শিশু শ্রম, Best essay on child labor in Bengali



আগেকার সময়ের তুলনায় প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সর্বদা হাস্যময় শিশুদের সংখ্যা আজ নিতান্তই নগণ্য। উচ্চশ্রেণীর ধনী পরিবারের প্রাণচঞ্চল শিশুগণ আকাশচুম্বী ভাবনার জগতে মত্ত হয়ে থাকে, অন্যদিকে দীন-দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থেকে যায়, দু’বেলার খাবার জোটাতে বিভিন্ন কলকারখানা, চায়ের দোকানে অথবা অপর কোনও ধনী ব্যক্তির বাড়িতে উদয়াস্ত পরিশ্রমে রত।

শিশু শ্রম

মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা পড়াশুনার কিছুটা সময় ছাড়া দিনের বাকি সময়টা বাড়ির বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে, যাতে তাদের অভিভাবকদের রোজগারের কাজে সহায়তা হয়, আর এইভাবেই বিশ্বে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। 

শিশুশ্রম বলতে কি বোঝায়, What is meant by child labour

কারও অপরিণত বয়সে থাকাকালীন সময়ে শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের পরিশ্রম করাকেই শিশুশ্রম বলা হয়। অপরিণত বয়স বর্ধনশীল হয়, আর এই সময়ে শিশুদের চাহিদাও থাকে অনেক বেশি।

বেশিরভাগ দরিদ্র তথা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু পায় না, ফলে তাদের কাছে অপরিণত বয়স থেকেই উপার্জন শুরু করা ছাড়া নিজের প্রয়োজন মেটানোর আর কোনো রাস্তা থাকেনা। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশু হিসেবে বয়স নির্ধারণ করা আছে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী আঠারো বছর বয়স অবধি যেকোনো রকম শারীরিক তথা মানসিক শ্রমকে শিশুশ্রম হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং এই বয়সে শ্রম থেকে বিরত থাকার কথাও বলা হয়েছে।

শিশুশ্রম বলতে কি বোঝায়

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজ, Students and Eradication of illiteracy in Bengali

শিশুশ্রম উদ্ভবের কারণ কি, Cause of origin of child labour

দেশ বিদেশে বাস করছে বহু দরিদ্র পরিবার, যাদের একক পরিশ্রমলব্ধ আয়ে তাদের বহু সন্তানবিশিষ্ট পরিবার সঠিকভাবে ভরণপোষণ পায়না। এই পরিবারগুলোর ব্যয়ভার বহন করতে অক্ষম হওয়ার কারণেই মা বাবা নিজের পুত্র-কন্যাদের শৈশব থেকেই কাজে নিযুক্ত করে দিচ্ছে। শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার আগেই তারা আহার অন্বেষণে শ্রমের কাজ শুরু করতে বাধ্য হয়।

আইনত অপরাধ হওয়ার কারণে শিশু শ্রমিকদের কোনও ইউনিয়ন বা সংগঠন নেই, এজন্য তারা পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিকদের সমান কাজ করলেও উপযুক্ত হারে মজুরি পায় না। তবে শিশুদের দিয়েই বেশি কাজ করানো সম্ভব হবে বলেই মালিক বা বিত্তশালী ব্যক্তিরা শিশুদের দ্বারা শ্রম বেশি পছন্দ করেন। এসব কারণেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কবি লিখেছেন, 

শিশুশ্রম উদ্ভবের কারণ কি

” কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক যারা। শ্রমের তুল্য মজুরি যে পায়না কভু ওরা। ” 

তাছাড়া দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকেরা দু’ বেলার ভাতের অন্বেষণে তথা সাংসারিক খরচ উপার্জন করার জন্য শিশুদেরকে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিমুখ করে দিয়ে অর্থ উপার্জনের পথে ঠেলে দিচ্ছে, যার ফলস্বরূপ বাড়ছে নিরক্ষরের সংখ্যাও। কবির ভাষায় বলতে গেলে,

” ওরা শিশু নয়তো পশু

পেটের দায়ে খাটে-

করছে কাজ ক্ষেতে কলে

ভাত জোটেনা পেটে। “

    বিশেষত গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে সঠিক শিক্ষা ও শিক্ষকের অভাব থাকার কারণে শিক্ষার মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকই তাদের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে ব্যর্থ হয়, যার দরুন পিতা মাতা নিজের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠানোর চেয়ে রোজগার করার জন্য বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হবে।

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

সমাজে শিশুশ্রমের কুফল, Adverse effect of child labour in society

আমাদের সকলেই এ বিষয়ে অবগত যে শিশুশ্রম একটি মানবতা বিরোধী কাজ। সংসারে অভাবের তাড়নায় অভিভাবকরা নিজের শিশুদের ঠেলে দেয় এই আইন বিরোধী কাজের দিকে। এই অভিভাবকরা শিশুদেরকে শ্রমে পাঠিয়ে সাময়িক সামান্য সুফল ভোগ করে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে এর কুফল হয় অত্যন্ত ভয়াবহ।

শিশুশ্রম যেকোনো দেশ তথা জাতির জন্য মারাত্মক এক অভিশাপ স্বরূপ। অন্যদিকে অপরিণত বয়সকালে অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কারণেও শিশুরা অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগের শিকার হয় এবং বেশিরভাগ শিশু স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের শারীরিক সমস্যা বাড়তে থাকে, এরপর তারা আর কখনই সুস্বাস্থ্য ফিরে পায় না।

অন্যদিকে পড়াশুনার তুলনায় শ্রমের দিকে সময় বেশি দেওয়ার ফলে শিশুরা নিরক্ষরতা শিকার হচ্ছে। যে দেশের জাতি যতটা নিরক্ষর থাকবে সেই দেশের উন্নতি ততই কম হয়। কবি লিখেছেন, ” যে বয়সে থাকার কথা হাতে কিছু বই, সময়মত খেলা ধুলা আর করবে হইচই। কেহ চালায় রিক্সা ভ্যান মোটর গাড়ীর হেলপার, কেহ বাস ট্রেনে মালামাল করে এপার ওপার। “

সমাজে শিশুশ্রমের কুফল

সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali

শিশুশ্রমের আইনগত দিক, Legal Aspects of Child Labour

আমাদের দেশে শিশু শ্রম নিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করার আইন অনুসারে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বালক বালিকাদের দ্বারা শ্রম কে শিশুশ্রম এবং তাদের শিশু শ্রমিকের পর্যায়ে ধরা হয়। সেই হিসাবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্ৰায় পাঁচ কোটি।

তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু নানা কলকারখানায় কাজ করছে এবং বাকি ৩০ শতাংশ বিভিন্ন দোকানে বা ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করে, অবশিষ্ট অংশের শিশুরা স্বয়ং উদ্যোগে পরিবারের অন্ন সংস্থানের জন্য প্রাণান্তকর সংগ্রামে নিযুক্ত।

শিশুশ্রম নিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে যে, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কলকারখানার কাজে নিয়োগ করা যাবে না, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনও আইন বা শর্ত লঙ্ঘন করার পরিপ্রেক্ষিতে শিশু শ্রমিকদের কোনো রকম গুরুতর শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সব কিছু খাতা কলমেই রয়ে গেছে। কবির কথায়, 

” সকল কর্মে শিশুর হাত এই নব্য যুগে। 

তাইতো শিশুরা আজ কত শত রোগে ভোগে।

 যেথায় সেথায় কাজ করে দেহ ভিজে ঘামে।

 এই দেশের শিশু আইন শুধু মাত্র নামে। “

শিশুশ্রমের আইনগত দিক

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali

শিশু শ্রম প্রতিকারের উপায়, Ways to remedy child labour

শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি বা শিশু শ্রমের সমস্যাটি পুরোপুরি রদ করা হয়তো সম্ভব না। বস্তুত সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে শিশু শ্রমিকের পুনর্বাসন করতে হবে এবং তাদের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থার আইন বলবৎ করতে হবে, কারণ শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্যা যে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের রয়েছে তা নয়, বরং সময়ের সাথে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপ ধারণ করেছে।

তাছাড়া কোথাও শিশু শ্রমিক নিয়োগকে রদ করার সুদৃঢ় কোনো আইন নেই। তাই এই সমস্যা সমাধান কষ্টকর। তবে জনসচেতনতার মাধ্যমে বিশ্বের বহু সমস্যার সাথে লড়াই করা সম্ভব হয়েছে, তাই শিশু শ্রমের প্রতি মানুষের প্রতিবাদ হয়তো সমাজ থেকে এর পুনর্বাসনে সহায়ক হতে পারে। বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিশুশ্রম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশুশ্রম যতই বৃদ্ধি পাবে দেশ ও জাতি ততই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা আমাদের কর্তব্য। এ ব্যাপারে সরকার আইন প্রণয়ন করলেও শুধু আইনের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং দারিদ্র বিমোচনে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ না করতে পারলে অচিরেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই সকলের মনে থাকা উচিত যে, “বুকে হাত রেখে মোরা আজ শপথ করি, বন্ধ করবো শিশু শ্রম। “

শিশু শ্রম প্রতিকারের উপায়

উপসংহার, Conclusion 

ভারতের মতো বিশাল দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে শিশুশ্রম। শিশুশ্রম একটি শিশুর জীবনের অমানবিক অধ্যায় হিসেবে ধরা যায়। শিশুশ্রম যেকোনো শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার প্রবণতাকে বাধাগ্রস্ত করে। আবেগগত, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক এবং নৈতিক জীবনকে বিষিয়ে তোলে এই শিশুশ্রম।

তাছাড়া শিশুর মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে শিশুশ্রম, জীবন উপভোগ করার পূর্বেই তারা শ্রমের চাপে চাপা পরে যায়, অনেক সময় শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং এই থেকেই তারা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা খুব জরুরী।

Recent Posts