মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali


ভূমিকা, Introduction

মাতৃভাষা হল মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম। অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যেকোনো ব্যক্তির কাছেই মাতৃভাষা একটি গর্বের বিষয়। কিন্তু আজকাল অভিভাবক তথা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজি ভাষার প্রতি বেশি জোর দিচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগী ভাষা হিসেবে ইংরেজি অথবা অন্য কোনোও ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে।

তবে শিক্ষা ব্যাবস্থার দিক থেকে দেখতে গেলে মূল ভাষা মাতৃভাষাই হওয়ায় উচিত। মানুষের জীবন থেকে সকল ধনসম্পত্তি লুট হয়ে গেলেও তার অর্জিত শিক্ষা তথা জ্ঞান কখনই সে মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। তাই নিজের অর্জিত শিক্ষার সাথে মানুষের অন্তরে থাকা আবেগের যোগসূত্র থাকা আবশ্যক।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান

শিক্ষার সাথে মানুষের অন্তরে থাকা আবেগকে যুক্ত করে রাখার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রয়োজন। নিজ ভাষা ও নিজ জ্ঞান একত্রিত হলেই একজন ব্যক্তি সার্থক মানুষরূপে ধরণীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। 

ভাষা এবং মাতৃভাষার মধ্যে সম্পর্ক, Relationship between language and mother tongue

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সম্পর্কে আলোচনা করার আগে ভাষা এবং মাতৃভাষা সম্বন্ধে সব রকম বিভ্রান্তি দূর করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের মাতৃভাষার স্বরূপকে বোঝার ক্ষেত্রে ভাষা কি তা সর্বপ্রথম বোঝা প্রয়োজন।

সুদীর্ঘ কালের বিবর্তনে মানবজাতির ভাব প্রকাশের নিমিত্ত এক সুগঠিত তথা সুসংবদ্ধ মাধ্যম হল ভাষা। প্রাথমিকভাবে সংজ্ঞাটির দিকে নজর দিলে ভাষাকে নেহাতই এক তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। তবে শুধু মনের ভাব প্রকাশ করাই ভাষার প্রকৃত রূপ নয়। মানব সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার সাথে জড়িয়ে গেছে ঐতিহ্য, গৌরব এবং সংস্কৃতির লালিত্যও।

ভাষা এবং মাতৃভাষার মধ্যে সম্পর্ক

বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে কেন্দ্র করেই একটি জাতি গড়ে ওঠে এবং জাতীয়তাবোধের আত্মপ্রকাশ ঘটে, সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন সমাজ। ওই সমাজের কোলে জন্ম গ্রহণকারী প্রত্যেকটি শিশু জন্মের পর থেকেই মাতৃভূমির বয়ানে যে ভাষাটির উচ্চারণ শেখে, তাই হল শিশুটির মাতৃভাষা। একজন মায়ের সঙ্গে যেমন তার শিশু নাড়ির টান থাকে, তেমনি মাতৃভাষার সাথেও শিশুটির নাড়ির টান জড়িয়ে থাকে। 

আধুনিক শিক্ষায় ইন্টারনেট, Best use of Internet in Modern education in Bengali

মাতৃভাষার ও শিক্ষার মিথস্ক্রিয়া, Interaction of mother tongue and education

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার সহজ এবং পূর্ণাঙ্গ হয়। এই বিষয়ে কবিগুরু বলেছেন,

 ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’ 

 অর্থাৎ শিশুর পক্ষে মাতৃদুগ্ধ যেমন পুষ্টিকর হয়, ঠিক তেমনি বিদ্যাশিক্ষার দিক থেকে মাতৃভাষা হল সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। একথা আমরা সকলেই জানি যে, শিক্ষা মানব জীবনের প্রধান সম্পদ এবং আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু, শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা বিশ্বকে জয় করে নিতে পাড়ি। তাই এর সঙ্গে আমাদের আত্মার সংযোগও গড়ে ওঠা একান্ত জরুরী।

মাতৃভাষার ও শিক্ষার মিথস্ক্রিয়া

একজন ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষার বিকাশ শুধুমাত্র শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই হয় না। তার অন্তরে গ্রহণ করা শিক্ষার প্রকৃত বিকাশ তখনই ঘটে যখন তার আত্মার সঙ্গে শিক্ষার মিলন হয়। মানুষের ভাব প্রকাশ করার উত্তম মাধ্যম হল ভাষা, আর অন্তরাত্মা মাতৃভাষাকেই সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে, তাই মাতৃভাষায় সকলের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমাদের আত্মার সাথে সংযুক্ত ভাষা হল মাতৃভাষা। সেই কারণেই মাতৃভাষার সাথে যদি শিক্ষার সার্থক মিথস্ক্রিয়া ঘটে তবে পৃথিবীর প্রত্যেক ব্যক্তি অশিক্ষার অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার পাবে।

শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali

ভারতবর্ষে মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের ইতিহাস, History of education through mother tongue in India

আমাদের ভারতবর্ষে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বা শিক্ষা অর্জনের ইতিহাস হয়তো নতুন না তবে খুব প্রাচীনও নয়। প্রাচীনকালের ভারতে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে মূলত সংস্কৃত ভাষা ব্যবহৃত হত। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বসবাস ছিল, পাশাপাশি মাতৃভাষাও বিভিন্ন ছিল, তা সত্বেও শিক্ষাদান করার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

ভারতবর্ষে মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের ইতিহাস

পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই খুব সম্ভব মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ওপর সর্বপ্রথম তথা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির প্রাথমিক শিক্ষাপুস্তক রচিত হয়, যার নাম ছিল বর্ণপরিচয়। এরপর থেকে সময়ের সাথে সাথে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তার করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

কম্পিউটার শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, What is the Importance of computer education in Bengali

মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনীয়তা, need for education in the mother tongue?

আমাদের সমাজে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যাপক ও বহুমুখী প্রয়োজনীয়তা আছে। সমাজের জীবনচর্চার দীর্ঘকালীন বিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি সুসংহত ভাষা সার্থক রূপ অর্জন করে। মাতৃভাষার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট সমাজের সংস্কৃতি,ঐতিহ্য তথা ইতিহাস মিশে থাকে ।

তাই নিজ মাতৃভাষার সাথে সার্থক পরিচিতি যদি না গড়ে উঠে তবে ব্যক্তির নিজস্ব উৎপত্তিগত শিকড়ের সাথে আন্তরিক বন্ধনটিও যেন ছিন্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে মানুষের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সহজ একটি মাধ্যম হল মাতৃভাষা। তাই কবি বলেছেন –

‘নানান দেশের নানান ভাষা

বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?”

মাতৃভাষায় শিক্ষাদান তথা শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই এই সমাজের মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাষাগত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলা সম্ভব হয়। মাতৃভাষা সকলের কাছেই সহজ বলে মনে হয় আর এই সহজ ভাষায় উচ্চমানের শিক্ষা দান করার ফলে মানুষ তুলনামূলক সহজভাবে শিক্ষা গ্রহণে আকৃষ্ট হয়, এর ফলে নিঃসন্দেহে এই কথাটি বলা যায় যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান একটি শিক্ষিত সমাজের ভিত রচনা করবে।

মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনীয়তা

একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]  

মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব, Importance of spreading education in mother tongue

 মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে যেকোনো ব্যক্তির নিজের মাতৃভূমির সাথে থাকা আত্মিক বন্ধনটি আরো দৃঢ় হয়, এর পাশাপাশি মাতৃভূমির ভাষার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তথা ইতিহাস সম্পর্কে সার্থক পরিচিতি ঘটে, যার ফলে নিজ দেশের একজন সত্যিকারের নাগরিক রূপে নিজেকে গড়ে তোলার পথ সুগম হয়।

মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব

কোনও বিদেশী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক সময় সরল কোনো বিষয়ও ভাষাগত সমস্যার কারণে জটিল বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে কোনরকম বিশেষ পুঁথিগত চর্চা ছাড়াই আমাদের মাতৃভাষাকে আমরা জন্ম থেকে আয়ত্ত করে নিতে পারি, তাই শিক্ষা গ্রহণ তুলনামূলক সহজ বলে মনে হয়। সেই কারণেই মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে ব্যক্তির সঙ্গে শিক্ষার সার্থক মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন হয় তথা প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। 

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের প্রতিকূলতাসমুহ, Disadvantages of education through mother tongue 

মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এর পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু গুরুতর সমস্যাও। মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা যায়।

সরকারের পক্ষ থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সমাজের কিছু অভিজাত সম্প্রদায় আছেন যারা তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে হয়তো পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রধান মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকেই বেছে নেয়। এইভাবে নতুন প্রজন্মের শিশুরা মাতৃভাষার আদ্যক্ষর শেখার পূর্বে প্রথমেই রপ্ত করে ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলোকে।

তাছাড়া ইংরেজি ভাষাটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কারণেই বহু মানুষের মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের উৎসাহের ক্ষেত্রে ভাঁটা পড়েছে। অন্যদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যগত নিদর্শনগুলোর অভাব থাকার ফলে মাতৃভাষার ব্যবহারে শিক্ষাদানের নিমিত্ত পর্যাপ্ত মানের পুস্তক রচনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিভাষার অভাবও শিক্ষা বিস্তারের পথে মাতৃভাষা ব্যবহারের এক অন্যতম প্রধান প্রতিকূলতা হিসেবে কাজ করে থাকে।

তবে শুধুমাত্র পরিভাষার অভাব থাকার কারণে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করার বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করার সমান। মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি আবদুল হাকিমের কথায়-

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ 

উপসংহার, Conclusion 

মাতৃভাষা হল আমাদের মায়ের থেকে পাওয়া ভাষা। তাই নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা মাকে অবহেলা করার সমান। স্বদেশ এবং মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা যত বেশি দৃঢ় হয়ে উঠবে, ততই বিদেশি ভাষার সাহায্য নিয়ে শিক্ষাদান করার চিন্তা দূর হবে।

মাতৃভাষা হল আমাদের মায়ের থেকে পাওয়া ভাষা

মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের আত্মার যে যোগসূত্র থাকে, তাতে আবেগের প্রলেপ পড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই। তাই মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলকে সমাজের সকল স্তরেই ব্যাপক প্রয়াস চালানো উচিত। এই প্রয়াস দ্বারাই গড়ে উঠবে একটি ঐতিহ্য অনুরাগী, ইতিহাস সচেতন, সুসংস্কৃতিবান তথা রুচিশীল সমাজ।

Recent Posts