লোকশিল্পের রূপকার তোফায়েল আহমদের জীবনী, Biography of Tofayel Ahmed, researcher of folk art in Bengali


তোফায়েল আহমেদ ছিলেন লোকশিল্পের একজন সুপরিচিত বাংলাদেশী গবেষক ও শিক্ষাবীদ। লোকসংস্কৃতি গবেষক ও একই সাথে লোকশিল্প সংগ্রাহক , তোফায়েল আহমেদ   বাংলাদেশের লোকশিল্প ও কারুশিল্পের উপর বেশ কিছু বই রচনা করে গেছেন  যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ স্বরূপ। তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি লোকসাহিত্যিক হিসাবেও প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন এই মহান ব্যক্তিত্ব।

লোকশিল্পের রূপকার তোফায়েল আহমদ

তোফায়েল আহমদের জন্ম বৃত্তান্ত  

তোফায়েল আহমেদ ১৯১৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলার বড়লিয়া গ্রাম ছিল তাঁর জন্মস্থান। তিনি ঢাকা শহরের লালমাটিয়ায় বড় হয়েছেন । 

শিক্ষা জীবন

তোফায়েল আহমেদ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে।  পরবর্তীকালে  তিনি  ইসলামিয়া কলেজ থেকে বর্তমানে যা কিনা মৌলানা আজাদ কলেজ, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মেধাবি ছাত্র  তোফায়েল,  পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি  নিয়ে অধ্যয়ন  করেন এবং এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র থাকাকালীন তিনি বেকার হোস্টেলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং কারমাইকাল হোস্টেলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

জওহরলাল নেহেরু – স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ~ Jawaharlal Nehru Biography in Bengali

কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা

তোফায়েল আহমেদ কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।  পরে তিনি বরিশালের  চাখার ফজলুল হক সরকারি কলেজে কিছুদিনের জন্য  অধ্যাপনার দায়িত্ব সামলে ছিলেন । ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ সাল অবধি, তিনি করটিয়াতে সাদাত কলেজে অধ্যাপনা করেন। উক্ত কলেজে তিনি  সতের বছর অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত  অবস্থায় ছিলেন  এবং ১৯৮০ সালে  অবশেষে উক্ত পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।  পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কাউন্সিলের পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি।  

১৯৮৪ থেকে তোফায়েল আহমেদ লোক কারুশিল্প জরিপ এবং ডিজাইন ডকুমেন্টেশনের কারিকা প্রকল্পের সাথে  নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। সে সময় বাংলাদেশের প্রায় ১৫০০ গ্রাম পরিদর্শন করেন তিনি এবং ওইসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন ও তাদের কারুশিল্প তথা শিল্পীদের জীবন বৃত্তান্ত  ও কর্মকান্ডগুলি আহমেদ নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ও  গেঁথে রাখেন নিজের মননে। তিনি ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের সাথে কর্মরত ছিলেন। এই জরিপের সময়কালে তিনি মুন্সীগঞ্জে একটি গাজীর পটসহ বেশ কিছু অস্বাভাবিক এবং  দুর্লভ লোকশিল্পের নিদর্শন আবিষ্কার করেন। গাজীর পট মূলত এক প্রকার লোকচিত্রকলার নিদর্শন। গাজী পট ছিল গাজী পীরের জীবনের উদাহরণ হিসেবে রচিত স্ক্রোল পেইন্টিংয়ের একটি রূপরেখা।

এককালে এই গাজীর পট বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বিশেষ করে, বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, যশোর, খুলনা, রাজশাহী প্রভূত অঞ্চলগুলোতে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। গাজী পীরের উপাখ্যানের বিভিন্ন দৃশ্যসমুহ চিত্রায়িত করে এবং সঙ্গীতযোগে পটুয়ারা এইগুলি পরিবেশন করত। পূর্ব ধারণা অনুযায়ী, সারা বাংলায় একটি মাত্র গাজীর পাটই রয়েছে, যা কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ছিল; কিন্তু তোফায়েল আহমদের এই আবিষ্কারের ফলে সেই ধারণাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তোফায়েল আহমদের গবেষণাকর্ম ১৯৯৩ সালে “লোকশিল্পের ভুবনে’ শিরোনামে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল।  

লোকসাহিত্যে তোফায়েল আহমদের অসামান্য অবদান

লোকসাহিত্য এবং লোকসংকলনে তোফায়েল আহমদের উল্লেখযোগ্য অবদান বর্ণনা  করে শেষ করা যাবে না ।  কারিকা প্রকল্পের সাথে কাজ করা ছাড়াও, আহমদ লোকশিল্পের অনেক নমুনাও সংগ্রহ করেছিলেন যা বর্তমানে আর দেখতে পাওয়া যায় না।  এগুলির মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করা যেতে পারে  তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহগুলি যা কিনা আচার এবং আলংকারিক শিল্পে সমৃদ্ধ  এবং তাদের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের গ্রাম্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রায় এক হাজার বস্তু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। 

 তোফায়েল আহমেদ ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিশর, আবুধাবি, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন দেশগুলি থেকেও লোকশিল্প সংগ্রহ করে নিজেকে আর ও সমৃদ্ধ করেছিলেন। আহমদ ঢাকার লালমাটিয়ায় নিজের বাসভবনে তাঁর সংগ্রহসমূহ নিয়ে একটি ব্যক্তিগত লোক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তোফায়েলের এই ব্যক্তিগত সংগ্রহকে ‘মিনি মিউজিয়াম’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। 

আবেদিন তোফায়েল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ  করেন ও সেই সব স্থান থাকে এক হাজারের ও অধিক প্রায় -বিলুপ্ত  লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করেন যেগুলি দিয়ে  তিনি  পরবর্তীতে একটি ব্যক্তিগ্রত সংগ্রহশালা  হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রযত্ন পরিষদ নামকরণ  সহযোগে একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করে ‘বাংলা ঘর লোক ও কারুশিল্প সংগ্রহ’ নাম দিয়ে নিজের স্বপ্নের   সংগ্রশালাকে  এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেন  ও এনডোমেন্টের ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যবস্থাপনার নিকটে হস্তান্তর করে দেন।  । এটি হালফিলে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। 

লোকসাহিত্যে তোফায়েল আহমদের অসামান্য অবদান

নৃত্যগুরু উদয় শঙ্করের জীবনকাহিনী – Uday Shankar Biography in Bengali

তোফায়েল আহমেদের বই ও রচনাসমূহ 

তোফায়েল আহমেদ বহু গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যা লোকশিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, অনুসন্ধিৎসা এবং এই বিষয় নিয়ে তাঁর একনিষ্ঠ গবেষণার ব্যাখ্যা দেয়। তিনি লোকশিল্প ও কারুশিল্পের উপর বেশ কিছু বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে- 

●আমাদের প্রাচীন কারুশিল্প , যা প্রকাশিত হয় 1964 সালে। 

●লোকশিল্প ও কারুশিল্প, 1985 সালে প্রকাশ করা হয়। 

●যুগে যুগে বাংলাদেশ, 1992 সালে প্রকাশিত হয়েছিল 

●1993 সালে প্রকাশ পায়, ‘লোকশিল্পের জগতে’ 

●ঢাকার বানিজ্যিক কারুকলা, 1993 সালে বের হয় 

●লোক ঐতিহ্যের দশ মাত্রা,1999 সালে জনসমক্ষে আসে 

● আটিয়ার চাঁদ। 

পুরস্কার ও  সম্মাননা 

তোফায়েল আহমেদ বিভিন্ন সময়ে নিজের অসামান্য শিল্প নৈপুণ্য ও দক্ষতার জন্য সম্মাননা প্রাপ্ত করেন।১৯৯৮ সালে তোফায়েল আহমেদতকে 

বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’ অর্থাৎ বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি 

শীলু আবেদ কারুশিল্প পুরস্কারে ভূষিত করে যা তাঁকে লোকশিল্প ও কারুশিল্পের সাথে একনিষ্ঠ  ভাবে জড়িত থাকার জন্য প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর তোফায়েল আহমেদকে লোকশিল্প ও কারুশিল্পে বিশেষ অবদানের রাখার দরুন ২০০০ সালে সম্মানিত করে।  তিনি ২০০১ সালে বাংলা একাডেমীর সাম্মানিক ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মোবিল এশিয়া মার্কেটিং প্রাইভেট লিমিটেড  তাদের ১৯৯৯ সালের ক্যালেন্ডারের পাতায় তোফায়েল আহমদের সংগ্রহশালার কয়েকটি নিদর্শনের ছবি ব্যবহার করেছিলেন। 

তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর সংগ্রহশালা থেকে বিশেষভাবে নির্বাচিত ১২৮ টি নিদর্শন নিয়ে ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমী ‘লোকশিল্প অ্যালবাম: তোফায়েল আহমদের বাংলা ঘর থেকে নির্বাচিত সংগ্রহ’ শিরোনামের একটি দ্বিভাষিক অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay

মৃত্যু 

তোফায়েল আহমেদ ২৮ মার্চ ২০০২ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স  হয়ে ছিল ৮৩ বছর।  তাঁর মৃত্যুর  পরবর্তীকালে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে সেই ক্ষতি কখনোই  পূরণ হবার নয়।  মৃত্যুর কিছু কাল পর, ২০০৮ সালে তাঁর সৃষ্ট সংগ্রহশালাটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য এনডোমেন্টের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল। 

উপসংহার  

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির জগতে  একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে  তোফায়েল আহমদের নাম সবার প্রথমে আসে।  লোকসাহিত্যে তাঁর অপার অবদান ব্যক্ত করে শেষ করা যায় না।   তিনি অধ্যাপনার সাথেসাথে জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন গবেষণায়, লোকসংস্কৃতিচর্চায় ও  সেগুলি যথাযথ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে।তিনি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের লুপ্তপ্রায় অসংখ্য নিদর্শন সংগ্রহ করে সেগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন। সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের মূল পরিকল্পনার প্রণয়ন ছিল তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা এক কথায় অনস্বীকার্য।  তিনি দু’বার উক্ত পরিষদের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। 

‘বরণীয় যারা , তারা স্মরণীয় সর্বদা’; এই কথাটি তোফায়েল আহমেদের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য।

লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং  কারুশিল্পে তাঁর অসামান্য অবদান সততই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং  ইতিহাসের পাতায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তাঁর কৃতিত্ব।

 Frequently asked questions

তোফায়েল আহমেদ কে?

তোফায়েল আহমেদ ছিলেন লোকশিল্পের একজন সুপরিচিত বাংলাদেশী গবেষক।

আহমেদের জন্ম কবে হয়?

১৯১৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি।

তোফায়েল আহমেদের রচিত গ্রন্থের নাম কি?

আমাদের প্রাচীন কারুশিল্প , 1964 সালে।

– লোকশিল্প ও কারুশিল্প, 1985 সালে।

– যুগে যুগে বাংলাদেশ, 1992 সালে।

– লোকশিল্পের জগতে, 1993 সালে।

– ঢাকার বানিজ্যিক কারুকলা, 1993 সালে।

– লোক ঐতিহ্যের দশ মাত্রা,1999 সালে।

–  আটিয়ার চাঁদ।

তোফায়েল আহমেদের জীবনাবসান কবে হয়?

২৮ মার্চ ২০০২ সালে।

Recent Posts