শ্রমের মর্যাদা, Best essay on Dignity of labor in Bengali



” কত ভালবাসা কত মমতায়

গড়ে ওঠে জগত তাদের শিল্পছোঁয়ায়

শক্ত কঠিন ইঁট ওরা ভাঙ্গে, ফোস্কা পড়ে গায়ে

ধরে হাল খাটে নিপুণ কারিগরে দুর্বার স্বপ্ন সাজায়। “

       কথাগুলো পড়ে বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না যে এখানে শ্রমিকদের কথাই বলা হয়েছে, যাদের কাছে কর্মই জীবন। কর্মই তাদের বেঁচে থাকার সম্বল। এই সৃষ্টির প্রায় সকলকেই নিজ নিজ কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হয়। কোনো এক ছোট্ট পিঁপড়ের কথাই বলুন নয়তো এক বিশাল হাতিই হোক না কেনো, সবাইকেই কোনো না কোনো ভাবে পরিশ্রম করতে হয়।

পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের ভাগ্য বদলাতে পেরেছে। তবে শ্রমিকেরা বহু বছরের শ্রম ও সাধনার দ্বারা এই পৃথিবীকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বলতে গেলে, মানুষ এবং সভ্যতার যাবতীয় অগ্রগতির পেছনে শ্রমিকদের পরিশ্রমের বিশেষ অবদান রয়েছে যা অস্বীকার করার হয়।

শ্রমের মর্যাদা

শ্রমের মর্যাদা, What is labour

শ্রমের আভিধানিক অর্থ হল পরিশ্রম বা দৈহিক খাটুনি। সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে যেকোনো কাজই হল শ্রম। অনু থেকে শুরু করে অট্টালিকা পর্যন্ত, এই বিশ্বসভ্যতার প্রত্যেকটি সৃষ্টির মূলে আছে শ্রম। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি পৃথিবীর সকল কাজ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎস প্রভৃতি যা কিছুই দৃশ্যমান রয়েছে এর সবই অর্জিত হয়েছে শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে। শ্রম হল এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করার প্রধান হাতিয়ার, কারণ পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বিশ্ব এবং মানব-সভ্যতার বিজয়-স্তম্ভ। 

শ্রমের মর্যাদা

সবার শিক্ষা সর্বশিক্ষা অভিযান, Know about Education for all campaign in Bengali

শ্রম ও মানব সভ্যতা, Labour and human civilization

যুগ যুগ ধরে মানবসভ্যতার যে ক্রমবিস্তার ঘটছে, শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই সব কিছুই বিশ্বের লক্ষ-কোটি শ্রমজীবী মানুষের তিল তিল শ্রমের বিনিময়েই সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সভ্যতার চরম উন্নতির দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। সভ্যতার এই চরম বিকাশের মূলে আছে যুগে যুগান্তরের লক্ষ-কোটি জনগণের অফুরন্ত শ্রম। কত মানুষ যে তাদের শ্রম তিলে তিলে দান করে তৈরি করেছে সভ্যতার বর্তমান তিলোত্তমা মূর্তিটি, তা হয়তো ধারণা করা কঠিন। কিন্তু তবুও তাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় নি। তাই কবি লিখেছেন, 

“আমরা শ্রমিক

আমাদের শ্রমের নেই ন্যায্য অধিকার,

প্রতিনিয়ত হচ্ছি শোষণের শিকার।

আমরা আজও অবহেলিত, পায়নি সঠিক সন্মান।”

       তারা উঁচু পাহাড় ভেঙে চলার পথ প্রস্তুত করেছে, সেতু বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে ছোটো বড় বহু নদীর উভয় তটভূমিকে। রোদে পুড়ে নির্মাণ করেছে উঁচু প্রাসাদ ও বিলাসবহুল অট্টালিকা। মাঠে মাঠে ফলিয়েছে সোনার ধান, কেউ বা সুতো জুড়ে দিয়ে বুনেছে আমাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র। আবার কেউ কেউ তৈরি করেছে জীবনকে আরো সুন্দর, সহজ ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্যসামগ্রী। বলাই বাহুল্য, সকলের পরিশ্রমের যৌথ প্রয়াসেই আজ সভ্যতার এইরূপ অনবদ্য বিকাশ সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ আজকের সভ্যতা হল বহু মানুষের পরিশ্রমের সম্মিলিত যোগফল।

শ্রম ও মানব সভ্যতা

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali

শ্রম কত প্রকারের হয়, Various types of labour 

 গায়ের জোরে খাটা শ্রম এবং মস্তিষ্কের জোরে হওয়া মানসিক শ্রম- দুটোরই গুরুত্ব রয়েছে, অর্থাৎ আমাদের সমাজে শ্রম দুই ভাগে বিভক্ত, যথা: কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম। যে শ্রমের ক্ষেত্রে হাত, পা বা দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনা করার প্রয়োজন হয়, তাকে দৈহিক শ্রম অথবা কায়িক শ্রম বলা হয়; অন্যদিকে যে কাজের ক্ষেত্রে শরীরের থেকে মস্তিষ্ক চালনা বেশি করতে হয়, তাকে বলা হয় মানসিক শ্রম। তবে দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রম একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই দুটির সমন্বয় প্রয়োজন। কারণ পরস্পর একে অপরের উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়। বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, অফিসের কর্মচারী শ্রেণির মানুষজন কাজের ক্ষেত্রে যে ধরনের শ্রম দিয়ে থাকেন তাকে বলে মানসিক শ্রম। আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে কৃষক, জেলে, শ্রমিক, মজুর শ্রেণির মানুষজন দ্বারা কৃত শ্রম হল শারীরিক শ্রম। তবে সব কথার শেষ কথা এই যে, শ্রম শারীরিক হোক কিংবা মানসিক, উভয়ের মিলিত পরিশ্রমেই ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আমাদের বর্তমান সভ্যতা।

শ্রম কত প্রকারের হয়

শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা, Know about Contribution of library in education in Bengali

শ্রমের প্রয়োজনীয়তা, Importance of labour

মানবজীবনে পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দেখতে গেলে মানুষ নিজেরাই নিজের ভাগ্যবিধাতা হয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেই ভাগ্য নির্মাণ করতে হয়। তাই যারা কর্মবিমুখ বা অলস ধরনের মানুষ তারা কোনোদিনও জীবনে উন্নতি করতে পারে না। পরিশ্রম যদি না করা হয় তবে জীবনের উন্নতিও কল্পনামাত্র। পৃথিবীতে যে দেশের জাতি যত বেশি পরিশ্রমী হয়, সেই স্থানের বসবাসকারী জাতি তত বেশি উন্নত জীবনযাপন করছে। এজন্যই বলা যায় যে, একমাত্র পরিশ্রমই হল মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার চাবিকাঠি। তাই কবি লিখেছেন, 

” আমি শ্রমিক, শ্রদ্ধা করি শ্রমে।

বংশ আমার হোক যা’ই, বড় আমি কর্মে। “

শ্রমের প্রয়োজনীয়তা

নিজের ব্যক্তিত্ব কে গড়ে তোলার কিছু অনন্য উপায়, Valuable tips to build up your personality in Bengali

শ্রমের মর্যাদা, Dignity of labour

বিভিন্ন স্থানের শ্রমিকরা শ্রমের মর্যাদা থেকে বহুকাল আগে থেকেই বঞ্চিত হয়ে আছে। নিষ্ঠা ভরে কাজ করেও তার যথাযথ সম্মান তারা পায় না। জীবন-ধারণের তাগিদে মানব জাতি নানা রকম কর্মের সাথে নিয়োজিত হয়। কৃষকেরা মাঠে চাষ করে ফসল ফলায়, তাঁতিরা কাপড় বোনে, জেলে নদী ও জলাশয় থেকে মাছ ধরে, শিক্ষকগণ ছাত্র পড়ান, ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করেন, বিজ্ঞানীরা গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন।

বলতে গেলে এরা প্রত্যেকেই মানবতার কল্যাণে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, আর পৃথিবীতে কোনও কাজই ছোট হয় না। তবে আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদার দিক থেকে হয়তো সবাই সমান না, কিন্তু প্রত্যেকেই নিজস্ব বুদ্ধি, মেধা, মনন, ঘাম ও শ্রমের ভিত্তিতে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তাই কোনো ভেদাভেদ না করে সকলের শ্রমের প্রতিই আমাদের সমপরিমাণ মর্যাদা এবং শ্রদ্ধা থাকা উচিত। উন্নত বিশ্বে কোনো কাজকেই তুচ্ছ করা উচিত না, কিন্তু তাও বহু স্থানে দেখা যায় যে শ্রম করার পর শ্রমের সঠিক মর্যাদা পাচ্ছে না অনেকেই। তাই কবি লিখেছেন,

” কায়িক শ্রমের কর্মী যারা ভুক্তভোগী বেশ,

ন্যায্যমূল্য পায় না তারা, নেই হতাশার শেষ। “

শ্রমের মর্যাদা

        আমাদের সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ করছে সম্মানের কাজ, তাদের কাজ গৌরবের কাজ হিসেবে ধরা হয়। এই উচ্চস্তরের ব্যক্তিগণ সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়ে তথাকথিত নিচু শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষের দিকে অপমান নিক্ষেপ করছে, ঘৃণা ও বঞ্চনার তীব্র অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে শ্রমিক জাতিকে, অথচ দেখতে গেলে সেইসব শ্রমিকেরাই চিরকাল মাঠে ঘাটে বীজ বুনেছে, ফলিয়েছে পাকা ধান; রোদের তাপে জ্বলে পুড়ে ইঁটের উপর ইঁট জুড়ে দিয়ে গড়ে তুলেছে বিশাল অট্টালিকা, অর্থাৎ নিরলস শ্রমসাধনায় তারা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং এভাবেই সভ্যতার উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

তাই তাদের শ্রমের সঠিক মর্যাদা দেওয়া উচিত, কারণ তাদের থেকেই আমরা শিখতে পারি যে, জীবনকে সুষ্ঠ স্বাভাবিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে শ্রম ব্যতীত অন্য কোনও সহজ উপায় নেই। এজন্যই শ্রমের প্রতি ব্যক্তিগত তথা জাতিগতভাবে শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজনীয়। বিখ্যাত কবি অক্ষয় কুমার বড়াল নিজের লেখা ‘মানব-বন্দনায়’ সভ্যতার সূচনা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল শ্রমশীল জনগণের উদ্দেশ্যে বন্দনা করে লিখেছেন-

  “নমি কৃষি-তন্তুজীব, স্থপতি, তক্ষক, কর্ম, চর্মকার!”

পরিশেষে, Conclusion

শ্রম এবং শ্রমিকের ভিত্তিতেই আজকের সভ্যতা এতটা উন্নত হতে পেরেছে। তাছাড়া পরিশ্রম নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের নিয়ন্ত্রক তো বটেই, পাশাপাশি সভ্যতার বিকাশেরও সহায়ক।

শ্রম এবং শ্রমিকের ভিত্তিতেই আজকের সভ্যতা এতটা উন্নত হতে পেরেছে

এক কথায় আমাদের মানব-সভ্যতার উন্নতি তথা অগ্রগতিতে শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য, শ্রমের বিজয়-রথে চড়েই আমাদের সকলকে উন্নত সভ্যতার সিংহদ্বারে পৌঁছাতে হবে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে এই দ্বারে প্রবেশ করার অধিকার সকল শ্রমজীবীদেরই রয়েছে। তাই সমাজের সকল শ্রেণীর শ্রমিকদের সঠিক মর্যাদা দেওয়া উচিত।

Recent Posts