মেঘমুক্তি (১৯৫২)

পন্ডিত মশাই (১৯৫১)

মানডন্ড (১৯৫০)

মেজদিদি (১৯৫০)

রূপকথা (১৯৫০)

শেষবেশ (১৯৫০)

বামুনের মেয়ে (১৯৪৯)

কবি (১৯৪৯)

বিরাজ বউ (১৯৪৬)

মন্দির (১৯৪৬)

প্রতিমা (১৯৪৬)

দুই পুরুষ (১৯৪৫)

শ্রী গৌরাঙ্গ (১৯৩৩)

দ্বীপ জ্বেলে যাই

তুলসী চক্রবর্তির অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা

ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life

তুলসী চক্রবর্তী জীবনে দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন উষারানী দেবীকে। কিন্তু সারাজীবন তাঁরা অর্থের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, যদিও হাওড়ার শিবপুরে একটি দোতলা বাড়ি কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাও সাংসারিক জীবন তেমন সুখের হয় নি তাদের। তুলসী চক্রবর্তী এবং স্ত্রী উষারানী নিঃসন্তান ছিলেন। এমনও কঠিন সময় গেছে যে দুমুঠো ভাত জোটাতে অর্থাভাবে কখনো পৌরহিত্য করেও দিন কাটিয়েছেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, Best Biography of Tarashankar Bandyopadhyay in Bengali

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার জোটেনি অভিনেতার ঝুলিতে,  The actor did not win any significant awards

সত্যজিৎ রায় বহুবার একথা উল্লেখ করেছেন, যে তুলসি চক্রবর্তীর মাপের অভিনেতা অস্কার পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু অস্কার না হয় বাদ থাক, বেঁচে থাকাকালীন সময়ে অভিনয়ের জন্য কোনও উল্লেখযোগ্য পুরস্কার জোটেনি তাঁর কপালে। তবে অভিনয় দক্ষতার জোরে অনেক মেডেল জিতেছিলেন তুলসি চক্রবর্তী। কিন্তু এক সময় জীবনে চরম দারিদ্রতা দেখা দেয়, তখন 

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার জোটেনি অভিনেতার ঝুলিতে

স্বামী তুলসী চক্রবর্তীর মেডেলগুলি বিক্রি করতে বাধ্য হন স্ত্রী ঊষারানী। বহুবার অভাবের তাড়নায় সে সমস্ত সম্মনিকগুলো বিক্রি করতে হয়েছে তাঁর স্ত্রী ঊষা দেবীকে। এমনকি দুমুঠো ভাত পাবার আশায় মানুষের দুয়ারে ধুয়ারে ভিক্ষে করতে হয়েছে তাঁদেরকে। বলতে গেলে তুলসি নিজেই একজন পরশপাথর ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী যে বাংলায় এমন বহু সিনেমা আছে যা তাঁর অভিনয়ের ছোঁয়ায় সোনা ফলিয়েছে। কিন্তু এই বিশিষ্ঠ অভিনেতা সেই স্বর্ণ-পরশ নিজের স্ত্রীর জন্য রেখে যেতে পারেননি। 

পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা জীবনী, Best biography of Meghnad Saha in Bengali   

অভিনেতার জীবনাবসান, Actor’s death

শেষ বয়সে এসে তুলসী চক্রবর্তী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ সামর্থ্যও তাঁর ছিলনা। এই অসুস্থতা থেকেই এ হেন বিশিষ্ট অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়। ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অভিনেতার জীবনাবসান

পরিশেষে , To conclude

তুলসী চক্রবর্তী অসামান্য প্রতিভাধর একজন অভিনেতা ছিলেন যার কদর অবশ্য টলিউড কোনদিনই সেভাবে করেনি। চিরকাল ধরেই তিনি লঘু হাস্যরসাত্মক চরিত্র করার জন্যই পরিচালকদের থেকে ডাক পেতেন। “পরশপাথর’ এর সফলতার পরও তুলসী চক্রবর্তী নিজের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দেন নি। সবসময়ই কাজ কমে পাওয়া এবং অর্থকষ্টের ভয়ে তিনি সকল প্রকার রোলেই কাজ করে যান, কোন রোলই বাদ দিতেন না। এর ফলস্বরূপ সারাজীবনই তিনি ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলেন। 

তুলসী চক্রবর্তী অসামান্য প্রতিভাধর একজন অভিনেতা ছিলেন যার কদর অবশ্য টলিউড কোনদিনই সেভাবে করেনি

Frequently Asked Questions: 

তুলসী চক্রবর্তী কে?

বাংলা সিনেমার ১৯৪০ এবং ১৯৫০ দশকের এক স্বনামধন্য অভিনেতা ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।

তুলসী চক্রবর্তী কবে জন্মগ্রহণ করেন ?

১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ

তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র কোনটি?

পুনর্জন্ম

তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রী কে ?

উশারানী দেবী

তুলসী চক্রবর্তী কবে মৃত্যু বরণ করেন?

১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর

Recent Posts