ভূমিকা, Introduction
আমরা সকলেই নিজের দেশকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। স্বদেশপ্রেম কথাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু অনুভূতি। স্বদেশের প্রতি আমাদের টান, ভালোবাসা, গর্ববোধ, আবেগ, কর্তব্য সব কিছু মিলিয়েই হয় আমাদের দেশপ্রেম।
মায়ের সাথে যেমন সন্তানদের নাড়ির যোগ থাকে, ঠিক একইভাবে আমাদের জন্মভূমির সাথে আমাদের নাড়ির বন্ধন থাকে। সকল সুখ দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজ জন্মভূমি অর্থাৎ নিজ দেশের প্রতি অবাধ প্রেম। তাই সকলে মিলে স্বগর্বে বলি যে-
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।”
স্বদেশপ্রেমের অর্থ, Meaning of Patriotism
স্বদেশপ্রেম হল নিজ দেশের প্রতি, দেশে বসবাসকারী জাতির প্রতি, দেশীয় ভাষার প্রতি কোনো ব্যক্তির গভীর আকর্ষণ থাকা। নিজ দেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ, দেশের বাসিন্দা হওয়ার গর্ববোধ, দেশের সবকিছুর নিবিড় প্রেম এবং যথার্থ আনুগত্য থাকাকেই দেশপ্রেম বলে। নিজের জন্মভূমির স্বার্থে সবকিছু ত্যাগ করে দেওয়ার সাধনাই হল স্বদেশপ্রেম।
নিজের জন্মভূমি অর্থাৎ নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে আমাদের মনে জন্ম নেয় দেশপ্রেমের। তবে দেশপ্রেমের তাৎপর্য যদি বুঝতে হয় তবে দেশের যথার্থ স্বরূপ জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশ বলতে শুধু মৃত্তিকাময় কোনো ভূমিকে বোঝায় না, বরং সেই ভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সবকিছু নিয়েই একটি দেশ গঠিত, তাই ভালোবাসতে হলে দেশের সবটাকেই ভালোবাসতে হবে, তবেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। তাই কবি বলেছেন –
“যদি কেউ একজন দেশের জন্য ভাবে,
যদি কেউ দেশের জন্য অনেক স্বপ্ন দেখে,
যদি কেউ ছোট বড় অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায়,
তবেই সে একজন দেশপ্রেমিক।”
মানব শূন্য কোনও ভৌগলিক অঞ্চল কখনই দেশ হয়ে উঠতে পারবে না। জনগন, পশু, পাখি, গাছ পালা সবকিছু নিয়েই একটি দেশ সম্পূর্ণতা পায়, তাই দেশ প্রেমের প্রকৃত অর্থ হল নিজের দেশবাসীদের প্রতি ভালোবাসা। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন –
বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত, Best detailed information about Global Warming in Bengali
“দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। যার অর্থ দেশ চিত্তময়। আর এই চিত্তের অধিকারী মানুষের মনের সাথে মনের সংযোগ না থাকলে দেশ প্রেম সেখানে অর্থহীন।”
নিজ জন্মভূমির প্রতি দেশপ্রেম, Patriotism towards one’s native land
সংস্কৃতে এক শ্লোক আছে, যেখানে বলা হয়েছে যে : “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” অর্থাৎ জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও শ্রেষ্ঠ।
প্রাচীন সময়ে তথা মধ্য যুগের সময়কালে দেশপ্রেম সম্পর্কে মানুষের তেমন কোনোও পরিষ্কার ধারণা ছিলনা। তাই তখন দেশ প্রেমের তেমন কোনো অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। রাজাদের শাসনের সময়কালে যে রাজার রাজত্বে জনগন বাস করতেন সেই রাজার প্রতিই আনুগত্য থাকাই ছিল প্রধান কথা। আধুনিক সভ্যতা এবং সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পাশাপাশি উৎপত্তি হয়েছিল দেশ দেশান্তরের।
এই দেশ বলতে মূলত রাষ্ট্রকে বোঝায়। তাই স্বদেশ প্রেম বলতে এক অর্থে দেশ তথা রাষ্ট্রের সকল প্রকার ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যকেও বোঝায়। ১৯৪৭ সালের পূর্ববর্তি ভারত সম্পূর্ণভাবে পরাধীন ছিল, সেই সময়কালে এই দেশ ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল। ইংরেজ শাসনকালে ইংরেজদের নিষ্ঠুর শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনা এবং অবহেলা ভারতবাসীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সৃষ্টি করেছিল।
সেই সময় সকল ভারতবাসীর কামনা ছিল যেন দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটে। এই স্বদেশ প্রেম ও স্বাধীনতার প্রত্যাশাই সবাইকে একটি ঐক্যসূত্রে বেঁধে দিয়েছিল, তাই সকলে মিলে বিদ্রোহ করেছিলেন পরাধীনতার। এই থেকেই ভারতবাসীদের মনে স্বদেশপ্রেমের জন্ম হয়েছিল এবং এই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই হাজার হাজার মুক্তি যোদ্ধা শুধু মাত্র দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন।
ছাত্রজীবনে স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি, A sense of patriotism in student life
ছাত্র সমাজই হল দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। কোনো দেশের উন্নতি তথা জাতির আশা পূরণের আশ্রয়স্থল হল ছাত্রসমাজ। তাই ছাত্রজীবনে থাকাকালীন দেশ তথা জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।
তাদেরকে এই সময় থেকেই নিজের দেশকে ভালোবাসার উজ্জীবন মন্ত্র দ্বারা দীক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। ছাত্রদেরকে যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যায় তবেই দেশের স্বার্থে এবং প্রয়োজনে তাদের মধ্যে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি, A sense of patriotism
দেশ এবং দেশের জনগণের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থেকেই জন্ম হয় স্বদেশপ্রেম। পৃথিবীর সকল স্থানে আকাশ, সূর্য, চন্দ্র একই, তাও স্বদেশপ্রেমের চেতনার জোরে নিজের দেশের চাঁদ-সূর্য-আকাশকে আলাদা বলে চিহ্নিত করতে ভালো লাগে। দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হলেই এই স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি বেশি প্রকাশ পায়, সেই সময় স্বদেশপ্রেমের প্রবল আবেগের বশে মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করে না, কারণ সে জানে যে, নিজের দেশের জন্য ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’।
স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব, Importance of patriotism
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সাৰ্থক জনম মাগ্যে তোমাই ভালোবেসে।”
স্বদেশপ্রেম হল এমন এক গুণ, যা কোনো মানুষকে দেশের কল্যাণার্থে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। স্বদেশপ্রেমের অনন্ত স্পৃহা আমাদেরকে উদ্যমী, দায়িত্বপরায়ণ ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। দেশপ্রেমী ব্যক্তিগণ দেশে বসবাসকারীদের অন্যান্য ব্যক্তির দ্বারা প্রশংসিত তথা সম্মানিত হন, ফলে মানুষের মনের মধ্যে জনজাতির কল্যাণ সংক্রান্ত চিন্তাধরা জাগ্রত হয়।
দেশপ্রেমের মহৎ চেতনায় উদ্বদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মানুষই নিজস্ব অবস্থানে থেকে দেশের জন্য কাজ করার দিকে উদ্যোগী হয়। কোনো সমৃদ্ধ জাতি, সুখী মানুষ, উন্নত দেশ ইত্যাদি সবকিছুই হল স্বদেশপ্রেমের অবদান।
অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখতে হয় তবে স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, কারণ একটি দেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বহু লোক বাস করেন, দেশপ্রেমীরা দেশের সকলেই সমানভাবে দেখেন, কোনো কিছু নিয়ে তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করেন না। এ সম্পর্কে ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছিলেন, “হুববুল ওয়াতান মিনাল ঈমান” অর্থাৎ স্বদেশপ্রেমই হল ইমানের অঙ্গ।
সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali
স্বদেশপ্রেম তথা বিশ্বের প্রতি প্রেম, Patriotism and love for the world
স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি মূলত বিশ্বপ্রেমেরই এক ছোটো অংশ। বিশ্বের সব এক পৃথিবীরই অধিবাসী, পৃথিবী নামক ভূখণ্ডেই সকলের বাস। সেজন্য স্বদেশপ্রেমের মধ্য দিয়ে পরস্পরের বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী এবং বিশ্বমানবতাকে জাগ্রত রাখতে হবে, কারণ বিশ্বজননীর আঁচল-ছায়াতেই রয়েছে দেশজননীর ঠাঁই। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
“ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা, তোমাতে বিশ্বময়ীর- তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
দেশপ্রেমের সীমাবদ্ধতাগুলো কি কি, What are the limitations of patriotism?
নিজ দেশের প্রতি অশেষ ভালোবাসা সকলেরই থাকে। নিজ দেশকে ভালোবাসার অর্থ এই না যে আমাদের মনে অন্য কোনও দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে পারেনা। স্বদেশপ্রেম সর্বদাই জননির্ভর হয়, তাই অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরকে নিজের থেকে ছোটো করে দেখাটা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। নিজের দেশের মানুষ সহ অন্য দেশের মানুষের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা ভালোবাসা রাখার মধ্য দিয়েই স্বদেশ প্রেমের বিকাশ ঘটা দরকার, কারণ স্বদেশপ্রেম কোনোও নির্দিষ্ট জাতি অথবা ধর্মের উপর ভিত্তি করে হতে পারে না।
কিছু ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের নাম করে শুরু হয়ে যায় উগ্র সাম্প্রদায়িক জটিলতা। তাছাড়াও ধর্মের নামে নিজ দেশের জনগণেরর মধ্যেও বিবাদ বিরোধ সৃষ্টি হয়। সত্যিকারের স্বদেশপ্রেমের অর্থ এসব কখনই হতে পারেনা।
বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
উপসংহার, Conclusion
আমরা সকলেই নিজের জন্মস্থানকে ভালোবাসি। জন্মস্থানের জল, আলো, হাওয়া, পশু-পাখি, সবুজ গাছপালা তথা প্রকৃতির সাথে একজন স্বদেশপ্রেমীর অজান্তেই এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশের প্রতি প্রেম থাকলে নিজ জন্মস্থানের ধূলিকণাকেও সোনার চেয়েও দামি বলে মনে হয়। তাই কবি বলেছেন –
“মিছা মণি মুক্তা-হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।
মানুষের এই উপলব্ধিই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম।”
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের দেশের মানুষের জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখা প্রত্যেক দেশপ্রেমী নাগরিকের দায়িত্ব।দেশ প্রেম আমাদের সকলের জীবনে অন্যতম মহৎ চেতনা। যেদিন বিশ্বের সকল মানুষ উপলদ্ধি করবে স্বদেশ চেতনা বিশ্বাত্মবোধের প্রথম পদক্ষেপ ,সেদিন স্বদেশ অনুভূতিকে বিস্বানুভূতির দিকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যাচার, ধর্মীয় বিবাদ, রাজনৈতিক সংকীর্ণতা এসব ধূলিসাৎ করে মানুষ দেশ প্রেমের সাথে বিশ্বপ্রেমের মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হবে।